E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমার জীবনে দুর্গাপুজো/প্রবীর বিকাশ সরকার

২০১৪ সেপ্টেম্বর ২৪ ১২:১৬:৪৪
আমার জীবনে দুর্গাপুজো/প্রবীর বিকাশ সরকার

গত বছর এই সময় কুমিল্লায় ছিলাম। দুর্গা পুজোর সময়টা উপভোগ করেছি বহু বছর পর। দিনের বেলা একা একা ঘুরেছি কয়েকটি মণ্ডপ। কারণ দুর্গা পুজোর স্বরূপ ও আনন্দ উপভোগ করার সময়টা সকাল ও সন্ধেবেলায় ভিন্ন রকম আমেজ নিয়ে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই এটা আমার অভিরুচি। এখানে একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার আছে, আছে নিজস্ব ভালোলাগা।

সকালবেলা পুজো মণ্ডপে গেলে মানসচক্ষে অনেক মনুষ্য দুর্গাদেবীর দেখা পাওয়া যায়। অকস্মাৎ এমন কিছু মুখ দেখি যাদেরকে কোনোদিন দেখিনি! উভয় পক্ষই চমকে উঠি! আবার কিছু মুখ বিস্মৃত রাখিবন্ধন ধরে টান দেয়। এমন কিছু নতুন নতুন মুখ দেখি যারা সন্ধেবেলা বা রাতে আসে না। আবার এমন কিছু মানবীকে দেখি দেবীকে প্রণামের পর উধাও হয়ে যায় রেখে যায় ছায়া।

ঠিক দুপুরবেলা পুজো মণ্ডপের চারদিক সুনসান নীরবতা। তখন নরনারী কাউকে কাউকে দেখি দেবীকে ভূমিষ্ঠ প্রমাণ করছেন কিন্তু তাদের ছায়া নেই। বছরে তারা একবারই আসেন।

এখানে প্রথম যে ছবিটি এটা তুলেছি শহরের বজ্রপুরে অবস্থিত বহু পুরনো ‘শ্রীশ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ী’তে। তখন সকাল দশটা বাজে দশমীর দিন। দেবীকে প্রণাম করে যখন ছবি তুলছিলাম তখন আমার পাশে এসে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা দাঁড়ালেন। আটপৌরে কুচিহীন কালোপেড়ে সাদা সুতির শাড়ি পরনে। অপূর্ব সুন্দরী! সদ্যস্নানসারা ফর্সা ধবধবে অবয়ব। পিঠ জুড়ে কালো চুলের বন্যা। শরীরময় ফলফসারী ধূপধুনোর হালকা সুরভি। নতমুখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন নগ্ন চরণে। আমি চলে এসে ফটকের কাছে দাঁড়ালাম তাকে আবার দেখার জন্য। কিন্তু দেখলাম নেই! বেশ কিছুক্ষণ খুঁজলাম আর দেখতেই পেলাম না। আমি মুচকি হাসলাম। এমন আরও অনেকবার ছেলেবেলায় দেখেছি। এসব ঘটনা কাউকে বলা যায় না। বলে লাভও নেই কারণ এসব অলীক মাত্র। অতিআবেগপ্রবণ মানুষের এক ধরনের মনোবিকার। কি জানি সত্যিও হতে পারে!

শহরের নজরুল এভিনিউতে অবস্থিত প্রাচীন কাত্যায়নী কালীবাড়ি খুবই বিখ্যাত একটি মন্দির। ছেলেবেলা থেকেই এই মন্দিরের দুর্গা ও সরস্বতী পুজো উপভোগ করে আসছি। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম প্রথম বর্ষের ছাত্র পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হল আফজালের (আফজাল হোসেন মজুমদার) সঙ্গে। একই আলাওল হলে থাকতাম আমরা আরও কয়েকজন কুমিল্লার সহপাঠীদের সঙ্গে। ঈদ ও পুজোর সময় আফজালদের বাসায় আড্ডা দিতাম। তাদের বাড়িটি ঠিক কালীবাড়ির উল্টো দিকে মজুমদার ভিলা মনে হয় তখন নাম ছিল এখন বিশাল বড় ভবন নির্মিত হচ্ছে। তাদের একটি ওষুধের দোকান ছিল মজুমদার ফার্মেসী নামে। সেখানে বসেও মাঝেমাঝে আড্ডা দিতাম। তখন দেখতাম একজন মধ্যবয়সী মহিলা বেশ সুন্দরী এবং কপালে তার সিঁদুর। আটপৌরে শাড়ি পরে থাকতেন সবসময়। একটি বড় ট্রাঙ্ক এবং কয়েকটি বস্তা নিয়ে তিনি চারদিকখোলা টিনসেডের মণ্ডপমঞ্চঘরের এক কোণে বাস করতেন। এখন ঘরটি মনে হয় নেই। আগে বেশ খোলামেলা ছিল মন্দির প্রাঙ্গণ এখন সীমিত আকার ধারণ করেছে।

