E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১৫

২০১৪ জুলাই ২৫ ১৮:০৫:৩২
অতলান্ত পিতৃস্মৃতি দ্বিতীয় অধ্যায়, পর্ব ১৫

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

আসলে তখন আমাদের সমাজজীবনের মূলচিত্রটাই এরকম ছিল যে, মধ্যবিত্তের টাকা নেই কিন্তু সমাজে মানমর্যাদাবোধ টিকিয়ে রাখতে সর্বদাই গলদঘর্ম। বিত্ত নেই, সালাম বেশি। একজন সাধারণ পুলিশ অফিসারের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা কোথায় আবার পাঁচপাঁচটি সন্তান যে পরিবারে! আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম সিলেটের গ্রাম থেকে চাল, মুগের ডাল, মুড়ি, ফলফসারি, মাছটা জেঠু নিয়মিত পাঠাতো বা নিজে নিয়ে আসতো বলে। মাসি পাঠাতো বাদাম তেল, ফলফসারি, মুশুরের ডাল। মাসিরা ছিল বেশ সচ্ছল। কারণ জায়গাজমি ছিল, চাল, ডাল ও বাদামের চাষবাস ছিল। ফেঞ্চুগঞ্জের ভাটির দিকে কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষা মানিককোণা গ্রামে মাসির বাড়ি। মেসোমশাই ছিলেন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। বড় সৌখিন মানুষ, নিজে হারমোনিয়ম বাজিয়ে পদাবলি গান গাইতেন। সেইসব স্মৃতি এখনো মনোবনে উজ্জ্বল ডানা মেলে ওড়োওড়ি করে। মানিককোণা বাজারে মাসির বড় ছেলে সববয়সী প্রায় সুনীলের সঙ্গে কত আড্ডা দিয়েছি।

সারাদিন ছলাৎ ছলাৎ, ঝুপ্ ঝুপ্ শব্দে পাড় ভাঙ্গতো। ঘাটে এসে ভিড়তো লঞ্চ, তারপর চলে যেতো ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে। সেই মাসিও খুব খুশি হলো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি জেনে, মা চিঠি লিখেছিল। হবিগঞ্জের নীহারমামা সংস্কৃত ভাষার টোলের হেডপণ্ডিত আমাকে চিঠি লিখেছিলেন অভিনন্দন এবং আশীর্বাদ জানিয়ে। ইমরুলভাই একদিন বললেন, ‘আর কয়েকটি দিন কষ্ট করো আমি হলে সীটের ব্যবস্থা করছি।’ তাঁর সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার যে, আমার থাকার ব্যবস্থা, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোমরা-চোমরা নেতাদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন। যেমন ছোট বক্তিয়ার, বাপ্পি, জ্যাকেল বখতিয়ার, সিরাজুদ্দৌলা, মৃণাল বড়ুয়া, খোরশেদ আলম সুজন, জমির চৌধুরী, ছাত্র শিবিরের আবদুল গাফফার প্রমুখের সঙ্গে। এঁরা ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের প্রভাবশালী নেতা ও কর্মী এবং চট্টগ্রামের স্থানীয়। যতই মারামারি কাটাকাটি হোক না কেন তাঁদের মধ্যে একটা সমঝোতা ছিল আঞ্চলিকতার প্রশ্নে। তথাপি ছাত্রলীগের মধ্যে গ্রুপিং ছিল যে কারণে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র ছাত্র বখতিয়ারউদ্দিনভাই এবং ইতিহাস বিভাগের সিরাজুদ্দৌলাভাইয়ের সঙ্গে আমার দহরম-মহরম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইমরুলভাই আর বখতিয়ারভাইয়ের চেষ্টার আগেই বন্ধু কুমিল্লার বাগিচাগাঁও পাড়ার আহাম্মদ আলী মিটন আলাওল হলের ২০৩ নম্বর রুমে একটি সীট পেয়ে গেল। সে আমাকে নিয়ে এলো ডাবলিং করার জন্য। খাট একটা নামমাত্র সারারাত তো জেগেই থাকতাম আমরা নিশাচর প্রাণীর মতো। দিনের বেলা ক্যাম্পাসে, এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি।

