E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১৪

২০১৪ জুলাই ২৪ ১৯:১৯:৪৭
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১৪

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

বন্ধুরা বেশ হাসিঠাট্টা করে ‘গ’ এবং আমাকে নিয়ে। অথচ কোনো প্রমাণ নেই আমাদের সম্পর্কের। কথাই হয়নি এক বাক্য! কী করে বলি এ তো প্রেম নয়---এটা একটা মায়া। মহাতারুণ্যের মহামায়া, যেটা হাতের মুঠোয় থেকেও থাকবে না, স্বপ্নের মতো অস্পর্শিত থেকে যাবে। পেতে চাই না বলেই তো ভালোলাগে, পেলে কি ভালোলাগতো? বন্ধুরা বলে, ‘তোমার এইসব কাব্যদর্শন আমরা বুঝি কম। তুমি মজে গেছে সেটা বলো।’ আমিও অস্বীকার করিনি, ‘কেন করবো আমি কি চোর, নাকি অপরাধী? মানুষকে মানুষের ভালো লাগার উপাদান না থাকলে কী অবস্থা হতো পৃথিবীর ভেবে দেখেছিস? বিষ্ণুর স্ত্রী হতো একটি ছাগি, স্বপনের একটি গাভী, মানিকের মহিষিনী। তোদের সন্তানরা কী চেহারার হতো? ভাগ্যিস ঈশ্বর মানুষকে সেভাবেই তৈরি করেছিলেন বলে রক্ষে। পৃথিবীতে এখনো নরনারী সুন্দর আকৃতি আর মুখ নিয়ে জন্মায়। তাই, জয়তু প্রেম!’

রেজাল্ট বেরোলো আমাদের মধ্যে কে কি পেয়েছিল মনে নেই আমি সেকেন্ড ডিভিশন। মানইজ্জৎ রক্ষা হয়েছে বলে আত্মপ্রসাদে মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিন দুপুরেই আমি ও স্বপন শাসনগাছা গিয়ে আকণ্ঠ নির্জলা মেরে দিলাম। বাজারের কাছে চিকন একটি গলি আছে তার ভিতর ছোট্ট একটি খুপরি তাতে সকাল থেকে সারারাত ধরেই মাল টানা চলে। সস্তা মদ তাই গলা জ্বলতে জ্বলতে নিচের দিকে নেমে যায়। তারপর ভারী পা টানতে টানতে দুজনে শহর চষে বাসায় ফিরেছি। কতদিন তো খেয়ে উন্মাদ হয়ে আমি, স্বপন, বিষ্ণু, মানিক ও মঞ্জু বাসার ছাদেই ঘুমিয়ে পড়েছি রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনতে শুনতে। সকাল বেলা শতদলদা জল ছিটিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙিয়েছে। এটাও একটা আনন্দ ছিল বৈকি! বাবা জানতো এসব। কতদিন খাটের তলে খালি বোতল আবিষ্কার করেছে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ছোটবোন রীনা। কোনো-কোনোদিন শতদলদা বলতো, ‘পটু আজকে রেকর্ড প্লেয়ারটা নিয়ে এসো রাতে গান শুনবো।’ এর অর্থ মৃতসঞ্জীবনী, শুকনো পাতা, সিগারেট, বড়াভাজি, চানাচুর আর কাঁচা পেঁয়াজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। বাবা চিঠি লিখলো, ঢাকা না গিয়ে চট্টগ্রাম যেতে। ঢাকা হচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড যদিওবা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে চাকরি পাওয়া যায় না, অন্যগুলোর কথা তো বলে লাভ নেই। জেনেও সবাই ঢাকায় যেতে চায়। বাবার কথা উপেক্ষা করে ঢাকাতেই গেলাম। পণ্ডিত যেহেতু হতে চাই না তাই একটাতে ভর্তি হলেই হয়। তবে ইতিহাস পড়ার বাসনা যদি পরীক্ষায় টিকতে পারি। কিন্তু ঢাকার ইতিহাস বিভাগ তখন খুবই জনপ্রিয় বিধায় সীট পাওয়া কঠিন জানতাম। বাবার ইচ্ছে ছিল অর্থনীতি।