সেইসময় আমি প্রায়শ ভদ্রমহিলাকে দেখতাম। কাউকে জিজ্ঞেস করে তার কুলুজি জানতে পারিনি। নানাজন নানাভাবে উত্তর দিয়েছেন। সন্ন্যাসীনী তিনি ছিলেন না সেটা নির্ঘাত সত্য। তবে কি কোনো ভদ্র পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন? মন্দিরের ঠাকুর পরিবার মনে হয় তার যত্ন নিতেন। শীতগ্রীষ্মবর্ষা তিনি এখানে বেশ কয়েক বছর ছিলেন যতখানি মনে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুর্গাপুজো বা সরস্বতী পুজোর সময় তাকে দেখতে পেতাম না। কোথায় থাকতেন কে জানে? কারো কোনো কৌতূহল ছিল না এই আগন্তুক নারী সম্পর্কে। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে আমি শেষবার দেখেছিলাম তখন তার মাথায় সাদারঙের অনেক দূর বিস্তৃতি ঘটেছে। জটাময় হয়ে উঠছে কেশরাশি। কিছুটা শুকিয়ে গেছেন। বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ছেন। কিন্তু কে যে ছিলেন সেই রহস্যময়ী নারী আজও আমার কৌতূহলের জিজ্ঞাসা হয়ে আছেন তিনি।

আফজালদের পাশেই একটি হিন্দুবাড়ি ছিল, মনে হয় এখনো আছে। একবার দুর্গা পুজোর সময় নির্জন দুপুরবেলা এই বাড়ি থেকে একটি কিশোরীকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম আটপৌরে ভঙ্গিতে হালকা রঙিন ছাপাশাড়ি পরা, গোলগাল মুখটি দারুণ সুশ্রী! তার হাতে একটি আলাপনাআঁকা কুলো সেটাতে পিতলের ঘট, কলার পাতায় ধানদুব্বা, প্রসাদ, জ্বলন্ত প্রদীপ। সেটা নিয়ে সে খালি পায়ে রাস্তা পার হয়ে কালীমন্দিরে গেল। আমি আফজালদের দোকানে বসে তার সেজভাই তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসে গেলাম। কিন্তু চোখ রাখলাম মেয়েটির দিকে। নাম নাজানা মেয়েটি মণ্ডপে দেবীর পায়ের কাছে কুলোটি রেখে গড়প্রণাম করে বেশ কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ল বলে মনে হল। মন্দির জুড়ে আর কেউ নেই তখন। তারপর যখন সে মন্দিরের ফটকে এসে রাস্তা পার হবে আমার চোখের সঙ্গে তার চোখ আটকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। দৃষ্টিবিনিময় যাকে বলে। এরপর আর কোনোদিন তাকে আমি দেখিনি এই শহরে। ঢলোঢলো রূবপতী সেই কিশোরী এখনো বর্ষারাতের আকাশে বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো জ্বলে উঠে চকিতে নিভে যায়।