ঘুম আমাদের জীবনে ছিল হারাম। বখতিয়ারভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক গ্রুপের সভাপতি ওবায়দুল কাদেরের ক্যাডার ছিলেন, শিবিরের সঙ্গে খুনাখুনি ঘটনার কারণে হুলিয়া ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ফলে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যাম্পাসে আসতেন, পড়ালেখা লাটে উঠেছিল তাঁর। তথাপি বিভাগে ছাত্র হিসেবে নাম ছিল। অধিকাংশ সময় থাকতেন চট্টগ্রাম শহরের রাইফেল ক্লাবের মোড়ে অবস্থিত পুরনো গ্রান্ড হোটেলের একটি রুমে বছরের পর বছর। সেখানে গিয়েও আড্ডা দিতাম। তিনি তাঁর নিজের ছোটভাইয়ের মতো আমাকে আদর করতেন। এত আদর মনে হয় আমার কোনো আপন অগ্রজ থাকলেও করতো কিনা সন্দেহ আছে। বাবা যখন আমার সেকেন্ড ইয়ারে বদলি হয়ে এলো চট্টগ্রাম কোর্টে তখন বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় অফিসে। বাবা বখতিয়ারভাইয়ের মামলাগুলো সম্পর্কে জানতো। বাবা কিছু করেছিল কিনা জানি না, বখতিয়ারভাই একদিন আলাওল হলে এসে বললেন, ‘প্রবীর, তোমার বাবা বড় ভালো মানুষ। একদিন তোমাদের কুমিল্লার বাসায় যাবো খালাম্মাকে দেখতে। তুমি তোমার বাবার যোগ্য ছেলে ভাই। তুমি শাইন করবে।

তোমাকে নিয়ে তোমার বাবার অনেক আশা। তুমি রাজনীতি থেকে সরে যাও, তোমার মেধা অন্য জায়গায় কাজে লাগাও।’ আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তার কথা শুনে! রাজনীতিপাগল মানুষ অথচ কী স্বচ্ছ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। সবাইকে রাজনীতি করতে নেই এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। এভাবে তখন কোনো ছাত্রনেতা চিন্তা করতেন বলে আমার মনে হয়নি। তারপর তাঁকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যেই দেখেছি। মিছিল-মিটিং করেছেন। এম এ পরীক্ষা দিয়ে শহরের মূল রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। আরও একটি ব্যাপার ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে আঞ্চলিকতার প্রচন্ড প্রভাব থাকার কারণে প্রায়শ মারামারি হতো ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেতো, রাজনৈতিক গণ্ডগোলের কারণে তো হতোই! এরশাদের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখাই উঠে গেল যা গভীর দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল আমাকে। কত ভালো ভালো ছাত্র ও শিক্ষক যে চোখের সামনেই চলে গেলেন এক এক ঘরে বিদেশে যারা আর ফিরলেন না। মেধার তীব্র সঙ্কট দেখা দিল সমগ্র বাংলাদেশে বিদেশে মেধাপাচারের কারণে। আর এটাই সামরিক জান্তারা চেয়েছিল। জিয়াউর রহমানের অসমাপ্ত কাজগুলো সাধন করেছিল সচতুর এরশাদ তার মধ্যে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিবস এবং বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা অন্যতম প্রধান। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কম খেলাধুলা করেননি তিনি! ভীষণ শকড্ হয়েছিলেন সর্বস্তরের, সর্বসংস্কৃতির উদারপন্থী মানুষ। যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পায়ে কুড়াল মেরে বিকলাঙ্গ করে দেয়ার গভীর গভীর ষড়যন্ত্র ছিল পরোক্ষভাবে মার্কিনী ও মধ্যপ্রাচ্যের প্ররোচনায়।

বাবা এতই শক্ত হয়েছিল যে, বললো, ‘আর কোনো ভদ্র বাঙালি এদেশে থাকতে পারবে না, রাজনীতিও করবে না।’ ঠিকই বহু মানুষ, ভদ্রজন রাজনীতিকে ঘৃণা করতে লাগলেন, দূরে সরে গেলেন। পাথুরেমাথা, স্বপ্নহীন, লক্ষ্যহীন নগদ পেট্রোডলারে বিক্রিত মানুষগুলো বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকে দখল করে নিল। বস্তুত এরশাদ পতনের পরও আজ পর্যন্ত তেমন কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। রাষ্ট্র আজও দুভাগে বিভক্ত---প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। জাতীয়তাবোধ জিনিসটাই হারিয়ে গেছে মানুষের চেতনা থেকে। সম্ভবত এসব কথা বখতিয়ার ভাই বুঝতেন তাই বলেছিলেন, ‘প্রবীর আর রাজনীতি করো না, ছেড়ে দাও। অন্য কিছু ভাবো।’ সিগারেট, মদ-বিড়ি কিছুই খেতেন না তিনি। এমনকি মেয়েদের দিকেও কোনোদিন তাকাতে দেখিনি তাকে। তার এই কথার মধ্যে বাবার চিন্তার প্রতিধ্বনি ছিল। এতখানি তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। ক্যাম্পাসে প্রায় নিয়মিত আঞ্চলিকতা নিয়ে লাঠালাঠি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূষণ। সিলেটি, বরিশাল, কুমিল্লা আর ঢাকা-ময়মনসিং গ্র্রুপের সঙ্গে স্থানীয়দের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা নিয়েও মারামারি হতো। আমাদের বাড়ি যেহেতু সিলেট তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রাস এবং ইয়াংস্টার বলে খ্যাত ছিলেন হবিগঞ্জের শামসুজ্জামান রানাভাই। রাস্তার পাশে আলাওল হলের একতলার প্রথম কক্ষটি ১০১ নম্বর ছিল তাঁর দখলে। ছিপছিপে শরীর, কালো, লম্বাচুল আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে স্মার্টও ছিলেন। আমার সময় সিলেটি প্রায় শতাধিক ছাত্র ছিল। কুমিল্লার আরও বেশি।

