E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১০

২০১৪ জুলাই ২০ ১৭:৫০:২৯
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১০

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

ধর্মসাগর পাড়ের রাস্তা ধরে যখন হেঁটে ফিরতে লাগলাম ক্রমেই দারুণভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলাম। মনে হচ্ছিল দুই পা ডুবন্ত----কালো কালো ভারী মেঘের স্তুপ ঠেলে ঠেলে আমি হাঁটছি। ছোট্ট একটি সংবাদ: ‘শিখার বিয়ে’ এ্যাত ব্যাপক সমুদ্রের মতো আমাকে আচ্ছন্ন করবে, গ্রাস করবে ভাবতেই পারিনি! শিখা এখন প্রায় অষ্টাদশী। ছেলেবেলার দিনগুলোর স্মৃতি চলচ্চিত্রের ধারাবাহিক দৃশ্যের মতো মনের মধ্যে চলতে লাগলো। রাতও বেশ হয়ে গিয়েছিল। খিদেও পেয়েছিল। তথাপি অশান্ত মন নিয়ে অনেকক্ষণ ধর্মসাগর পাড়ে বসে রইলাম একা। হঠাৎ করে নিজেকে ভাসমান খড়কুটো মনে হতে লাগলো। মাঝরাতে ঘরে ফিরতেই উদ্বিগ্ন মা বললো, ‘এত রাত হলো যে! কোথায় ছিলি? স্বপন, মানিক, বিষ্ণু এসে কয়েকবার খোঁজ করেছে। কী দুশ্চিন্তাই না হচ্ছিল! যাক, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে। তোর বাবা একটু আগেও জেগে থেকে ঘরবার করেছে। দিনকাল ভালো না বাবা, অত রাতে বাইরে থাকিস না।’ তবুও মাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, ‘শিখার সেজদা স্বপনদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন।

অনেক বছর পর দেখা তো তাই অনেকক্ষণ কথা বললাম।’ ‘ও তাই নাকি!’ মা বললো, ‘হ্যাঁ, সেই যে যুদ্ধের আগে বিচ্ছিন্ন হলাম আমরা আর তো দেখা হয়নি। এখন ডিগম্বরিতলায় নাকি থাকে তোর বাবা বললো। শিখাও তো অনেক বড় হয়ে গেছে তাই না?’ আমি বললাম, ‘তাতো হবেই। মেঘে মেঘে কম বেলা হলো নাকি? আমিই কি বড় হইনি?’ কিন্তু শিখার বিয়ের সংবাদটি আমি চেপে গেলাম। বলতে মন চাইলো না। পরে অবশ্য খারাপ লেগেছিল মাকে জানানো উচিত ছিল, কেননা এটা আমার জন্য দুঃসংবাদ হতে পারে, মার জন্য তো শুভসংবাদ কারণ তারও তো মেয়েসন্তান আছে। পিছিয়ে থাকা বাঙালি সমাজে মেয়েদের বিয়ে সবসময়ই শুভসংবাদ। পরের দিনও আমি ইচ্ছে করেই কাউকে দেখা দিলাম না। খুব সকালে উঠে হাঁটতে হাঁটতে ডিগম্বরিতলা পর্যন্ত চলে গেলাম। খুঁজে খুঁজে বাড়িটি বের করে দূর থেকে দেখলাম। শৈশবে ডাঃ নিত্যহরিও আমার অসুস্থ পায়ের চিকিৎসা করেছিলেন। দ্বিতল বাড়িটির বন্ধ লোহার গেটের ভিতরে নিচতলায় কিছুই দেখা যায় না। নিচতলায় থাকে শিখারা গাছগাছালিতে অন্ধকারাচ্ছন্ন।