পুজোর সময় আমাদের আড্ডা হত একেকদিন একেক বাড়িতে। তালপুকুর পাড়ে দোলন বা নন্দদের যৌথ উদ্যোগে দুর্গা পুজো ও সরস্বতী পুজো হত। দোলনের আসল নাম উজ্জ্বলকুমার সিংহ। ফর্সা স্বল্পভাষী ছেলেটি ছিল এই শহরের বনেদী পরিবার সিংহ বাড়ির ছেলে। সঙ্গীতজ্ঞ মন্টু সিংহর সর্বকনিষ্ঠ ছেলে। কুমিল্লার আদি ছাপাখানা সিংহ প্রেস তাদেরই ছিল। মাসিক ‘হিতৈষী’ পত্রিকা এখান থেকেই প্রকাশিত হত। মাঝে মাঝে সাহিত্য পত্রিকা ‘পূবর্বাশা’। এরা ব্রাহ্ম। ফয়জুন্নেসা স্কুলের সামনের পুরনো ব্রহ্মমন্দিরটি তাদের প্রতিষ্ঠিত। ব্রাহ্ম হলেও সিংহ পরিবার দুর্গা ও সরস্বতী পুজো উদযাপন করতেন। দোলনদের দালানবাড়ির পাশের টিনের বাড়িটি নন্দদের। দোলন ও নন্দ পরস্পর বেয়াই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই দুবাড়ির মাঝখানে খোলা প্রাঙ্গণে পুজো হত ঘটা করে। এবং খ্যাতি ছিল ব্যাপক এই পুজোর। প্রচুর ভক্তসমাগম ঘটত।

নন্দদের বাড়ির সিঁড়িতে বা বৈঠকঘরে পুজোর সময় জম্পেশ আড্ডা হত আমাদের---আহম্মদ আলী মিটন, জাকির হোসেইন, শাহআলম, কিশোর, বিষ্ণু, স্বপন, শঙ্কর প্রায় ১৫-২০ জন বন্ধু মিলে। নন্দর দিদি কৃষ্ণাদি ছিলেন দোলনের বড়দা নাকি মেজদা মুকুটদা বা কিরীটদার স্ত্রী। কাজেই একদিকে দিদি আবার বৌদিও তিনি। তাদের প্রেমঘটিত বিয়ে। সেই কৃষ্ণাদি অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। শ্যামলা রং দীর্ঘাঙ্গী তেমনি সুঠাম সুস্বাস্থ্যবতী। আমি মাঝেমাঝে ভাবতাম কৃষ্ণাদি নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে কালীদেবী ছিলেন। আমি দেবীর মুখ দেখতে গিয়ে কৃষ্ণাদিকেই মানসচক্ষে দেখতাম, তার সদাহাসিমুখ, হাস্কি ভয়েস এবং কমণীয় সৌন্দর্যকেই প্রণাম জানাতাম। জানি না এটা ভালো না মন্দ? নারীসৌন্দর্যের প্রতি দেবতারা যেখানে কাৎ হয়ে থাকতেন আর আমি তো মাটির গড়া নরদেহী মাত্র!

মনে পড়ে দোলনদের বাড়ির উল্টোদিকে এক দত্তবাবুর বাড়ি ছিল। কী দত্ত যেন নাম ভুলে গেছি। ডিসি নাকি এডিসি ছিলেন একবার কী এক মামলায় সর্বশান্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ বছর জেলে ছিলেন। বাবা সব জানত। একবার বলেছিল, ‘তালপুকুর পাড়ের দত্তবাবুকে চেনো নাকি?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘তাঁকে চিনি না তবে তার মেয়ে শিল্পী দত্তকে ভালো করেই চিনি।’

এই শিল্পী হ্যাংলাপাতলা একটি মেয়ে, বেশ সুন্দরী, চোখে মোটা ফ্রেমের চমশা পরত। অসম্ভব প্রতিভাময়ী সঙ্গীতশিল্পী ছিল তখনকার সমগ্র কুমিল্লা জেলায়। দোলনের সঙ্গে তলেতলে একটা ভাববিনিময় তার ছিল। যদিও দোলন তা স্বীকার করত না। মিটন, শাহআলমরা মাঝেমাঝে তাকে শিল্পীর বিষয়ে উত্যক্ত করত। দোলন হাসিমুখে তা সহ্য করে নিত। শিল্পী ও দোলন যে অনুষ্ঠানে আসন নিত তা সফল না হয়ে সম্ভব ছিল না। কারণ দোলন অসাধারণ তবলা বাজিয়ে। এই জুটি অনেক বছর কুমিল্লাকে মাতিয়েছে।

