E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ৬

২০১৪ জুলাই ১৬ ২০:০৯:৫২
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ৬

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

একদিন ধর্মসাগর পার্কে বিকেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা কজন বন্ধু। মানিক একটি প্রস্তাব দিয়ে বললো, ‘কিসলু (জেলার আবদুর রব সাহেবের ছেলে) বলেছে ‘চাঁদের হাট’ এর একটি শাখা করলে কেমন হয়?’ আমরা এই প্রথম শুনলাম এই নাম। সে বললো, ‘কচি-কাঁচার মেলা, খেলাঘর আসরের মতন একটি জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন, কয়েক বছর হয়েছে এখনো নতুন। দৈনিক পূর্বদেশ কাগজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এর পরিচালক হচ্ছেন প্রাক্তন খেলাঘরের কর্মকর্তা সাংবাদিক, ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই।

ইতিমধ্যে প্রফেসর পাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম মজুমদারের সহযোগিতায় প্রথম কুমিল্লা শাখা গড়ে উঠেছে। সেটার আহবায়ক হচ্ছেন হানিফ সংকেত। তিনিও নাম করা ছড়াকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী। কিসলুর সঙ্গে খুব ভাব।’ এই প্রস্তাবে আমরা বন্ধুরা রাজি হলাম। কিসলুদের বাসাতেই এক রোববারে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হলো। সভাপতিত্ব করেন কিসলুর বড়ভাই লাভলুভাই। আর যারা ছিলাম, মানিক, আমি, স্বপন, বিষ্ণু, কিসুলদের পাশের বাসায় থাকেন জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট এর ছেলে জুয়েল, দুলাল, হেলাল, মঞ্জু, শাহীন, নাসরিন তার ছোটবোন নায়লা, কিসলুর বোন মীনা, রীনা, সোহেলী, শিরিন, বিলকিস আরও কে কে যেন। আর বড়ভাইদের মধ্যে মোমিনভাই, মনাভাই, আনিসভাই, শতদলদা, মনিরভাই প্রমুখ। শান্তিপূর্ণভাবেই কমিটি গঠিত হলো।

আবদুর রব সাহেবকে প্রধান উপদেষ্টা হলেন। এই প্রথম হানিফ সংকেতের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁর সঙ্গে কবি সুমন্ত চট্টোপাধ্যায় তখন তিনি সিলেট মেডিকেলের ছাত্র। তাঁর বাবা ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের স্বনামধন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক বিল্বমঙ্গল ভট্টাচার্য। সুমন্তদার বড়দা প্রখ্যাত সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিক সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়। আমি হলাম ধর্মসাগর পাড় চাঁদের হাট শাখার সাহিত্য সম্পাদক। সিদ্ধান্ত হলো যে, অভিষেক অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পর্বের পর একটি নাটিকা মঞ্চস্থ হবে। এক মাসের সময় নেয়া হল প্রস্তুতির জন্য। এর মধ্যে নতুন কমিটি ঢাকার কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পাশ করিয়ে আনবেন হানিফ সংকেত। তিনি প্রায়ই ঢাকা যান। বাবা ‘চাঁদের হাট’ নামে একটি সংগঠন করছি জেনে খুব খুশি হলো। বললো, ‘কে কে আছে?’ আমি সবার নাম বললাম। আরও বললাম, ‘হানিফ সংকেত আছেন তিনি খুব নামকরা ছড়া লেখক ও সাংস্কৃতিককর্মী তাঁরই উদ্যোগে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মানিক হয়েছে কমিটির আহবায়ক।’ বাবা বললো, ‘হানিফ সংকেত থাকে কোথায় শাসনগাছা নাকি?’ শুনে আমি তো অবাক! বললাম, ‘হ্যাঁ। তুমি তাকে চেনো?’ বাবা হেসে বললো, ‘আরে চিনবো না কেন? সে তো আমাদের এক পুলিশের ছেলে। ওর আসল নাম একেএম হানিফউল্লাহ। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো। ভালো খুব ভালো। ঠিক আছে মিলেমিশে করো। এবার পাড়ার পরিবেশ আরও সুন্দর হবে।’ বাবার উৎসাহ পেয়ে আমার উৎসাহ দেখে কে! প্রতিদিন বিকেল হলেই মিটিং কিসলুর ঘরে। কিসলু ছিল আমাদের এক বছরের বড়, কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বড়লোকের ছেলে বিধায় চালচলনে একেবারে উড়নচন্ডি। লিকলিকে শরীর, চোয়ালভাঙা, মেয়েদের মতো দীর্ঘ চুল। ইতিমধ্যে ধূমপানের গ্রেজুয়েশন হয়ে গেছে তার। ফুঁক ফুঁক করে সিগারেট টানে। সংগঠনের কাজের মধ্যে আপাতত প্যাড, খাম ছাপানো, একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া, নাটকের সংলাপ মুখস্থ করা। কি যেন ছিল নাটিকার নাম মনে নেই। লাইট ভাড়া করে আনতে হবে। চেয়ার ভাড়া করতে হবে। কত কাজ আমাদের! সে এক উৎসব উৎসব ব্যাপার পুরো পাড়া জুড়ে। এদিকে কচি-কাঁচার মেলা ও খেলাঘরের বন্ধুরাও জেনে গেছে, অভিনন্দন জানাতে আসছে। হানিফ সংকেত, সুমন্তদা, রিপনভাই, লাতুভাই; রিপনের রূপসী বোন নাসরিন আপা, লাভলি আপাও এসে কিসলুদের বাসায় মহড়াতে অংশগ্রহণ করেন।