কিছুক্ষণ থেকে চলে এলাম কলেজে। ক্যান্টিনে বসে সকালের নাস্তা করলাম। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে দেখি তাজু এসে হাজির। তাজুল ইসলাম। সে ঢাকা-কুমিল্লার মধ্যে সার্ভিসযুক্ত মজুমদার বাস কোম্পানির মালিকের ছেলে। সায়েন্সের ছাত্র। বললো, ‘দোস্ত্ আজ ক্লাস করতে মন চাচ্ছে না চল্ ঘুরে আসি কোটবাড়ি থেকে।’ আমি বললাম, ‘ভালোই হলো। আমারও একই অবস্থা।’ দুজনে বেবিটেক্সি নিয়ে চলে গেলাম কোটবাড়ি। সেখানে ঘুরে ঘুরে একটি গ্রাম্য চায়ের স্টলে বসে সারাদিনই কাটিয়ে দিলাম। আমি বললাম, ‘দোস্ত্ তোর মন ভালো না মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে নাকি?’ তাজু বেশ কিছুদিন হলো সিগারেট ধরেছে। পয়সা আছে তাই ৫৫৫ টানে। বাসায় টানে না। বাইরেই শুধু। বললো, ‘শালা তুই ভার্জিন রয়ে গেলি! সিগারেট টানবি না, মাল খাবি না তুই শালা লেখক হবি কীভাবে? ছড়া লিখিস তাও বাচ্চাদের জন্য। বড় করে ভাবতে শিখ্ নিজেকে। নে একটা সিগারেট খা নইলে কথা জমবে না।’ আমি নিলাম।

হঠাৎ করে মনে হলো, ‘হ্যাঁ, এখন সিগারেট টানা যায়, মদপানিও খাওয়া যায় কেননা এতদিন পর্যন্ত যে সমান্তরাল পথটা হেঁটে এসেছি তার কোনো বাঁক নেই। বাঁকের ওপারে রহস্য নেই, বৈচিত্র্য নেই তা কি করে হয়! বৈচিত্র্য দরকার। ভিন্ন স্বাদ দরকার। ভিন্ন একটা জগৎ দরকার। যেখানে নিজেকে ইচ্ছেমতো ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করা যাবে। আমার এখন নিজেকে পোড়ানোর সময় এসেছে। শুল্কা ঠিকই বলেছে, সোনা না পোড়ালে অলঙ্কার তৈরি করা যায় না। পারি আর না পারি আমি অলঙ্কার তৈরি করতে চাই। চট করে ওর কাছ থেকে সিগারেটটা নিলাম। ম্যাচ্ দিয়ে আগুন জ্বেলে দিলাম সিগারেটের মাথায়। তারপর লম্বা টান দিলাম। ধোঁয়া গিললাম। অমনি মনে হলো মাথাটা ঘুরছে যেন! টলছে। পড়ে যাবো নাকি আমি! তারপর ধোঁয়া ছাড়লাম নাকমুখ দিয়ে। তাজু হঠাৎ আমার এই কান্ড দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! হেসে বললো, ‘ব্রাভো! ব্রাভো! এই না হলে কবি, এই না হলে পুরুষ! ধর্ শালা আরেকটা টান।’ পরে আরেকটি শলা প্যাকেট থেকে তুলে আমার সামনে রাখলো। আমি কয়েক মিনিটেই একটি টেনে শেষ করে দিলাম। তারপর এক গ্লাস জল খেলাম। তাজু আবার চায়ের ওর্ডার ছিল। আমার মনে হচ্ছিল মাথাটার ভেতরে নেশার মতো কিছু হয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘এবার বল্। কী হয়েছে।’ তাজু বললো, ‘ভাবছি দেশ ছেড়ে চলে যাবো।’ ‘কেন?’ আমি জল মুখে তুলতে গিয়ে নামিয়ে ফেললাম। ‘কোথায় যাবি?’ ‘আমেরিকায়।’ ‘তোদের টাকা আছে, যেতেই পারিস।’ ‘নারে।

