E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১৩

২০১৪ জুলাই ২৩ ১৭:২৬:৪৬
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১৩

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

বন্ধুরা যা বোঝার তো বুঝে গেলই আমার আচরণে। পুজো হলো ঘটা করে। দারুণ আনন্দ হয়েছে যেমনটি মুক্তিযুদ্ধের আগে শিখাদের সঙ্গে হয়েছিল। ‘গ’ এসেছিল দুদিন বেশ সেজেগুঁজে। দারুণ লাগছিল! মনে হচ্ছিল উদ্ভিন্ন আগুনের দুর্গা প্রতিমা! ছুঁতে গেলেই দগ্ধ হয়ে যাবে স্বয়ং শিবের আঙুল। আমি তো কোন্ ছাড়! আবার যে চোখাচোখি হয়নি কয়েকবার তা নয়, হয়েছে খুব সংগোপনে। পুজোর সময় বাবা শুধু একদিন সন্ধেবেলা বাসায় ছিল এবং উপভোগ করেছে আমাদের নাচ ব্যাস্ এই পর্যন্ত। পূজোর বাজেট থেকে বেশ কিছু পয়সা বেঁচেছিল, ঠিক বাঁচা নয়, বিষ্ণু বাঁচিয়ে ছিল কীভাবে কে জানে। জাত ব্যবসায়ীর ছেলে বলেই সম্ভব হয়েছিল। তার ল্ক্ষ্যই ছিল এটা যে, পুজোর পরে একটি পুনর্মিলনী করবে। সেই মোতাবেক এক রোববারে সকাল থেকেই মহাসমারোহে যেখানে মণ্ডপ তৈরি হয়েছিল সেখানে মাটি খুঁড়ে চুলো বানিয়ে রান্নাবান্না হলো। মুরগি, খাসি, বিভিন্ন মাছ, নিরামিষ কি না ছিল! ছেলেমেয়ে সবাই মিলে রান্না করেছি।

মাঝে মাঝে মেয়েদের উপর কাজের ভার ছেড়ে দিয়ে পার্কে গিয়ে লুকিয়ে ডোপ চললো সঙ্গে মৃতসঞ্জীবনী সুধা। সন্ধেবেলা সবাই মিলে খেলাম। পাড়ার বড়ভাই ও বন্ধুবান্ধবী সবাই এসেছিল। বাবাও যোগ দিল। ‘গ’ও এসেছিল। শাড়ি পরেই এলো। আহা, সেকি মাধুরী তার পেলব জোছনার মতো গলে গলে পড়ছিল! সামনাসামনি তার কোজাগরী রূপ দেখে বিমোহিত হলাম। কিন্তু কোনো কথা হলো না। মেঘদূতের ছিল মেঘ আর আমার বাসন্তী হাওয়া। বাতাসের মাধ্যমে বললাম, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’ তার কণ্ঠ থেকে উত্তর বাতাসে যেন ভেসে এলো, ‘আশেপাশেই তো ছিলাম, তুমি যে শিখার আগুনে চোখ পুড়িয়েছো তাই দেখতে পাওনি আমাকে!’ বিষয়টি দ্রুত জানাজানি হয়ে গেল আমারই দুর্বল আচরণের কারণেই। দুঃসাহসী বন্ধু বাকের ও রীপ বললো, ‘দোস্ত্ একটি কালিদাসী চিঠি লিখে দে, ওর বুকের চিলেকোঠায় পোস্ট করে আসি। বন্ধুর জন্য ‘হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান’ হয়ে কাজ করবো। সত্যি ঊর্বসী কাকে বলে! দোস্ত্ তোর দৃষ্টির প্রশংসা করতে হয়। তোর টেস্টই আলাদা মাইরি বলছি!’ রাজিও হয়েছিলাম একটি চিঠি লিখে দেবো বলে। শয়নে-স্বপনে দেখতাম মেয়েটি আমার টেবিলের চারপাশে যেন ঘুরছে। আমাদের উঠোনে এসে শাড়ির আঁচল গুঁজে এক্কাদোক্কা খেলছে আমার ছোটবোনের সঙ্গে। সর্পিল বেণী দুটো এদিক-সেদিক নড়ছে।

