E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১২

২০১৪ জুলাই ২২ ১৮:০১:২৮
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১২

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

গেট দিয়ে বেরিয়েই একটি রিক্সা নিয়ে সোজা নানুয়া দীঘির কাছে নামলাম। আকাশে চাঁদ। পূর্ণ গোলাকার না হলেও অন্তঃসত্ত্বা বলা যায়। স্বচ্ছনীল আকাশ। তারারা ঝিকিমিকি আলো ছড়াচ্ছে। দারুণ উদাস করা বাতাস। ঘাটের সিঁড়িতে বসে একটি সিগারেট ধরালাম। দেখলাম ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে চাঁদটি। আনন্দ, বেদনা, বিষাদ, স্মৃতিকাতরতা মিলিয়ে বিমিশ্র এক অনুভূতি ঝুলে আছে বুকের ভেতরে। দেখা হলো শেষ পর্যন্ত শিখার সঙ্গে প্রায় সাত বছর পর। বড্ড স্বল্পায়ু এক সাক্ষাৎ। কিন্তু বড়ই মধুর এবং মহার্ঘ হয়ে থাকবে এই জীবনে। এই দুর্লভ প্রাপ্তির সকল কৃতিত্ব শুধুই বাবার। বাবা না বললে মা আমাকে নিয়ে যেতো না। আর বিয়ের দিন দেখা হলে কী এমন মধুর হতো এই সাক্ষাৎ, সেটা হতো এক তরফা বিষাদপূর্ণ একটি ঘটনা।

বাবা কীভাবে আমার মনের কথা পড়েছিল আমি জানি না, শুধু মনে হয়েছে বাবা দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে অদৃশ্যমান কিছু দেখারও শক্তি রাখে। এটা সবার হয় না। মনে মনে বাবার প্রতি আনত কৃতজ্ঞতায় শতকোটি প্রণাম জানালাম। যথারীতি বিয়ের দিন ছোটভাই ও ছোট দুবোনকে নিয়ে গেল মা। আমাকে সঙ্গে যেতে বললো কয়েকবার, আমি গেলাম না। কোথাও বেরও হলাম না। নিজের ঘরে অন্ধকারে শুয়ে নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম একটি পুরো রাত। রেকর্ড প্লেয়ারে মিহি শব্দে অনেকবার শুনলাম সুবীর সেনের সেই গানটি। যে গানটি শতদলদা প্রায়ই গুনগুন করে গাইতো। একবার বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘কী সব ছ্যাকের গান গাও! আর কোনো গান জানো না?’ শতদলদা মুচকি হেসেছিল সেদিন। আজ সেই গানটি আমার জীবনেই ফিরে আসবে কে জানতো! কেউ জানলো না সেই নির্জন রাতে সুবীর সেনের ‘চন্দন আঁকা ছোট্ট কপাল / মাঝখানে টিপ কুম কুম লাল / তুমি কত সুন্দর / লালচেলি আর সানাইয়ের সুর/ মাথায় নতুন টিকলি ময়ূর / তুমি কত সুন্দর/ শুধু আজ থেকে তুমি অন্যের / শুধু আজ থেকে তুমি অন্যের.......।’

গানটি কেন, কার জন্য, কিসের জন্য শুনেছিলাম? পরের দিন সকালে যখন জলখাবার খাচ্ছিলাম, বাবা এসে বললো, ‘গতকাল তুমি যাওনি শিখার বিয়েতে?’ আমি মুখ না ফিরিয়েই বললাম, ‘না।’ নরম কিন্তু ব্যথিতকন্ঠে বাবা বললো, ‘কেন?’ আমি উত্তর না দিয়ে মনে মনে সেদিন শোনা বাবার কথাগুলো ফিরিয়ে দিলাম, ‘সব কেন’র উত্তর দেয়া যায় না বাবা। কিছু কিছু কেন’র উত্তর তো তুমি নিজেই জানো। আমাকে আবার বাজিয়ে দেখছো কেন?’ বাবা উত্তর না পেয়ে ফিরে যেতে যেতে আপন মনেই অস্পষ্ট স্বরে বললো, ‘বড় তাড়াতাড়ি মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল!’ কিসলুরা চলে যাওয়ার পর পাড়াটি কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেল কিছুদিনের জন্য। চাঁদের হাটের সকল উৎসাহ আর উদ্দীপনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কিসলুরা। দুটো ঘটনাই অকস্মাৎ ঘটাতে দারুণ বিধ্বস্ত হলাম আমি মনে মনে। চাঁদের হাটের কর্মকান্ড কিছুটা থিতিয়ে গেল, অনেক বেশি নিভে গেলাম আমি। তবে কিছুদিনের মধ্যে হানিফ সংকেতের উদ্যোগে আবার প্রাণ ফিরে এলো। এরপর যত সভা হতো সবই মানিকদের বৈঠকখানায়। মাঝে মাঝে ছোটখাটো সভার জন্য আমার ঘর। বাবা একদিন বললো, ‘তোমাদের অনুষ্ঠান আর হচ্ছে না কেন? কিছু একটা করো।’ তারপর জাতীয় দিবসে স্টেডিয়ামের কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করা, পাড়ার মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা আবার প্রফেসর পাড়ার সঙ্গে যৌথভাবেও টাউনহলে অনুষ্ঠান করেছি।

