E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ৯

২০১৪ জুলাই ১৯ ১৭:৫০:০৫
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ৯

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

মাঝে মাঝে ভাবতাম, একজন পুলিশ অফিসার এত কিছু বোঝে কী করে? বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘তুমি এত কিছু বোঝো কি করে, অঙ্কের হিসেব তুমি জানো, নবীনচন্দ্র সেনের বিখ্যাত ‘পলাশির যুদ্ধ’ কবিতা, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘শাহজাহান’, ডি এল রায়ের ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার’ কবিতা, নজরুলের কবিতা ‘বাংলাদেশ’ এখনো মনে রেখেছো!’ বাবা চোখ কপালে তুলে বলতো, ‘আরে, বলে কী পাগল ছেলে! এসব তো আমাদের পাঠ্য ছিল। শ্রেণীকক্ষেই মুখস্ত করে ফেলেছি। আর অঙ্কের কথা বলছো? গণিতের মাস্টারমশাই কোনোদিন বই দেখে অঙ্ক মেলাতো না, সব মুখে মুখে। আরে মানুষের জীবনটাই তো অঙ্ক। রাজনীতি কী? রাজনীতি হচ্ছে একটি বিশাল শাখা-প্রশাখাব্যাপ্ত অঙ্ক সেটাকে মিলানোই তো রাজনীতিবিদের কাজ। এটা খুব ভালো বুঝতেন শেখ মুজিব। তাই তো রাজনীতির অঙ্ক খেলেই স্বাধীনতা আনতে পেরেছিলেন। জিয়াউর রহমান এই অঙ্কটা বুঝতে পারছেন না বলেই তো চারদিকে এত শত্রু তাঁর। সব লেজেগোবরে করে ফেলছেন। রাজনীতির অঙ্কে ভুল করলে নির্ঘাত মৃত্যু। তিনি ন্যাশনালিস্ট ঠিক আছে কিন্তু প্রকৃত ন্যাশনালিজমের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা পরস্পরবিরোধী। তিনি দেশটাকে রিলিজিয়াস ন্যাশনালিজমের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এটা ভুল অঙ্ক। মারাত্মক ভুল অঙ্ক।

রবীন্দ্রনাথ যখন দেখলেন ন্যাশনালিজমে হিন্দুধর্মের বাড়াবাড়ি জায়গা করে নিচ্ছে তখন তিনি সরে গেলেন। জিন্নাহ্ও এই ভুল করেছিলেন তাঁর মতো জিয়াউর রহমানও বেশিদিন টিকবেন না তুমি দেখে নিও।’ কী অমোঘ ভবিষ্যবার্তা! বাবার কথাই সত্যি হয়েছিল মাত্র চার বছর পরে। সত্যিকার ন্যাশনালিজম যে কী জিনিস সেটা আমি বাবার কাছ থেকেই ধারণা পেয়েছিলাম। সেটা পোক্ত হলো জাপানে থাকার ফলে। সত্যিকার ন্যাশনালিস্টরা যে চোর নয়, সন্ত্রাসী নয়, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে না এটা জপানের বিখ্যাত ন্যাশনালিস্টদের জীবনবৃত্তান্ত পড়ে বিস্মিত হয়েছি! যাঁরা আধুনিক জাপানকে গড়ে দিয়ে গেছেন। এঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের একমাত্র বঙ্গবন্ধুকেই তুলনা করে চলে। দেশে থাকতে শেষের দিকে একসময় আমার এমন ধারণা জন্মেছিল যে, সরকার তো বটেই প্রতিটি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ারে বসা লোকদেরকে আমার চোর মনে হতো। জাপানে আসার অনেক বছর পর এই ধারণাটির কিছুটা বদল ঘটেছে। ছাত্রজীবনে আমি অঙ্কে খুব কাঁচা ছিলাম তাই বাবা বলতো, ‘তুমি অঙ্কে কাঁচা, তাই তোমার দ্বারা পলিটিক্স হবে না। ওটা বাদ দাও। চুরি, ডাকাতি, জোরজারি করে পরের টাকা-সম্পদ আত্মসাৎ করতে না জানলে তুমি পলিটিশিয়ান হতে পারবে না। আর এটা করতে গেলে তোমাকে অঙ্ক জানতে হবে। দেয়ার ফর, আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু ডু ইট, ক্লিয়ার?’