আমি বললাম, ‘ওটা তো ধারণাবাদীদের সাবজেক্ট। ওটা পড়ে গলাবাজির চর্চা হবে, মেধার চর্চা হবে না। মেধা না থাকলে আগামী পৃথিবীতে চলা যাবে না। এই বিশ্ব অর্থনীবিদরা চালায় না বাবা, চালায় মেধাবী ন্যাশনালিস্টরা, তাই ইতিহাস না পড়লে ন্যাশনালিস্ট হওয়া যাবে না। এ্যাকটিভিস্ট হতে হবে। তাছাড়া লেখালেখির জন্যও মেধা দরকার। ইতিহাস হচ্ছে মেধার খনি।’ বাবা যা বোঝার বুঝে গেল। আর কোনো শব্দ করলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ বিভাগের ওয়েটিং লিস্টে ছিলাম যতখানি মনে পড়ে। পরে ভেবে দেখলাম, এই শহরে বাস করা বড় টাফ্। কুমিল্লার চেয়েও ঢাকা নোংরা। রুচিবোধহীন মানুষের ছড়াছড়ি। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নরকের নাম ঢাকা। সূর্যসেন ও মহসিন হলে লতিফ মামার এক আত্মীয়র রুমে ছিলাম, আবার বন্ধু কুমিল্লার মফিজের কাছেও ছিলাম কিছুদিন ভর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র আমি। মানিক চট্টগ্রাম, স্বপন, বিষ্ণু, মঞ্জু ভিক্টোরিয়া ডিগ্রি কলেজে আর মঞ্জুর মোর্শেদ কুমিল্লা কলেজে। আমি সব ছেড়েছুঁড়ে চলে এলাম কুমিল্লায়। বাবাকে ফোন করলাম টি অ্যান্ড টিতে গিয়ে। চট্টগ্রাম যাবো বললাম। গিয়ে দেখি সীট খালি আছে কোথায়? লতিফ মামাকে বললাম।

তিনি পড়ালেখার বিষয়ে খুব উৎসাহী মানুষ। ইতিমধ্যে মানিকের বাবা কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম বদলি হয়েছেন। সরকারি বাসা পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই হাটহাজারি শহরে। বাসে যেতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানিকের বাবা ও মা আমাকে খুব স্নেহ এবং বিশ্বাস করতেন। চমৎকার হাসিখুশি মানুষ ছিলেন তাঁরা দুজনে। লতিফমামাসহ গিয়ে উঠলাম মানিকদের বাসায়। মানিক এসেই ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়েছিল ভালোভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে চায় কিন্তু বাবার নিষেধের কারণে সে তখন হলে আসতে পারেনি। আমি যখন সীট পেলাম আলাওল হলে তখন মাঝে মাঝে এসে থাকতো। বিশেষ করে এনুয়েল ফিস্টের সময়। কী যে আড্ডা হতো সন্ধে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত! ধোঁয়ায়, দুর্গন্ধে পুরো এলাকা দূষিত হয়ে যেতো। পরে অবশ্য ক্যাম্পাসের হলে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল মানিক। বলা প্রয়োজন একমাত্র লতিফমামার কল্যাণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার প্রায় তিন মাস পরে। কোথাও সীট খালি নেই। তিনি তাঁর এক বন্ধুর মারফত জানতে পারলেন ইতিহাস বিভাগে এখনো তিনটি সীট খালি আছে। অধ্যাপকদের জন্য বরাদ্দ। প্রতিদিন যাই বিশ্ববিদ্যালয়ে মানিকের সঙ্গে। তখনো তত অশান্ত হয়ে ওঠেনি ক্যাম্পাস। সবুজ ঘেরা পাহাড়ি পরিবেশ সত্যিই চমৎকার লাগলো আমার চোখে। ছাত্রছাত্রীরা বাস, গাড়িতে, শার্টল ট্রেনে করে ক্যাম্পাসে আসে।

কী উৎসাহ, কী উদ্দীপনা আর হৈহুল্লোড়ে মেতে আছে সবাই! কক্ষে কক্ষে ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যান্টিন, বারান্দা, গাছের ছায়া, শহীদ মিনার, পাহাড়টিলার আড়ালে, চায়ের স্টলে গুচ্ছ গুচ্ছ ছেলেমেয়েদের আড্ডা। এক কথায় দারুণ ভালো লেগে গেল আমার। ঢাকার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশ। ঢাকায় শহরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি হওয়ায় ক্যাম্পাসটি শিক্ষাঙ্গনের চেয়ে অফিস-আদালত জাতীয় ভাব, একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে কখনোই মনে হয়নি। এখনো মনে হয় না। এখন তো আরও গিঞ্জি, আরও নোংরা হয়েছে। বার্ধক্যের ছাপ সর্বত্র। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও সমস্যা ছিল, মৌলবাদী রাজনীতি, আঞ্চলিকতা, বাসস্থানের তীব্র সঙ্কট। তারপও নতুন একটি পৃথিবী আবিষ্কারের মতোই মনে হয়েছিল প্রথম প্রথম পরে তা ফিকে হয়ে আসতে থাকে একমাত্র মানুষ সৃষ্ট উন্মাতাল অস্থির রক্তয়ী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। আমি যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখানে প্রবেশ করবোই, তেমনি একদিন হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগামীকাল থেকে আর ক্যাম্পাসে যাবো না। অবশ্য এর অনেক পটভূমি এবং কারণও ছিল যার বিবরণ পরে আসছে। যাইহোক, আমি যখন ক্রমশ হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম তখন মানিকের বাবা গোলাম মোস্তফা চৌধুরী সাহেব অভয় দিয়ে বললেন, ‘পটু চিন্তা করো না। আমিও চেষ্টা করছি। তুমি এখানে ভর্তি হলে আমাদের জন্যও ভালো হবে।

