E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্মরণে

২০১৪ আগস্ট ১৪ ১১:৩৯:৩৮
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্মরণে

প্রবীর বিকাশ সরকার  : ২০১০ সালের কথা। টোকিওর সুগিনামি-ওয়ার্ডের রেনকোওজি বৌদ্ধমন্দিরে প্রতি বছরের মতো সেবছরও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বরাবরের মতো আমিও উপস্থিত ছিলাম আগস্ট মাসের ১৮ তারিখে। নেতাজির অগণিত জাপানি সহকর্মী ও ভক্তরা বিশ্বাস করেন ১৮ই আগস্ট নেতাজি ভিয়েতনামের সাইগন শহর থেকে একটি ছোট্ট যুদ্ধবিমানে চড়ে রাশিয়া যাওয়ার পথে তাইওয়ানের তাইপেই বিমানবন্দরে এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তিন ডিগ্রি পর্যন্ত তাঁর শরীর দগ্ধ হলে পরে বাঁচার আর উপায় থাকেনি।

ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমানও তখন তাইওয়ানের মিলিটারি হাসপাতালে নেতাজির পাশে উপস্থিত ছিলেন তিনিও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁকে নেতাজি শেষ নিঃশ্বাসত্যাগের আগে নির্দেশ দেন, স্বদেশে ফিরে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। ভারত স্বাধীন হবেই। নেতাজির মরদেহ তাইপেইতে সৎকার করা হয়। মৃত্যুসনদ প্রদান করেন ডঃ তানেয়োশি নামে জনৈক জাপানি সেনাডাক্তার। নাকামুরা নামে একজন দোভাষীও উপস্থিত ছিলেন নেতাজির অন্তিম সময়ে। তাঁর চিতাভস্ম টোকিওতে নিয়ে এসে রেনকোওজি মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয় ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসেই।
অবশ্য নেতাজির মৃত্যু নিয়ে বহু বিতর্ক বিদ্যমান। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, তাইওয়ানে নেতাজির মৃত্যুর নাটক সাজিয়েছিলেন নবভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেতাজির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জওহরলাল নেহরু যাতে করে নেতাজি আর ভারতে প্রত্যাবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীত্ব দাবি করতে না পারেন। কারণ নেহরুর চেয়ে দেশ-বিদেশে নেতাজির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বেশি।
আবার কোনো কোনো গবেষক বিশ্বাস করেন, নেতাজি রাশিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং লৌহমানব স্টালিন তাঁকে বন্দী করে রেখেছিলেন। বন্দী অবস্থাতেই প্রতিপক্ষ নেহরু বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী অ্যাটলির মাধ্যমে নেতাজিকে হত্যা করিয়েছেন তাঁর পথ নিষ্কন্টক করার জন্য। নেতাজি যে ইরান হয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন তারও প্রমাণ পেয়েছেন কোনো কোনো গবেষক।
অন্য গবেষক বলছেন, একটি ভিডিওতে নেতাজিকে দেখা গেছে রাশিয়ায় স্টালিনের শোকসভায়।
এসবের পাশাপাশি ভারতে সন্ন্যাসী হিসেবে নেতাজি দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন বলেও অনেক গুজব বা মুখরোচক গল্প ও প্রতিবেদন ভারতীয় পত্রপত্রিকায় দেদার প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যদিকে নেতাজির পরিবারের কেউ বিশ্বাস করতে নারাজ, নেতাজি মারা গেছেন, তাঁদের বিশ্বাস নেতাজি এখনো এশিয়ার কোনো না কোনো জঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় বেঁচে আছেন শতবর্ষ পেরিয়ে! নেতাজিকে ‘ভারতরত্ন’ প্রদানেও তাঁদের অনীহার শেষ নেই। কিন্তু তাঁরা ভুলে গেছেন যে, নেতাজি তো মারা গেছেনই কোথাও না কোথাও। আর তিনি একক পরিবারের কেউ নন, তিনি সমগ্র জাতির। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, নেতাজি যদি জাপানের সঙ্গে সন্ধিযুক্ত হয়ে যুদ্ধ না করতেন ভারত কবে স্বাধীন হত কেউ বলতে পারে না। বহির্বিশ্বে নেতাজির লড়াই ভারতের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করেছিল বলে বৃটিশ ইতিহাসবিদও লিখেছেন। ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজি শুধু নন, বহু জাপানি তাঁদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী তাঁর অল্পবয়সী স্ত্রী তোশিকো বসুর কথা ভুলে যাই কীভাবে? তাই জাপানি ভক্তরা নেতাজির ভারতরত্ন পদকে ভূষিত হওয়ার সংবাদে অত্যন্ত খুশি। এর ফলে ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন আলো ফেলবে নিঃসন্দেহে।