নিদারুণ সত্যিকথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে লোকশান ছাড়া লাভ কিছুই হয়নি। তারও আগে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরপরই ছাত্রলীগের একটি জঙ্গি মিছিলে আমি, মানিক, স্বপন, বিষ্ণু, মঞ্জুর মোর্শেদ, বাকের, খোকন সামনের দিকে ছিলাম। এটা ছিল পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিল, ঠিক জিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে নয়। সেদিন ছিল ছুটির দিন রোববার এবং সকাল বেলা। রাজগঞ্জ বাজার, মোগলটুলি, কুমিল্লা হাই স্কুল, সার্কিট হাউস এবং স্টেডিয়ামের সম্মুখ দিয়ে কান্দিরপাড়স্থ টাউনহল ময়দানে এসে শেষ হবে মিছিল তারপর সভানুষ্ঠান---এই ছিল লক্ষ্য। রাজগঞ্জ বাজারের প্রবেশ মুখে যখন এলাম তখন আমি স্লোগান দিচ্ছি জোর গলায়: ‘পুলিশের গুন্ডামি চলবে না---চলবে না’, ‘পুলিশ তুমি যতই বাড়ো---তোমার বেতন একশ বারো’, ‘ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকা চলবে না---চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান। হঠাৎ পেছন থেকে স্বপন বলে ওঠে, পটু দ্যাখ্ তোর বাবা....! এইরে! তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশে বাবা বাজারের থলি হাতে কঠিন মুখ করে আমাদেরকে দেখছে।

সর্বনাশ! আমি, স্বপ্ন, মানিক ও বিষ্ণু একইসঙ্গে মিছিলের ভিতরেই ঠেলে ঠুলে দেহ আড়াল করে মাথা নুয়ে এগিয়ে গেলাম। তারপর যা হবার তাই হল। দুপুরের পরে যে যার বাসায় ফিরে গেলাম ঘামে ভিজতে ভিজতে, ভূতুড়ে এক খিদে নিয়ে। কিন্তু সদর দরজার কাছে যেতেই ছোটভাই পীযূষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কিছু একটা হয়েছে সন্দেহ হলো। সে বললো, ‘বাবা ভীষণ রেগে আছে। এই বেলা পালিয়ে থাক। বিকেলের দিকে অফিসে যাবে তখন ফিরিস। রেগেমেগে বলছে, তুই নাকি পুলিশের বিরুদ্ধে মিছিলে গিয়েছিস! স্লোগান দিয়েছিস! পুলিশের বাসায় তোর ভাত নেই। এটা তোকে বলার জন্য আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ঘণ্টাখানেক। পালা তুই!’ তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো বাবা একবার সাবধান করে দিয়ে বলেছিল, ‘ইফ ইউ ডু পলিটিক্স, ইউ উইল বি আউট অব সাপোর্ট।’ বাবা নীতিবান লোক, নীতি খাটিয়েছে। ব্যাস, বাসায় প্রবেশ নিষেধ। কী আর করা, পকেটে টাকাও নেই যে বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খাবো। বাধ্য হয়ে স্বপনের বাসায় গিয়ে খেয়ে দিলাম এক দীর্ঘঘুম অবশ্য ক্লান্তও ছিলাম খুব। রাজনীতিকে যে বাবা ঘৃণা করে তা নয়, এখনো দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত রাজনৈতিক ভাষ্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে, বলে, ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর স্বদেশ রায়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলো আমার খুব পছন্দ কেননা বাংলাদেশ কীভাবে জন্মলাভ করলো এই ইতিহাসের আদ্যপ্রান্ত উনারা জানেন। কোথায় যাবে দেশটা এটাও তাঁদের লেখা থেকে ধারণা লাভ করা যায়। আসলে সবকিছুই অভিনিবেশের ব্যাপাররে বাবা, একদিনে কিছু হওয়া যায় না। সাধনা করতে হবে।’ আমিও ছড়া লেখার পাশাপাশি গদ্যচর্চার সাধনায় নিগম্ন হলাম। এই সাধনায় পর পর কয়েকটি ঘটনা দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে এক দুঃখজনক সংবাদ দিল মানিক। কিসলুর বাবা বদলি হয়েছেন ঢাকায়। এক মাসের মধ্যে কুমিল্লা ছাড়তে হবে। নতুন জেলার আসবেন। আকাশ থেকে পড়লাম এই সংবাদ শুনে! তড়িঘড়ি করে কিসলুরা থাকতে-থাকতে ধর্ম সাগর পাড় চাঁদের হাটের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন না করলে নয় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। হানিফভাই আমাকে ও মানিককে নিয়ে ঢাকায় যাবেন বললেন অতিথি আমন্ত্রণের জন্য। বাবাকে বললাম বিষয়টি। কারণ বাসভাড়া তো দরকার। বাবা কিসলুর বাবার বদলির কথা জানতো। বিনাবাক্যে বাসভাড়াসহ হাতখরচ দিল। ঢাকায় গেলাম আমরা। এই প্রথম ‘দৈনিক অবজারভার ভবনে’ যেখানে ‘সাপ্তাহিক কিশোরবাংলা’ ও সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রালী’র অফিস। চিত্রালীর সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তাঁকে আমন্ত্রণ করলাম। তারপর ‘দৈনিক বাংলাদেশ টাইমসে’র নির্বাহী সম্পাদক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকেও। তাঁরা দুজনেই কেন্দ্রীয় চাঁদের হাটের উপদেষ্টা। সেবার ঘটা করে টাউনহল মিলনায়তনে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হলো। মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি করেছিল শহরের ছড়াকার ও কবিরা। আমিও ছড়া পাঠ করেছি। প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছিল। কারণ মাইকিং করা হয়েছিল, পোস্টার লাগানো হয়েছিল, স্থানীয় ও ঢাকার দৈনিক পত্রিকাতে আগাম সংবাদ ছাপা হয়েছিল।