যথারীতি বাবা চাঁদা দিয়ে উৎসাহিত করেছে। সাহিত্য সংকলন, দেয়াল পত্রিকাও প্রকাশ অব্যাহত ছিল। ঢাকায় গেলাম চাঁদের হাটের জাতীয় সম্মেলনে। বাবা টাকাপয়সা তো দিলই, মালামাল নিয়ে ট্রেনে পর্যন্ত তুলে দিয়ে এসেছে। এমনটি আর কোনো অভিভাবক করেননি আমার দেখা ও জানামতে। একদিন কলেজের ক্যান্টিনে বসে জিন্সের প্যান্টে ডান হাঁটুর উপর অংশে বলপেন দিয়ে ঘষে ঘষে মোটা নীল অক্ষরে লিখলাম: ‘শিখা জ্বলে মনে!’ হিট হয়ে গেল এটা শহরে। ছাত্রদের কাউকে কাউকে দেখলাম তাদের প্যান্ট, টিশার্টেও তাদের পছন্দানুযায়ী বাক্য বা প্রিয় কবিতার পঙক্তি লিখছে। যে কেউ একবার তাকাতোই আমার প্যান্টের দিকে। অনেকেই মন্তব্য করলো, ‘ইয়াংদের এ এক ফ্যাশন আর কি!’ কেউ কেউ বললো, ‘কবি-সাহিত্যিকদের কত রকমের খেয়াল যে হয়!’ বন্ধুরা বললো, ‘দোস্ত্ রহস্যটা কী!’ শিখার আমার অপরিণত সম্পর্কটা রহস্যই রয়ে গেল। হয়তোবা মিলিয়েই গেল স্বপ্নের মধ্যেই। শুধু বাবা দেখে বললো, ‘প্যান্টের উপর ওটা কী লিখেছো?’ আমি কোনো জবাব দিলাম না। পাশ কেটে চলে যেতে যেতে শুনলাম, ‘আমিও এমনটি ধারণা করেছিলাম। ......তবুও বলবো, একটা জীবন শুধু একজনের জন্য নয়, অনেকের জন্য, সবখানে সেটাকে ছড়িয়ে দাও, তোমারই ভালো হবে.....তারুণ্যের প্যাশন থাকা ভালো, কিন্তু অর্থহীন ফ্যাশন যেন না হয়ে যায় খেয়াল রেখো।

লাইফ ইজ ভেরি ভেরি প্রিসিয়াস থিং!’ বাবার অনেক কথাই দার্শনিকমনস্ক। কী তার অর্থ, ব্যাখ্যা সেই বয়সে বুঝতে পারিনি আজকে মনে হয় মানুষটার অনেক কিছুই চেনা হয়নি, জানা হয়নি আমার তরুণ বয়সে। গদ্য লেখার সাধনা শুরু করেছিলাম। সেটা এবার কুঁড়ি থেকে কুসুমে পরিণত হলো। ‘মিঠুর স্মৃতি’ নামে একটি গল্প লিখে পাঠিয়ে দিলাম রাজশাহীর ‘দৈনিক বার্তা’র ঠিকানায়, মাহমুদ আনোয়ার হোসেন ওরফে বুড়োদাদুর কাছে। শাপলা-কুঁড়ির আসরে দ্রুত ছাপা হয়ে গেল। ডাকে পেলাম কাগজ, বুড়োদাদুর অভিনন্দনপত্রসহ। উফ্ সেকি আনন্দ! এই প্রথম চলতি ভাষায় শুদ্ধ করে গল্প তথা গদ্য রচনা করতে সক্ষম হলাম। বাবা পড়ে মহাখুশি। বন্ধুরাও। কলেজে গেটের কাছে একদিন আবু হাসান শাহরিয়ার তার ফ্যাশনাবল্ সাইকেল থেকে নেমে বললো, ‘অভিনন্দন গল্পকার প্রবীর বিকাশ সরকার!’ সম্ভবত আমার প্রজন্মের ছড়াকারদের মধ্যে প্রথম গল্প রচনা করেছিলাম আমি। অনেক পরে ছড়াকার কেউ কেউ গল্প লিখেছেন। ধারাবাহিকভাবে ‘কিশোরবাংলা’তে লিখলাম বড় একটি গদ্য: ‘রবিঠাকুরের মেঘবাদলের পদ্য’ নামে বর্ষাবিষয়ক কবিতার আলোচনা। এরকম রচনাও একই প্রজন্মের কেউ লিখেছে বলে জানা নেই। বাবা সেটি পড়ে বললো, ‘লিখে যাও। যা মনে ধরে। এখন তোমার ওঠার সময় যা লিখবে সেটাই তোমার প্রচারের কাজে লাগবে।’