জানালার কাছে এসে নিচুকন্ঠে বলছে, ‘ভোর হলো দোর খোলো/ খোকাবাবু ওঠোরে/ শিউলি খোঁপার ঘ্রাণ/ মন ভরে লোটোরে।’ একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম, সে বাবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে, ‘পটুদা ভারি লাজুক, হাত বাড়িয়ে দিলেও ধরতে চায় না!’ বাবা বলছে, ‘তার হাত তো কবির হাত, সহজে পাওয়া যায় না।’ জেগেে উঠে দেখতাম কোথাও কেউ নেই! এভাবে কয়েক মাস গত হলো। সামনে পরীক্ষা। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যাবে না। তাই পাগলামি বন্ধ করে দিয়ে সবাই দিনরাত পড়ি। সকাল-বিকেল খুব একটা আমরা বেরোই না, আড্ডাও দিই না। বাবার সিলেটে যাওয়ার দেরি হয়ে গেল কোনো এক কারণে। একদিন বললো, ‘তোমরা হৈচৈ করো না তাই পাড়াটা মনে হয় বদলে গেছে। আমারও এবার কুমিল্লা ছাড়ার সময় এসে গেল। তুমিও পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। আস্তে আস্তে আমাদের দূরত্বটা বাড়তে থাকবে। সাবধানে থেকো, ভালো করে পড়ালেখা করো। ভাইবোনদের দিকে নজর রেখো। তুমিই তাদের ভবিষ্যতের ভরসা। গতকাল বিকেলে শিখার ভাই স্বপন এসেছিল অফিসে একটা কাজে। তুমি বিয়েতে যাওনি বলে খুব দুঃখ করলো। ওরা তোমাকে খুব ভালোবাসে। ওরা আগামী মাসেই ঢাকা চলে যাচ্ছে বললো।’ বুকের ভেতরে হঠাৎ করে বিরহী সুরে বেহালা বেজে উঠলো। বন্ধ করে দেয়া জলসা ঘরের দরজাটা আবার খুলে দিল বাবা। বইয়ের পৃষ্ঠায় লেপ্টে থাকা মনোযোগটা ছিঁড়ে গেল। সেই রাতেই মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কান্দিরপাড়স্থ ফিলিপ্সের দোকানে গিয়ে ফিরোজা বেগমের রেকর্ড আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। গানের লিস্ট দেখে বললো, ‘এখানে পাবেন না স্টেডিয়ামে পাবেন।’ রিক্সা নিয়ে সেখানে গিয়ে মেজর সাহেবের ইলেট্রনিক্সের দোকানে পেলাম একটি রেকর্ড। যে গানটি চেয়েছিলাম সেটি ছাড়াও আরও তিনটি গান ছিল যতখানি মনে পড়ে, ‘মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম’, ‘আমি চাঁদ নহি---চাঁদ নহি অভিশাপ’, ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে।’ গভীর রাতে অন্ধকারে লুলুমুন্ডিতে বাজলো মিহি শব্দে, ‘গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙে যায়/ কে যেন আমারে ডাকে/ সেকি তুমি/ সেকি তুমি.........?’ এই প্রথম সমস্ত হৃদয় দিয়ে এমন একটি বেদনা অনুভব করলাম যার কোনো রং নেই, স্বাদ নেই, গন্ধ নেই কিন্তু আগুনে পোড়া জ্বালাযন্ত্রণার মতো ধিকি ধিকি জ্বলে। সত্যিই শুধু প্রেম নয়, মানবিক সম্পর্ক নয়, বিরহ-বেদনা নয়, গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলে নজরুলের প্রতিটি গান অবচেতন স্বদেশপ্রেমের ঘুমও ভাঙিয়ে দেয়। গানটির যে কত রকম অর্থ হতে পারে এবার বুঝলাম।