দেশেই থাকতে চেয়েছিলাম। আব্বাও চায়। কিন্তু আমার মনটা আর চাচ্ছে না। এমনিতেই এই দেশটা কট্টোর ইসলামিক দেশ হয়ে যাবে ভবিষ্যতে দেখে নিস। বহু বছর লাগবে উঠে দাঁড়াতে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তুই তো জানিস, অলিভিয়ার জন্য আমি কেমন পাগল অনেক দিন ধরে। কিন্তু মেয়েটার মন জয় করা যাচ্ছে না। দেমাগ বেশি। তাই সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাবো ভাবছি।’ মনে মনে একটা হোঁচট খেলাম। দুশ্ শালা এখন দেখছি দুজনে একই নৌকোয় উঠে বসে আছি। আমি মুচকি হাসলাম। সিগারেটটা ধরালাম। বললাম, ‘মেয়েটি সুন্দরী এবং মেধাবী। আমি চিনি তাকে। ওই কুমিল্লা কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়ে তো? আমাদের চাঁদের হাটের কর্মী নাসরিনের বান্ধবী।’ বললাম, ‘ও কি সরাসরি রিফিউজ করেছে?’ ‘হ্যাঁ। দু/তিনটি চিঠি দিয়েছি। ফিরিয়ে দিয়েছে। খুলেও দেখেনি। গতকাল ফোন করেছিলাম, বললো, ‘এভাবে চিঠি দিয়ে, টেলিফোন করে যেন ওকে আর বিব্রত না করি।’ দুশ্ শালার প্রেম! লাইফটা পান্তাভাত হয়ে গেল!’

আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি আর কি। বললাম, ‘মেয়েদের মন, সহস্র বছর সখা সাধনার ধন। তুই যাকে প্রেম বলছিস, ভালোবাসা বলছিস, আসলে দোস্ত্ এটা সেটা নয়। সত্যিকার প্রেম/ভালোবাসার বয়স আমাদের এখনো হয়নি। এটা যুগের হাওয়া। এমন এক যুগ এসেছে প্রেম/ ভালোবাসার মোহ জাতীয় একটা প্যাশন মানে একটা সিম্পলি অনুরাগ যা বশ করে ফেলছে আমাদেরকে। তুই এই বয়সে অলিভিয়াকে বিয়ে কর দেখবি খুব দ্রুত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছিস। কিন্তু এই রোগ থেকে বেরোবার উপায় নেই এই সময়টা না পেরোনো পর্যন্ত। অন্তত আমার তাই মনে হয়। প্রেম/ভালোবাসা আসলে এটাই যেটা নাগালের মধ্য থেকে, চোখের সামনে থেকে সবেগে চলে যায়, ধরে রাখা যায় না। যতই তাকে ডাকো সে থাকবে না। থামবে না। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে না ওই যে ‘যেও না যেও না ফিরে/ দাঁড়াও বারেক দাঁড়াও/ হৃদয় আসনে.../তোমায় ধরিতে চাহি ধরিতে পারি নে / তুমি গঠিত যেন স্বপনে........।’ ‘দোস্ত্ ঠিকই বলেছিসরে। আমি বুঝতে পারিনি। পাওয়ার পর যদি সে পুরনো হয়ে যায় তাহলে ধরাছোঁয়ার বাইরে সে চিরদিন নতুনই থাকুক। তবে তুই বললি না যে এটা একটা রোগ, একটা মায়া। আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘এটা মারাত্মক এক বায়বীয় রোগ। প্রত্যেকেরই আছে। এটাই দুনিয়ার ম্যাকানিজম। থাকতে হবে না থাকলে চলবে না।’ ‘ঠিক। দারুণ আবিষ্কার!

উফ্ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আমেরিকাতেই চলে যাবো। জীবনের তো অনেক অধ্যায় থাকে। অলিভিয়াকে ভালো লাগে, হয়তো ভালোবাসিও একটা অধ্যায় হিসেবে থাকুক।’ তাজু ঠিকই কলেজ পাশ করার পর আমেরিকাতে চলে গেছে। যাওয়ার আগে খুব মন খারাপ করেছিল। কলেজ ভবনের আড়ালে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল তাজু। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারিনি। এরপর অলিভিয়াও ঢাকায় চলে যায় এবং মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। সেদিন সন্ধেবেলা ফিরে দেখি মানিক, স্বপন, বিষ্ণু, কিসলু, হানিফভাই ও সুমন্তদা মিলে তুমুল আড্ডা দিচ্ছে পার্কে বসে। আমাকে দেখেই হৈহৈ রৈরৈ করে উঠল সবাই। গতকাল রাত থেকে কোথায় ছিলি, একদম দেখা নেই ইত্যাদি অভিযোগ। আমি বললাম, ‘গতকাল ফিরতে দেরি হয়েছিল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা। তারপর খুব সকালে একটা কাজে বেরিয়ে গিয়েছিলাম কোটবাড়ি। এইমাত্র ফিরলাম।’ স্বপন আমার মুখে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে লাফিয়ে উঠল, ‘আবে ছালা! ঘটনা বিলকুল খারাপ! তোর মুখে সিগারেটের গন্ধ করছে! তাজু দিয়েছে না?’ আমি মাথা নেড়ে নিঃশব্দে সায় দিলাম। এবং প্যান্টের পকেট থেকে ৫৫৫ এর একটি প্যাকেট বের করতে সবার চক্ষু চড়ক গাছ! বললাম, ‘চমকাবার কিছু নেই। এটা তাজুই উপহার দিয়েছে। সবাই টানি চল্। তবে এই জায়গাটা রিস্কি কারণ বাবা এই পথে হেঁটে বাসায় যায়।’