মানিককে তুমি দেখে রাখতে পারবে ও যেরকম ক্রেজি রাজনীতিতে সত্যি আমার ভয় হয়!’ মামাও বললেন, ‘তুমি ক্যাস্পাসে ঘোরাঘুরি করো, আমি ব্যবস্থা করছি। হতাশ হয়ো না, এই দেশে হয় না এমন কোনো কাজ নেই। কারণ এদেশের মানুষের কোনো চরিত্র নেই। তোমার বাবাও খুব দুশ্চিন্তা করছেন। মানিকের বাবার অফিস থেকে ফোন করেছি কয়েক দিন। বলেছে যদি না হয় তাহলে এক বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর চেষ্টা করবে।’ কি আর করবো? আমি ক্যাম্পাসে ঘুরি, মাঝেমাঝে ইতিহাস বিভাগের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। বেশ স্মার্ট কয়েকটি মেয়েকে দেখে ভালো লাগে। সবাই দারুণ সতেজ, হাসিখুশি। অধ্যাপকরাও স্মার্ট বিশেষ করে ড.আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন কেম্ব্রিজ না অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলেন দেখতে ফর্সা একেবারে সাহেবসুবো মুখে পাইপ, তাঁর মহীয়সী স্ত্রী ড.আসমা সিরাজ পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মেয়ে নাকি, সাদা ধবধবে এবং অসম্ভব সুন্দরী; বেঁটে কিন্তু তুখোড় পড়ান নাকি এরকম একজন লেকচারার ড.শাহাদাত হোসেন; ক্যাম্পাসের প্রিয়মুখ লেকচারার হায়াত হোসেন তখন ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় দারুণ দারুণ তথ্যবহুল লেখা লিখতেন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে, ছোটগল্প লিখে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন; রাসগম্ভীর নরম প্রকৃতির মানুষ অধ্যাপক ড.সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়; অনুরূপ বিদ্বান ড.রফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। এসব নাম জেনে নিয়েছিলাম। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি উপমহাদেশের কতিপয় মুদ্রাবিশেষজ্ঞদের একজন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড.আবদুল করিম। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিয়োগ ছিল যেমন স্বাধীনতার বিরোধিতা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের তহবিল আত্মসাৎ, আঞ্চলিকতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি। কিন্তু চালচলনে খুবই সাধারণ অসম্ভব মেধাবী এই শিক্ষকের পড়ার স্টাইল ও জ্ঞান ছিল অসাধারণ। কোনো বই ফলো করতেন না। তাঁর খর্বাকৃতি গলার মধ্যে যেন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস ফিতের মতো পাকানো থাকতো, অনর্গল সেটা বেরিয়ে এসে আমাদেরকে জড়িয়ে ফেলতো। তাঁর বেশ কয়েকটি ক্লাস পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমাকে ক্রমশ শুষে নিচ্ছিল পাহাড়সংলগ্ন তিন তলার নিরিবিলি এই বিভাগটি। সর্বক্ষণ দারুণ বাতাস, ছায়া-ছায়া পরিবেশ, পাহাড়ি সবুজ হাতছানি আর কাসরুমগুলো আধুনিক এবং পরিচ্ছন্ন আবহ আমাকে রোম্যান্টিক করে তুলছিল ভর্তির আগেই।