সেদিন বাবা যা বলেছিল সেই কথার মর্ম বুঝতে আর কোনো কষ্ট হলো না। কাজী নজরুল যে সত্যিই কত বড় জীবনঘনিষ্ঠ কবি ছিলেন খুব কম মানুষই তাঁকে বুঝতে পারবে, বাবার উপলদ্ধিকে বার বার প্রণাম জানালাম। পরীক্ষা ভালোই হলো। ব্যস্ত থাকলেও ‘গ’ কিন্তু মন থেকে মুছে গেল না। এর মধ্যে সে একদিনও আসেনি। এবারও বরাবরই অঙ্ক পরীক্ষা তেমন ভালো হলো না। এর মাঝে বাবা সিলেট থেকে এলো অফিসের কাজে কুমিল্লায়। কয়েকদিন ছিল। কী মনে করে বাবার সঙ্গে সিলেটে গেলাম। নদীর তীরে বালাগঞ্জ থানার ভিতরেই বাবার থাকার ঘর। এক রাত ছিলাম বাবার সঙ্গে---সেই ছেলেবেলার পর। তারপর সপ্তাহ খানেক ছিলাম সিন্দ্রাকোণা গ্রামে। শেষবার এসেছিলাম ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে। ভেবেছিলাম সরমা আছে ভালোই কাটবে সময়টা। ওকে নিয়ে অনেক দূরে জগন্নাথবাড়ি যাবো। সেখানে আমার এক পিসি আছে। জায়গাটা খুব সুন্দর। বর্ষায় একবার গিয়েছিলাম। অতীত দিনের পুজোর ঘন্টার ধ্বনি শুনতে পেলাম যেন। কিন্তু সরমা ছিল না। রাঙ্গাপিসি, রেণুদি আর সরমা গেছে বিয়ানীবাজার আমাদের সবচেয়ে বড় জেঠাতো বোন প্রভাসদির বাড়িতে বেড়াতে। কবে আসে ঠিক নেই বললো জেঠিমা। কী আর করা। মনটা অস্থির হয়ে পড়লো।

বাবাকে বলে চলে এলাম কুমিল্লায়। আসার আগের দিন বাবা কাজের লোকটাকে বলে শর্ষের ইলিশ, টাকিমাছের ভর্তা, পাবদা মাছের চচ্চড়ি, মুগের ডাল ইত্যাদি রাঁধালো। চমৎকার রাঁধলো বটে! সব মাছই থানা সংলগ্ন কুশিয়ারা নদীর জলজ ফসল। কুমিল্লায় এসে বেকার হয়ে পড়লাম যদিও লেখালেখি চলছিল। প্রতিদিন আড্ডা আর আড্ডা, পার্কে না হয় কলেজের ক্যান্টিনে। মাঝে মাঝে সাহিত্যপাঠের আসরে। বাইরে থাকলে অনেক কিছুই ভুলে থাকি। রাতে বাসায় ফিরলে কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ি। কেবল ঘরবার করি। সিগারেট ফুঁকি। সিগারেট যে টানি সেটা বাসার সবাই জেনে গেছে। শুধু সিগারেটই নয়, ডোপ, ড্রিঙ্ক করা সম্বন্ধেও বাবা-মা অবগত। আমিও নির্ভার হলাম। মাকে বললে আমার সিগারেট কিনে নিয়ে আসে এই অবস্থা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে। বন্ধুরা তো ভাবতেই পারে না! আসলে মার ইচ্ছে আমি যাতে বাইরে না যাই। গত বছরের শেষ দিকে অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমি, মঞ্জু পাটোয়ারী, বিষ্ণু, স্বপন ও মানিক মিলে মঞ্জুর ঘরে বাংলা মদ এবং চট্টগ্রাম থেকে বাবুলভাই নিয়ে এসেছেন বিখ্যাত ‘ভুইল্যা’----খেলাম এবং টানলাম। এমন নেশা হয়ে গেল যে, হাসলে তো হাসি, কাঁদলে কাঁদতে থাকি। প্রায় উন্মাদ। বাংলা মদ পান করার পর খাসির মাংশ খেতে দারুণ স্বাদ। মঞ্জু বললো, ‘এক স্যারের জায়গা দালালি করে বিক্রি করে দিয়ে কিছু টাকা পেয়েছি। চল্ খাসির মাংশ খেয়ে আসি। চকবাজারে রূপালি সিনেমা হলের কাছেই পুলিশ ফাঁড়ির সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্ট আছে। দারুণ রান্না করে!’ বলতেই হু্ররে বলে দুটি রিক্সায় চেপে রওয়ানা দিলাম আমরা। গিয়ে বসলাম অর্ডার দিয়ে।