ঠিক পুজোর সময় শিল্পী-দোলনের ঘুমন্ত বিষয়টি যেন জেগে উঠত আমাদের মধ্যে। দুজনকেই নানা কথা বলে উসকে দিতাম আমরা। কাঁদো কাঁদো অবস্থা দাঁড়াতো শিল্পীর। আমার এক বান্ধবী ছিল শিমুল নামে তাদের বাসা ছিল তালপুকুর পাড়ের পূর্বপাড়ে। প্রায়শ স্বপন ও আমি বেড়াতে যেতাম তখন শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যেত। শিল্পী-শিমুল ছিল অভিন্নউদর বান্ধবী। শিল্পীকে এখন কুমিল্লায় গেলে আর দেখি না। দোলন অনেক আগেই কানাডাবাসী হয়েছে।

ক্যাতায়নী কালী মন্দিরটি আজও আছে তবে পরিবেশ একেবারেই বদলে গেছে। তালপুকুর পাড়, রানীরবাজারস্থ রামঠাকুরের আশ্রম, মনোহরপুর কালীবাড়ি, ঠাকুরপাড়ার রামকৃষ্ণ মিশন, চৌধুরীপাড়া, রাজগঞ্জর পান্নাপট্টি, ছাটিপট্টি, কাপড়িয়াপট্টি, দিগম্বরীতলা, কান্দিরপাড় কলেজের মোড়, মহেশাঙ্গন প্রায় সবগুলো মন্দিরের পরিবেশ ভীষণ বিশ্রী আকার ধারণ করেছে। এই একুশ শতকে ভাবা যায় না! ভাবতে পারি না! আদ্যপান্ত হিন্দু সংস্কৃতি এই ঐতিহাসিক শহরটির সবচে’ গৌরবোজ্জ্বল দিক কাজেই একে টিকিয়ে রাখা নাগরিক ও প্রশাসনের কর্তব্য।

আমার বুকের ভেতরে সবচে বেশি ভূমিপতন ঘটে ক্যাত্যায়নী কালীবাড়ি গেলে। মন্দিরটি আছে ঠিকেই কিন্তু হৃদয়ছেঁড়া বন্ধু আফজাল নেই, অনেক আগে স্বর্গবাসী হয়েছে। অনেক বন্ধু চলে গেছে ভারতে। বান্ধবীদের বিয়ে গেছে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ কেউ গেছে চিরতরে হারিয়ে। ছেলেবেলা এবং যৌবনের প্রথম উত্থানের সময়টা কত আনন্দেই না কেটেছে আমার! কত মুখ কত স্মৃতি কত অব্যক্ত যন্ত্রণা! কত মানঅভিমান, রাগারাগি এবং পুজোর সময় আবার মিলেমিশে যাওয়া। দুর্গা পুজো তাই মহামিলনের উপলক্ষ এবং আশীর্বাদও বটে।

খুব মনে পড়ে প্রতিমা প্রদক্ষীণের স্মৃতি। প্রতিমা নিয়ে বিশাল ট্রাক মিছিলের পাড়ায় পাড়ায় প্রদক্ষীণ- এই মাতাল আনন্দের স্মৃতি কী ভোলা যায়! অনেক পাড়াতেই বন্ধু-বান্ধবী-দিদি-বৌদি ছিল তাদের দিকে বাতাসা ও পেড়া ছুঁড়ে দিতাম। প্রসাদ পেতে সেকি হৈচৈ কাড়াকাড়ি! অনেকে আবার গোস্বাও করত এই রীতির, কারণ দুষ্টু ছেলেরা অহেতুক মেয়েদের দিকে প্রসাদ ছুঁড়ে আহত করত। যদিওবা সাবধান করে দিতেন মিছিল কমিটি। কিন্তু ১৭-১৮ কী কোনো নিষেধ মানে? চিরকিশোর কবি সুকান্তই তো লিখেছে মনে হয় তার কোনো এক কবিতায়, গানও শুনেছি: ‘আঠারো বয়স জানে না থামার / আঠারো বছর বয়স জানে না মানার....। তাই আমারও সুন্দরী মেয়ে দেখলে প্রসাদের সঙ্গে প্রেমপত্রও বেঁধে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে জাগত! কারণ বয়সটা তখন মাত্র ১৭-১৮ কেবল যেন প্রেম করার- তাৎক্ষণিক ভালোলাগার জোয়ার যাকে বলে।

১৭-১৮ বয়সের পুজোর উৎসব সে এক অব্যক্ত অনুভূতির ঝড়োহাওয়া- তার রূপরসগন্ধই আলাদা!

লেখক : জাপান প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test