পাড়ার শিশুদের মধ্যেও একটা আলোড়ন দেখা দিল। রাস্তায় দেখা হলে কবে হবে, কবে হবে অনুষ্ঠান জিজ্ঞেস করতো। যে যার কর্মপদ অনুযায়ী কাজে লেগে গেলাম। স্বপন হলো শিল্প ও প্রকাশনা সম্পাদক তাই দুজনে মিলে হানিফ সংকেতের সহযোগিতায় লেখা সংগ্রহের জন্য শহরে বেরোলাম। এই প্রথম জানলাম যে এই শহরে অনেক কবি, লেখক, সাহিত্যিক আছেন! লেখা সংগ্রহ করা যে কী কষ্টকর কাজ তখন বুঝলাম! হেঁটে হেঁটে শহরের এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত গিয়ে বেশ কিছু লেখককে ছড়া, কবিতা দেবার জন্য অনুরোধ করলাম। প্রখ্যাত ছড়াকার জহিরুল হক দুলাল, কবি ও অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব, কবি, গল্পকার ও অঙ্কনশিল্পী সৈয়দ আহমাদ তারেক, কবি ফখরুল হুদা হেলাল, কবি ফরিদ মুজহার, কবি হাসান ফিরোজ, কবি আনোয়ারুল হক, কবি ফখরুল ইসলাম রচি, কবি আলী হোসেন চৌধুরী, কবি বাবুল ইসলাম, কবি মোহাম্মদ আলী, কবি গাজী মুহম্মদ ইউনুস, কবি বাদল বৈরাগী, কবি সৈয়দ আহমাদ তারেক, কবি মঞ্জুরুল করিম পিয়াস, ছড়াকার নীতিশ সাহা, ছড়াকার রঙ্গু শাহাবুদ্দিন, ছড়াকার মোমিনুল হক, ছড়াকার জাকির হোসেন বাবু, ছড়াকার কামাল হাসান, কবি হাসনে আরা মিনা, কবি আবুল হাসানাত বাবুল, কবি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী প্রমুখ।

ছড়াকার পরে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার তখন কুমিল্লাতেই ছিল, সে করতো বাংলাদেশ বেতারের শাপলা-শালুকের আসর, কিন্তু হানিফ সংকেতদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকার কারণে হানিফভাই তার নাম বলেননি। সুমন্তদা, হানিফভাই তো লেখা দিয়েছিলেনই বাকিদের লেখা কেউ বললেন, ‘আজকে সন্ধ্যায় কান্দিরপাড় কালুর চা-দোকানে এসো দেবো’; কেউ বললেন, ‘দুদিন পরে এসো’; কেউ বললেন, ‘পরশুদিন পেয়ে যাবে।’ আবার কেউ বললেন, ‘আগামী সপ্তাহের আগে দিতে পারবো না।’ সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাদের! কিন্তু কিছু করার নেই কারণ এরাই হচ্ছেন কুমিল্লার সাহিত্য জগতের রথী-মহারথী। বিশেষ করে অত্যন্ত সুদর্শন, স্মার্ট এবং রাগী কবি ফখরুল হুদা হেলাল রাজার মতো কুমিল্লার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে শাসন করতেন! ভিক্টোরিয়া কলেজের ক্যাম্পাসে তরুণ হেলালভাইকে যখন বীরদর্পে হেঁটে যেতে দেখতাম মনে মনে ভাবতাম, শুধু কবি হলেই হয় না, কবিকে স্মার্টও হতে হয়।