এমনভাবে উৎসাহ দিয়ে উদীপ্ত করেছেন ক’জন লেখকের পিতা আমার জানা নেই বাংলাদেশে---যে দেশে লিখে জীবন চালানো যায় না। বাবা কী জানতো না সে কথা, আলবৎ জানতো। তারপরও কেন উৎসাহ দিত তার কারণ আজও রহস্যময়। শিখাবিষয়ক সিনড্রোমটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হঠাৎ একদিন হিম হিম ভোরে শুনতে পেলাম আতা গাছ থেকে নাম না জানা এক পাখির সুমধুর শিস। হয়তো দোয়েল পাখি হবে ভেবে চোখ মেলে তাকালাম মাথার উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে। উঠে বসে জানালা খুলে যার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল সে এক কিশোরী যাকে এই জনমে আর কখনো দেখিনি! হালকা নীল ও হলুদ রঙের বড় বড় ফুলতোলা তাঁতের শাড়ি পরা। একই কাপড়ের ঘটিহাতা ব্লাউজ। মাথায় মহাদেবের মতো চূড়াখোঁপা। কাজল টানা বড় দুটি চোখ, দীর্ঘ নাক, কপালে লাল টিপ, কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। নগ্ন চরণ। একি! কে এই কুমারীদেবী বলে মনে মনে অস্ফুট শব্দ করলাম! চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে আড়ালে চলে গেল। সে আর শুক্লা কথা বলছিল। মেয়েটি যখন আড়ালে চলে গেল তখন শুল্কা আমার ঘরের জানালার দিকে তাকালো। আমি আবার শুয়ে পড়লাম। তখন সরস্বতী পুজোর মাত্র কয়েকদিন বাকি। আমরা এই প্রথম পুজো করবো আমাদের বাসা ও শুল্কাদের বাসার মাঝখানের প্রাঙ্গণে। আয়োজন চলছে জোরেসোরে। আজকে বিকেলে মন্ডপ তৈরি হবে।

প্রতিমা তৈরি হচ্ছে চকবাজারের কোথায় যেন তার দায়িত্ব বিষ্ণু আর শতদলদার। মন্ডপের নকশার দায়িত্ব শ্যামলদা আর স্বপনের। কী যে উৎসাহ তখন আমাদের! সবচেয়ে উৎসাহ বেশি দেখলাম বাবার। যে মানুষটা কোনোদিন ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস রাখে না। যাঁর চিন্তায় ধর্ম একটি স্রেফ সংস্কৃতি নিজে চাঁদা তো দিচ্ছেই অফিসের কলিগ এবং পরিচিত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদার ব্যবস্থা করে দিল। নাম না জানা মেয়েটির সেই উজ্জ্বল মুখমন্ডল আর সরে যেতে চাইলো না আমার মন থেকে। সেইদিনই খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বিষ্ণুর কাছ থেকে যে সে আমাদের এক ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর পিসাতো বোন। নাম ‘গ’। কোনো এক হিন্দুদেবীর নামে নাম। অন্য পাড়ায় থাকে, এপাড়ায় বেড়াতে আসে মামার বাসায়। দশম শ্রেণীর ছাত্রী। একটি ছড়া লিখে ফেললাম। অনেক পরে সেটি ‘কিশোরবাংলা’র বর্ষা সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেটাতে মেয়েটির নাম ছিল। এই নিয়ে ‘গ’র মামাতোভাই অর্থাৎ আমার ঐ বন্ধুটির না ভালো-না মন্দ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি। তবে ‘গ’ এর বড়ভাইটি নাখোশ হয়েছিল। স্বপন বললো, ‘এই নামে অন্য কোনো মেয়েও তো হতে পারে!’... চলবে

আলোকচিত্র : বামে, নানুয়া দিঘি, ডা. নিত্যহরি সাহা নেই, শিখারা চলে গেছে অনেক আগে, দিঘিটি তেমনি আছে। ডানে, ডিগম্বরীতলা যাওয়ার রাস্তা, এখনো এই পথে হাঁটতে গেলে মন বড় কেমন করে!


লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ২২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test