আমরা পরে সরে গেলাম অন্যস্থানে। কিছুক্ষণ পর হানিফভাই, সুমন্তদা ও কিসলু চলে গেল প্রফেসর পাড়ার দিকে। তারপর বিষ্ণু ও মানিক। রয়ে গেলাম আমি ও স্বপন। স্বপন খুব বুদ্ধিমান ছেলে, যে কোনো ব্যাপারেই তার দৃষ্টি ফাঁকি দেয়া মুশকিল। বললো, ‘মামু, এই একটা মাস খুব ব্যস্ততা গেছে। গান শোনা হয়নি। একটা গান শোনাও।’ বলে সে ঘাসে শুয়ে পড়লো। অদূরে ধর্মসাগরের জল ছলাৎ ছলাৎ করে এসে পাড়ে বাড়ি খাচ্ছে। আমি ভালো গাইতে না পারলেও বন্ধুদের অনুরোধে প্রায়ই গাই। সকালের রবীন্দ্রসঙ্গীতটা গাইলাম। স্বপন উঠে বসে বললো, ‘মামু, বড় দরদ দিয়ে গেয়েছো। এমন দরদ দিয়ে আর কখনো এই গানটা গাওনি। কিছু হয়েছে কিনা বলো দেখি। গতকাল থেকে তুমি হাওয়া। আবার সিগারেট খাওয়া ধরেছে আজ থেকে।

আমাদের অনেক আবদার, অনুরোধ তুমি এতদিন ফিরিয়ে দিয়েছো। তুমি শুকনো টানবে না, তরল গিলবে না, তুমি যেন দুনিয়ার মস্তবড় সতীসাধ্বী পুরুষ!’ আমি বললাম, ‘এবার থেকে সব করবো। পৃথিবী বৈচিত্র্যময় তার স্বাদ না নিলে কীভাবে হবে? শুকনো-টুকনো থাকলে দে একটা টানি।’ অবাক স্বপন! উঠে বসে বললো, ‘সত্যি সতীত্ব ভাঙবি!’ ‘কেন? অবাক হওয়ার কী আছে! আমি কি মানুষ নই, আমি কি জড়পাথর, নাকি পুকুরের কাছিম যে কোনো সুখ-দুঃখবোধ থাকবে না?’ ‘ঠিক আছে আগামীকাল ব্যবস্থা করবো। খবরদার কাউকে বলা চলবে না। গভীর গোপন ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎ করে এই পরিবর্তন কেন তোর? কী হয়েছে বল্ দেখি?’ স্বপন নড়েচড়ে বসলো। ‘কোথায় পরিবর্তন দেখলি? আমি তো নিত্যকার আমিতেই আছি। নেই? কী আর হবে?’ ‘কি জানি বাবা। আবহাওয়া ভালো মনে হচ্ছে না। যাকগে, কিছু হলেও তোর নিজস্ব ব্যাপার।’ ...চলবে

আলোকচিত্র : বামে, ধর্মসাগর পাড়ের সেই রাস্তা, রাস্তা আছে শুধু মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন। ডানে, ধর্মসাগর উদ্যান যেখানে প্রতিদিনই আমাদের আড্ডা বসত।


লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ২০, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test