তবে কুমিল্লা শহরের জনা বিশেক ছাত্রচাত্রী ছিল হলগুলোতে। রানাভাই আলাওল হলের একতলার কয়েকটি রুম দখল করে থাকতেন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। কুমিল্লা গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো ছিল। বরিশাল বা ঢাকা গ্রুপের সঙ্গে তত নয়। সিলেটিরা অধিকাংশই ছিল জাসদ ছাত্রলীগের। প্রভাবশালীদের মধ্যে একমাত্র মাহমুদভাইকেই দেখেছি আওয়ামী ছাত্রলীগের লিডার হিসেবে। খুব ভালো মানুষ ছিলেন মাহমুদভাই, জনপ্রিয়তাও ছিল। দেখা হলেই চা না খাইয়ে ছাড়তেন না। বলতেন, ‘দেশী মানুষ চা খাই যাও। এই কালু, সিলেটি কবিকে চা দেও একটা ভালা করি।’ বহু বছর পরে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাহমুদভাইয়ের সঙ্গে দেখা। কিছু ইলেকট্রনিক মালামাল নিয়ে কাস্টমসে ঝামেলা হলে তিনি এসে সহযোগিতা করেছিলেন। চিনতে পেরেছিলেন আমাকে। হযরত শাহজালাল হলে থাকতেন মাহমুদভাই কখনো রানাভাইয়ের সঙ্গে চলতেন না তবে দেখা হলে কথাবার্তা হতো। রানাভাইও আমাকে দারুণ স্নেহ করতেন। হবিগঞ্জ শহরের অধিবাসী বলে হবিগঞ্জ হাইস্কুলের মাস্টার নীহার মামাকেও চিনতেন। তিনি দেখা হলেই বলতেন, ‘প্রবীর ভালো আছো? একটা গান শোনাও না ভাই।’ রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসতেন। ‘জেনে শুনে বিষ করেছি পান......’। এটা ছিল তার প্রিয় গান। শোনাতাম আমি। উড়নচন্ডি রানাভাইয়ের কক্ষে সারাদিনই জোরে জোরে গান বাজানো হতো। মদ, গাঁজার আসর বসতো প্রকাশ্যেই ছুটির দিনে দুপুর বেলা, অন্যান্য দিন রাতের বেলাতেও। আকাম-কুকাম কী হয়নি তার রুমে! প্রভোস্ট স্যার বিরক্ত হয়ে প্রশাসনে অভিযোগ করলেও কিছুই হতো না। তবে রানাভাই মেয়েদের প্রতি খুব উদার ও সংবেদনশীল ছিলেন।

তিনি একমাত্র ফীস্ট ছাড়া হলের ডাইনিংএ খেতেন না। জোবরা গ্রামের মার্কেট থেকে খাবার আনিয়ে খেতেন না হয় এখানে সেখানে গড়ে ওঠা ঝুপরির খাবার দোকানগুলোতে খেতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই রাঙ্গামাটির চোলাই না হয় বাংলা মদ তাঁর পেটে না পড়লে মাথার ঠিক থাকতো না। তিনি যেমন জানতেন বখতিয়ারভাইয়ের সঙ্গে আমার দহরম-মহরম সম্পর্কের কথা এবং বখতিয়ারভাইও জানতেন আমি সিলেটি কিন্তু পরস্পর কোনোদিন কিছুই জিজ্ঞেস করেননি আমাকে! ফলে কোনো কমপ্লেক্স ছিল না তাদের মধ্যে। এবং আমাকে নিয়েও। বরাবরই আমি সহজ এবং সিধাসাদাপন্থী মানুষ কারো সঙ্গে কখনো সম্পর্ক খারাপ হয়নি তবে থার্ড ইয়ারে ওঠার পর ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে সরে যাবার কারণে বন্ধুদের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কেননা অধিকাংশ সময় আমি পোস্টার, লিফলেটগুলো লিখতাম। সেটা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মিটিং-মিছিল কোনোটাতেই আর যেতাম না। কিন্তু কখনো কথা কাটাকাটি বা লাঠালাঠি হয়নি। আসলে বলতে লজ্জা নেই, যখন যেখানেই গিয়েছি আমাকে মানুষ আলাদাভাবে নিত কী নারী কী পুরুষ। আমি মাঝেমাঝে ভাবি কী যে ছিল আমার মধ্যে যেটা নিজে আবিষ্কার করতে পারিনি কোনোদিন। জাপানে আসার আগে বাবা অবশ্য আমার চরিত্রের কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছিল। যেটা আমি আদৌ এর আগে জানতাম না। ...চলবে

আলোকচিত্র : বামে, ইফতেখার আহমেদ রীপ এই বাড়িতে থাকত, এখন একটি গ্যারেজ। ডানে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হল যেখানে কেটেছে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ২৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test