তাঁদের থেকে আমরা সমীহভরে দূরেই থাকতাম। কিন্তু জাপানে আসার মাত্র কিছুদিন আগে হেলাল ভাইয়ের সাহিত্য সংগঠন ‘সে আমি তুমি’র সদস্য হতে পেরেছিলাম। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তাঁদের নিষিদ্ধ আড্ডায় যাবার সাহস পাইনি। সৈয়দ আহমাদ তারেকও আরেক জিনিয়াস। আধুনিক কালের শ্রীকান্ত, ২৪ ঘন্টার জন্য আপদমস্তক অস্থির। জাত বোহেমিয়ান! কোথাও তাঁর স্থিরতা নেই। মাঝেমাঝে রাজপথ, রেলস্টেশন, জাহাজঘাট আর মাঝে মাঝে ঢাকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘সন্ধানী’-ই তাঁর ঘরবাড়ি-আশ্রয়। সারা বাংলাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন, কবিতা পড়ছেন, প্রেম করছেন সুন্দরীদের সঙ্গে, ‘তাহমিনা কম্প্লেক্স’ নিয়ে ভুগেছেন কয়েক বছর। চট্টগ্রামের কবিগোষ্ঠী ‘স্পার্ক জেনারেশনে’র মধ্যমণি হয়েছিলেন কিছুদিন। দিনে-দুপুরে তো বটেই মধ্যরাতেও যিনি থাকতেন নেশাচ্ছন্ন শাসন করতেন রাজপথ। মুড়ির মতন খেতেন তিনি ঘুমের ওষুধ সিডাকসিন। এ রকম দুর্দান্ত তেজী তারুণ্য বাংলাদেশ দেখেনি কোনোকালেই। ঢাকায় তখন কবি আবুল হাসান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি রফিক আজাদ, কবি শহীদ কাদরী, কবি আল মাহমুদ, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি অসীম সাহা; চট্টগ্রামে কবি শিশির দত্ত, কবি আসাদ মান্নান, কবি কমল সেনগুপ্ত আর কুমিল্লায় কবি ফখরুল হুদা হেলাল, সৈয়দ আহমাদ তারেক আর কবি ফখরুল ইসলাম রচি সদ্যজন্ম বাংলাদেশের নেশালু তারুণ্যের কিংবদন্তিতুল্য কবি।

সে যাই হোক, কবিদের পেছন পেছন ঘুরে লেখা সংগ্রহ করার পর চিন্তা করতে লাগলাম কী রকম আঙ্গিক হলে সুন্দর এবং ব্যতিক্রম একটি সাহিত্য সংকলন করা যাবে। স্বপন প্রচ্ছদ আঁকতে লেগে গেল। অনেক ভাবনাচিন্তার পর সুমন্তদা বললেন, চিকন লেইস ফিতার মতো করলে কেমন হয়! যেই চিন্তা সেই কাজ! সেটাই করা হলো। সম্ভবত ৮ পাতার ফিতার আকারে হালকা সবুজ কাগজে সংকলনটি করে দেবার জন্য সুমন্তদার সহযোগিতায় বাদুরতলার প্রাচীন এবং বিখ্যাত সিংহপ্রেসের দিলীপদাকে দিয়ে আসলাম। রাত জেগে জেগে এই প্রথম একটি ছড়া লিখলাম সংকলনের জন্য। ছড়াও তো কবিতা সুতরাং কবি হিসেবে অকস্মাৎ মেঘ ফুঁড়ে আত্মপ্রকাশ করলাম। নিজেই ছোট্ট করে একটি সম্পাদকীয় লিখলাম। দুটোই ঠিকঠাক করে দিলেন ছড়াকার হানিফ সংকেত। তাঁর হাত দিয়েই আমার ছড়া তথা লেখালেখির হাতেখড়ি ১৯৭৬ সালে। বেশ সাড়া জাগিয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠিত হলো কিসলুদের বাসভবনের বড় উঠোনে মঞ্চ তৈরি করে। পাড়ার লোক তো বটেই রাস্তার পাশে পথচারীরাও ভিড় করেছিল। সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলেছিল। ভেবেছিলাম বাবা দেখতে আসবে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেনি।

অনেক রাতে বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন হলো অভিষেক অনুষ্ঠান?’ বললাম,‘দারুণ হয়েছে। অনেক লোক এসেছিল।’ এই অনুষ্ঠানে অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। বাবাও চাঁদা দিয়েছিল। কুমিল্লার আমোদ ও রূপসীবাংলা ও ঢাকার কাগজ দৈনিক বাংলা, দি বাংলাদেশ টাইমস, সাপ্তাহিক চিত্রালী, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাকে অনুষ্ঠানের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বাবা আগ্রহভরে পড়লো সেসব সংবাদ। ‘ঝিলিমিলি’ নামে সাহিত্য সংকলনটিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লো। বললো, ‘ভালোই তো লিখেছো।’ বাবা বহুলপঠিত ‘ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’ নিজেই আবৃত্তি করে উৎসাহ দিয়ে বললো,‘ ভালো করে চর্চা করো। যত পড়বে ততই তোমার লেখা সমৃদ্ধ হবে। লেখার পূর্বশর্ত পড়া। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো পড়তে চায় না। জানবে কোথা থেকে? না জানলে লিখবে কিভাবে? ছড়া বলো, কবিতা বলো, গল্প বলো কোনো কিছুই ফেলে দেবার নয়। এ এক কঠিন সাধনা।’ তারপর মারাত্মক এক কথা বলে অন্যঘরে চলে গেল: ‘এখন তুমি যেমন এই শহরে জিআরও পরেশবাবুর পরিচয়ে পরিচিত তেমনি একদিন মানুষ যেন বলে, উনি তো লেখক প্রবীরবাবুর বাবা!’ ...চলবে

আলোকচিত্র : উপরে, ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কিসুলরা যে বাড়িতে থাকত এখন ধসে পড়ার অপেক্ষায়। নিচে কবি ও ছড়াকার জহিরুল হক দুলাল বর্তমানেও লেখালেখি করছেন।


লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ১৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test