স্বপ্নীল হয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। মামা ছিলেন খুব স্মার্ট এবং সাহসী। তিনি সাহেবসুবো সেজে একদিন ঢুকে গেলেন ইতিহাস বিভাগের অফিসে। জমিয়ে ফেললেন প্রধান ক্লার্কের সঙ্গে। তিনি কুমিল্লার লোক ছিলেন বলে মনে হয়। তাঁর কাছ থেকে জানলেন সত্যি সীট খালি আছে কিনা। সত্যতা পাওয়া গেল। তিনিই জানালেন ড.আরিফ মঈনুদ্দিন স্যারের ভাগে তিনটি সীট এখনো খালি আছে। ব্যাস্ হয়ে গেল কাজ। মামার এক পরিচিত লোক ছিলেন প্রশাসন অফিসে কুমিল্লা বাড়ি। নূরুর রহমান। পরে নূরুভাইয়ের সঙ্গেও আমার দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একটি ছেলে ইমরুল হাসানের সঙ্গে। জামাল খান রোডে থাকে, খুবই সুপুরষ একটি ছেলে, থার্ড ইয়ারের ছাত্র, জাসদ ছাত্রলীগ করত বলে মনে হয়, প্রতিশ্রুতিশীল। ইমরুলভাইয়ের পাড়াতেই থাকেন সহযোগী অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দিন। বিএনপিঘেঁষা হলেও উদারপন্থী সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন তিনি। আমার ভর্তির পরপরই অবশ্য তিনি আমেরিকা চলে যান। ইমরুলদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক আছে। বললো, ‘চিন্তা করবেন না। আমি স্যারকে রাজি করাবো। যেহেতু প্রবীরের আগ্রহ আছে এবং ইতিহাসে সত্তরের উপর মার্ক আছে, ইংরেজিতেও আশির কাছাকাছি নম্বর। কোনো পরীক্ষাও লাগবে না। মৌখিক পরীক্ষা দিলেই যথেষ্ট।’ তার কথায় আমার শুষ্ক অন্তরে বৃষ্টি নামলো। দুদিন পরেই ক্যাম্পাসে আমাদের খুঁজে পেয়ে বললো, ‘সব ঠিক। আরিফভাই প্রবীবের রেজাল্ট দেখে খুব খুশি।

আজকে বিকেলে ডিপার্টমেন্টে দেখা করতে হবে।’ যখন পাতলা হয়ে এলো ছেলেমেয়েদের ভিড় বিকেলের দিকে ডিপার্টমেন্টের সামনে আমি ও ইমরুলভাই শুধু ঢুকলাম একটি রুমে। মামা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। দীর্ঘদেহী লম্বাটে মুখ গোঁফওয়ালা স্মার্ট একজন ভদ্রলোক আমাকে বসতে বললেন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। সালাম গ্রহণ করে কাগজকলম নিয়ে আমার নামধাম, শখ, কেন ইতিহাস পড়তে চাই জানতে চাইলেন। রীতিমতো ভাইভা টেস্ট। ইংরেজিও পরীক্ষা করলেন। কিছু কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সনতারিখ জিজ্ঞেস করলেন খটাখট আমি উত্তর দিলাম। ইমরুলভাই আবার মাঝখানে বললো, ‘প্রবীর খুব ভালো লেখক আরিফভাই। জাতীয় পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার খুব ইচ্ছে।’ ‘হুম, এই রকম ছেলেই তো দরকার। সব আবরজাবর এসে ভর্তি হয় ইতিহাস বিভাগে, মানমর্যাদাই চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বর্তমান সরকার স্টুডেন্ট পলিটিক্সটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে মেধাচর্চার বারোটা বাজিয়েছে। এটা উচিত হয়নি। কে শোনে কার কথা! এদেশে আর পড়ানো যাবে না ইমরুল। বড় খারাপ সময় আসছে।’ স্যার একটি সাদা কাগজে ইংরেজিতে লিখতে লিখতে ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বললেন। তারপর ইমরুলভাইকে চট্টগ্রামের ভাষাতেই বললেন, ‘এই চিঠির সঙ্গে প্রবীরের মার্কশীটের দুটি করে কপি আর দুকপি ছবিসহ আগামীকাল চলে যাও সরাসরি করিম স্যারের কাছে। স্যার এখনো ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, ক’দিন পরে সিরাজ স্যার চেয়ারম্যান হবেন।’ পরের দিন ইমরুলভাইসহ সরাসরি স্যারের রুমে ঢুকলাম। স্যারকে সালাম দিলাম দুজনে।