সময়মতো চলে এলো সুবাস ছড়িয়ে গরম মাংশের থালা পরোটাসহ। খাচ্ছি বেশ হাসিখুশির সঙ্গে। মঞ্জু এটা সেটা বলে বেশ হাসাচ্ছে। হাসির দমকে মানিক দাঁড়িয়ে পড়ছে। আমি বললাম, ‘মঞ্জু বিচিয়ে দ্যাখতো থালাটিও মনে হয় খাসির মাংশ দিয়ে তৈরি।’ বলতেই এমন হাসির রোল উঠলো যে বিষ্ণু হাসতে হাসতে দোকানের বাইরে চলে গেল একটি হাড় হাতে নিয়ে। ঝালের ঝাঁঝ গিয়ে উঠেছে স্বপনের মগজে সে মাটিতে বসে মাথা চাপড়াচ্ছে। মানিক চলে গেছে বেসিনের কাছে কাশতে কাশতে। সে কী এক অবস্থা! আমিও হাসতে হাসতে প্লেটে মাথা ঠেকিয়ে ফেলেছি। দোকানের কিছু কাস্টমারও হাসছিল। আমার পাশের বেঞ্চিতে চারজন পুলিশ সিভিল ড্রেসে মাংশ খাচ্ছিল, মুখ থেকে ভুর ভুর করে বেরোচ্ছে নির্জলা বাংলা মদের স্পিরিটের দুর্গন্ধ তারাও হাসতে লাগলো কিছু না বুঝেই। যাহোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে খাওয়া শেষ করলাম। হাত ধুয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরালাম সবাই। পুলিশগুলো এতক্ষণ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে আমরা মাতাল। যেই সিগারেট ধরালাম তারা নড়েচড়ে উঠলো, মনে করেছে আমরা এখনো স্কুলের ছাত্র। একজন কঠিন মুখ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘ছাত্র নিকি ভায়েরা?’ বিষ্ণুটা বরাবরই ঝগড়াটে এবং কারো কোনো কথারই সোজা উত্তর দেয় না, ঘাড়তেড়া, বললো, ‘সন্দেহ আছে নিকি?’ তার কথার জবাবে পুলিশগুলো কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পরে আমার কনুইটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পেছনে বসা একজন পুলিশের ঘাড়ে লেগে গেল।

আমি ‘সরি’ বলার পরেও এমনভাবে কটমট করে তাকালো আমাদের দিকে যে বিষ্ণুর আর সইলো না। বলে উঠলো, ‘ভাই, এমন কইরা দেইখ্যেন না, ডর লাগে।’ এই কথা শুনে পুলিশটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল আমি তার কাঁধ ধরে চাপ দিয়ে বললাম, ‘ভাই আপনারা যে গোয়াল থেকে এসেছেন আমরা সেই গোয়ালেরই লোক।’ আর যায় কোথায়? ব্যাস্ বেঁধে গেল বিষ্ণুর সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি। সে তেড়ে উঠে বললো, ‘ওই মিয়া খারাপ কইছে নিকি, চিনছেন কার লগে লাগছেন?’ আমার দিকে আঙুল তুলে বললো, ‘আপনাগো বস কোর্টের জিআরও পরেশবাবুর পোলা।’ শুনে আর কোনো কথা না বলে বসে পড়লো লোকটি, তারপর একজন হেসে বললো, ‘আরে ভাই এটা আগে কইবেন না? আমরা কি আপনাগো পর নিকি? ওই মাইন্ক্যা চা লাগা এখানে।’ পরের দিনই রেজাল্ট পেয়ে গেলাম। সাধারণত বাবার পরিচয় কোথাও আমি দিই না। বিষ্ণুটা বলে ফেলেছে কী আর করা। রাতে বাসায় ফিরেই বাবা আমার ঘরে এসে বললো, ‘গতকাল চকবাজারে ফাঁড়ির পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলে কেন?’ আমি বললাম, ‘কার কাছ থেকে শুনলে?’ ‘কেন? ওরাই বললো সকালে। তোমরা নাকি অ্যাবনর্মাল ছিলে?’ আমি বললাম, ‘অ্যাবনর্মাল ছিল ওরা, আমরা ছিলাম অসুস্থ তাই কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছে।’ বাবা আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে শুধু বললো, ‘ও।’ এর পর আরও বেশ কয়েকবার অভিযোগ করেছে বাবা, ‘শাসনগাছা মদের আড্ডায় গিয়েছিলে কেন রাতের বেলা? খাও। খেতে পারো।