কচি-কাঁচার মেলা ও খেলাঘর শাখাগুলোর কর্মীরাও এসেছিল। অনুষ্ঠান শেষে অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটলো। হলের বারান্দায় আলো-আঁধারিতে অনেক লোকের ভিড়ে একটি তরুণ এসে বললেন, ‘তুমি পটু না!’ আমি থমকে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।’ তিনি এবার হেসে আমার হাত ধরে বললেন, ‘আরে আমি স্বপনদা, শিখার ভাই। ছোটরাতে পাশাপাশি বাসায় থাকতাম মনে নেই?’ এবার চিনতে কষ্ট হলো না, তবে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি হ্যান্ডশেক করে বললাম, ‘আপনারা সবাই ভালো আছেন?’ আমি চকিতে চারদিকে দেখে নিলাম শিখাও এসেছে কিনা এই ভেবে। সহসা বুকটা ধুক ধুক করে উঠল। বললাম, ‘সেই যে যুদ্ধের আগে শেষ দেখা হয়েছিল আর এত বছর পর! স্বপনদা বললো, ‘হ্যাঁ। আমরা সবাই ভালো আছি। তোমরা ভালো তো? অবশ্য কাকাবাবুর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল কোর্টে। বলেননি বুঝি!’ ‘না। হয়তো ভুলে গেছে।’ স্বপনদা বললেন, ‘এখন তোমরা কোথায় থাকো? আমরা ডিগম্বরিতলায়।’ আমি বললাম, ‘সেটা জানি। জেঠুর সঙ্গে স্বাধীনতার পরপরই দেখা হয়েছিল তখন বলেছিলেন।

আমরা এখন ধর্মসাগর পশ্চিম পাড়ে থাকি।’ তিনি আমার হাত শক্ত করে চাপ দিয়ে বললেন, ‘তুমি অনেক বড় আর স্মার্ট হয়ে গেছো। চেনাই যায় না। তোমার ছড়া পড়ি দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদের খেলাঘরের পাতা, অন্যান্য কাগজে। ভালো লিখছো।’ আমি বললাম, ‘চেষ্টা করছি। আপনি এখন কি করছেন?’ ‘আমি এখন বিএ পরীক্ষা দিয়ে আপাতত বেকার, ঢাকায় যাবো ভাবছি।’ তপনদা কি করছেন, ‘চাকরি? কালীদা?’ ‘মেজদা চাকরি করছে একটা ওষুধ কোম্পানিতে। আর কালীদা তো কলকাতা থেকে দেশে ফেরেনি। দিদির বিয়ে হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, এখন ঢাকায় থাকে সেটাতো জানোই। আর শিখার বিয়ে সামনের মাসে। তোমরা এসো। ডাক্তার নিত্যহরি সাহার বাড়ির নিচতলাতেই আমরা থাকি। কাকাবাবুর কাছে কার্ড পৌঁছে দেবো। এসো কিন্তু।’ আমার আর মুখ থেকে কোনো কথা বেরোলো না। চমকে উঠলাম, শিখার বিয়ে! এত অল্প বয়সে! কেন? তিনি হয়তো খেয়াল করেননি আমার মুখের রংও বদলে গিয়েছিল।

তবু সৌজন্যবশত নিস্তেজ কন্ঠে বললাম, ‘হ্যাঁ যাবো। শিখাকে বহুদিন দেখি না। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তা ভাবিনি। ভালো।’ স্বপনদা বললেন, ‘দেশের অবস্থাটা তো ভালো না। বাবা মার বয়স হয়ে গেছে, তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চায়। বর রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক।’ স্বপনদা চলে গেলেন। আমি সেভাবেই আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এক এক করে সবাই চলে গেল। মানিক, স্বপন, বিষ্ণু শিশুশিল্পীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে গেছে। ঢাকার অতিথিরা অনেক আগেই চলে গেছেন কিসলুদের বাসায়। খাওয়া-দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা সেখানেই। বিশাল বাড়ি, চারজন গেস্ট থাকা কোনো ব্যাপারই না। সকালেই তারা চলে যাবেন। আমার দায়িত্ব ছিল মঞ্চ গোছগাছ করে চাবি টাউনহল লাইব্রেরিতে ফিরিয়ে দেয়া। সেটাই সম্পাদন করে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম। ...চলবে

আলোকচিত্র : বামে, কুমিল্লা টাউন হল যেখানে আমার সাহিত্যচর্চার বিকাশ ঘটেছে, ডানে, ধর্মসাগর পাড়ে আমি স্বপন ও মামুন প্রায় দিনের আড্ডা।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ১৯, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test