প্রতি বছরই স্মরণসভায় নেতাজির সহকর্মী বা ভক্তরা দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন, নেতাজি সম্পর্কে কথা বলেন, স্মৃতিচারণ করেন, কেউ কেউ গবেষণা করছেন তাঁরা তাঁদের অভিসন্দর্ভ পাঠ করে শোনান, বিলি করেন। তাঁরা ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানান নেতাজির চিতাভস্ম তাঁর স্বাধীন মাতৃভূমিতে নিয়ে গিয়ে মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করার জন্য। নেতাজি কত বছর আর এভাবে প্রবাসে কাটাবেন, তাঁর জন্মভূমি কী এখনো স্বাধীন হয়নি?
সকালবেলা নেতাজির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে উপাসনা অনুষ্ঠিত হয় দোতলায় মূল বেদীমণ্ডপে। তারপর নিচে আলোচনা ও খাওয়াদাওয়া অনুষ্ঠিত হয়। আগে এই কাজটি করত মূলত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমী জাপান, কিন্তু এই সংস্থাটি এখন নেই তাই মন্দির কর্তৃপক্ষই আয়োজন করে থাকেন।
সেবারও তেমনি একজন নেতাজির সহকর্মী প্রায় আশির কাছাকাছি বয়স ইয়ামামোতো তেৎসুরোও ছিলেন হিকারি কিকান ইউনিটের প্রশিক্ষক সেনাসদস্য। জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য এই ইউনিটটি গঠন করা হয়েছিল। এর প্রধান ছিলেন জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি। ইয়ামামোতোসান নেতাজিকে কাছে থেকে দেখেছেন, জেনেছেন গভীরভাবে। সেই স্মৃতির কিছু অংশ এবং নেতাজি সম্পর্কে তাঁর অভিমত লিখে মুদ্রিতাকারে নিয়ে এসেছিলেন। সভায় পাঠ এবং বিলি করেছিলেন, আমাকেও একটি কপি দিয়েছিলেন। আমি ও নেতাজি যে একই জাতির লোক এবং বাঙালি শুনে খুব আনন্দিত হয়েছিলেন।
স্মৃতিপত্রের ৮ পৃষ্ঠার মধ্যে ৬ পৃষ্ঠা জুড়ে নেতাজির কথা। এক জায়গায় লিখেছেন, ১৫ আগস্ট যখন জাপানের সম্রাট হিরোহিতো যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন তখন দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানি সৈন্যরা তাড়াহুড়ো করে পিছু হটে স্বদেশের দিকে ফিরছিলেন। জেনারেলরা কাউকে না জানিয়ে, এমনকি বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত না জানিয়েই পালিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। এমনকি বার্মার স্বাধীনতাকামী নেতা বামো পর্যন্ত নিরাপদে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র নেতাজি ছিলেন অকুতোভয় তিনি আইএনএ তথা আজাদ হিন্দ ফৌজের সকল সদস্যকে বলছিলেন, আমি বামো নই, আমি সুভাষ, আমি সবাইকে নিরাপদে পাঠানোর পর শেষে যাবো। ঝাঁসির রানী-বাহিনীর সকল সদস্যাকে ১৫টি ট্রাকে তুলে দিয়ে নিরাপদে পাঠান। প্রায় ৬০০ নারী সেনা। সবাইকে নিরাপদে পাঠিয়ে দিয়ে নেতাজি রেঙ্গুন থেকে ভিয়েতনামে অভিমুখে যাত্রা করেন।
শেষে একটি সাক্ষাৎকারে বিখ্যাত কেইঅ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক উইলিয়ামস ইয়ামামোতো তেৎসুরোওকে প্রশ্ন করেন: আপনি কি নেতাজির মৃত্যু সম্পর্কে বিশ্বাস করেন?
ইয়ামামোতোসান বলেন: অবশ্যই। তিনি তাঁর শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত জন্মভূমির জন্য দান করে গেছেন তাইপেই বিমানবন্দরে।
অধ্যাপক উইলিয়ামস: কীভাবে আপনি জানেন?
ইয়ামামোতোসান: তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি।
অধ্যাপক উইলিয়ামস: ?.......
ইয়ামামোতোসান: জাপানে যারা স্বদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন তাঁরা বীর---তাঁরা ঈশ্বর হিসেবে মন্দিরে সমাহিত হন। আপনিও ঈশ্বরে বিশ্বাস করুন। ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করলে এই ব্রহ্মাণ্ডে সত্য বলে কিছু থাকবে না।
অধ্যাপক উইলিয়ামস: ধন্যবাদ।

লেখক : জাপান প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test