এতে দোষের কিছু দেখি না। তবে এমন কাণ্ডকীর্তি করো না বিশেষ করে পুলিশের সঙ্গে তাতে ওরা মনে করতে পারে গার্ডিয়ান হিসেবে আমি দুর্বল। আমি এই শহরে কী পজিশনে আছি সে তুমি ভালো করেই জানো। আমি তোমাদের সবাইকে স্বাধীনতা দিয়েছি। ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমি নিজেও বিশ্বাসী সেটা তুমি নিজেও বোঝো। স্বাধীনতা মানে নিজের শক্তিক্ষয় আর মানুষকে হেয় করা নয় এটা স্মরণে রেখো।’ ঠিকই বলেছে বাবা। সাংঘাতিক সত্য কথা। আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম। বস্তুত আমরা বদলে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। নানা কারণেই। আর্থিক দৈন্যতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, চোখের সামনে সীমাহীন সামরিক স্বৈরাচারী শাসন-শোষণ, জাতির ভবিষ্যৎহীনতা তাছাড়া হৃদয়ঘটিত বায়বীয় সমস্যা তো আছেই এই বয়সে। এইসব হতাশাজনিত মনোরোগের সহজতম আশ্রয় বা উপশম হচ্ছে নেশা। অনেক সময় পয়সা না থাকলেও দেখেছি বন্ধুদেরকে কাশের ওষুধ ফেন্সিডিল সাবাড় করে দিতে।

এক পোটলা শুকনো পাতার আর কত দাম? কাশের ওষুধ খেয়ে নেশা করার মতো এত নিচে নামার ইচ্ছে আমার ছিল না। নামিওনি কোনোদিন। এর মধ্যে ‘গ’এর সঙ্গে দু/তিনবার দেখা হয়েছে। আমাদের বাসার সামনে দিয়েই বিনম্র পায়ে হেঁটে গেছে মামার বাসায়। হয়তো অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকিয়েছে আমার ঘরের জানালার দিকে। আমি খাটে হেলান দিয়ে লিখতাম বাইরের দিকে তাকিয়ে। যতবারই দেখতাম মনে হতো সে বেড়ে উঠছে, পুষ্ট হচ্ছে। মেদহীন, মসৃণ উদ্ভিন্ন আগুনের প্রতিমা। আমি অবশ্য আগের মতো আর অত উচ্ছ্বাস অনুভব করি না তাকে দেখে। তবে মাঝে মধ্যে একটা বুনো ঝড় ওঠে যখন রাতে হেমন্ত মুখার্জীর গানগুলো শুনি: ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি / সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি’ কিংবা ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই’ অথবা ‘সবাই চলে গেছে শুধু একটি মাধবী তুমি এখনো তো ঠিকই ফুটে আছো, কেন?’ ... চলবে

আলোকচিত্র : বামে, ধর্মসাগর পশ্চিম পাড় তখন এত বড় বড় দালান ছিল না। এই পথটি ডিসির অফিস হয়ে সোজা চলে গেছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ির সামনে নিয়ে বাদুরতলাস্থ বড় রাস্তা পর্যন্ত। ডানে, এরকমই ছিল এ পাড়ায় সরস্বতী পুজো আমাদের কৈশোর ও যৌবনের প্রথম দিকে, এখন এই পাড়ায় হিন্দু নেই বললেই চলে।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ২৩, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test