প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও স্যার সময় দিলেন। আমি ফাইল খুলে দলিলপত্র এগিয়ে দিলাম, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার কিছু কপিও দিলাম। সুশিক্ষিত মানুষ আমার দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলেন। যা বোঝার বুঝে গেলেন। তারপর এক নজর আমার মার্কশীট ও পত্রিকার লেখাগুলো নাড়াচাড়া করলেন। স্বল্পবাক মানুষটি বেশি কথা বললেন না, শুধু বললেন, ‘ইতিহাস পড়তে ভালোলাগে তোমার? ইতিহাস নিরপেক্ষ পরীক্ষার ক্ষেত্র। কোনো টিচার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের অর্জিত জ্ঞান থেকে স্টাডি করার চেষ্টা করবে। ব্যক্তি ইতিহাস সৃষ্টি করে কিন্তু ব্যক্তি আর ইতিহাস এক জিনিস নয় স্মরণে রেখো।’ কী অসাধারণ কথা বললেন, আমার চোখে জল এসে গেল। বললাম, ‘আশীর্বাদ করবেন স্যার।’ সাইন করে দিলেন আরিফ স্যারের সুপারিশপত্রে। বললেন, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, আগামীকাল থেকেই ক্লাসে জয়েন করো। আর কোনো সমস্যা নেই।’ ব্যাস। হয়ে গেল। স্বর্গ ধরায় নেমে এলো। করিম স্যারের কক্ষ থেকে বেরিয়েই ইমরুলভাইকে, লতিফমামা আর নূরুভাইকে কৃতজ্ঞতা জানালাম প্রাণভরে। বাবাকে ফোন করলাম হাটহাজারি থানার টেলিফোন একচেঞ্জ থেকে। শুনে বাবা হেসে ফেললো, ‘তাই! ভর্তি হতে পেরেছো তাহলে! কীভাবে হলে?’

আমি আদ্যান্ত সব খুলে বললাম, বাবা চুপ করে শুনে গেল। তারপর ভেজা গলায় বললো, ‘নূরুসাহেব, ইমরুল আর লতিফসাহেবকে আমার ধন্যবাদ জানিয়ো। এদেশে ক’জন ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে, তোমার বন্ধুদের মধ্যে ক’জনইবা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে! তোমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন ওরা এবার ভালো করে হিসেব করো চলো। মহাসাগরে পড়েছে এবার থেকে তোমাকেই তোমার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আমাদের আর কিছু করার নেই। ভালো কথা, আমারও চট্টগ্রাম কোর্টে বদলির কথা চলছে। গেলে তো ভালোই হবে। তুমি তাহলে থাকবে কোথায়?’ বললাম, ‘সে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আপাতত মানিকদের বাসায়, খালুজানও চাচ্ছেন হলে সীট না পাওয়া পর্যন্ত এখানে থাকি।’ বাবা আশ্বস্ত হল যেন, ‘আচ্ছা। আমি মোস্তফা সাহেবকে ফোন করবো। কুমিল্লা যাবে নাকি?’ বললাম, ‘না ক্লাস তো অনেক এগিয়ে গেছে। আগামীকাল থেকেই ক্লাস করতে হবে। ছুটিছাটা পড়লে তখন যাবো।’ স্মরণ করিয়ে দিল, ‘তোমার মাকে একটা চিঠি লিখে দিও। তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অন্তরালে সবকিছুই করেছে তোমার মা। আমি আর কী করেছি? তাকে তাড়াতাড়ি সুখবরটা জানাও।’ হ্যাঁ, আমার মা। তাঁকে জানাবো না তো কাকে জানাবো! মা তো মা নয়, আমার চিরকালের বান্ধবী। সেই ইতিহাসও লিখে রাখার ইচ্ছে আছে। টেলিফোন করলাম, ঈশ্বরভক্ত মা আমার সুখবর শুনে কেঁদেই ফেললো! ... চলবে

আলোকচিত্র : বামে, সেই সময়কার কুমিল্লার লেখক ও অন্যান্য বন্ধুরা, বাঁদিক থেকে দাঁড়ানো কবি বিজন দাস, কবি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, কবি ও উপস্থাপক আলাউদ্দিন তালুকদার, স্বপন সেনগুপ্ত, বিষ্ণু সাহা, কবি ও সাংবাদিক গাজী মোহাম্মদ ইউনুস ও ফারুক আহমেদ। নিচে উপবিষ্ট (?), কবি ও চিত্রশিল্পী বাবুল ইসলাম, সাংবাদিক, নাট্যশিল্পী ও ফটোগ্রাফার শাহজাহান চৌধুরী এবং কবি ইসহাক দিদ্দিকী। ডানে, প্রাচীন রূপালি সিনেমা হল, এর কাছেই ছিল সেই রেস্টুরেন্ট যেখানে আমরা প্রায়শ শুধু খাসির মাংশ খেতে যেতাম।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ২৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test