E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একাত্তরের স্মৃতিকথা বললেন জুঁই

‘সুরুজের চোখ দুটি আগে উপড়ে ফেলা হয়েছিল’

২০১৪ অক্টোবর ৩০ ১৭:৫০:৪৯
‘সুরুজের চোখ দুটি আগে উপড়ে ফেলা হয়েছিল’

শ্রুতি লিখন : শঙ্করী দাস : ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু। সে রাতে আমি ময়মনসিংহ শহরে ছিলাম। আমাদের বাসা ছিল জিলা স্কুলের গেটের সামনে। আমি তখন নতুন বৌ। মাত্র কয়েক মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। এটা ছিল আমার শ্বশুরের বাসা। ২৬ মার্চ সকাল থেকে বাসার সবার কাজ ছিল রেডিওর খবর শোনা, বিভিন্ন জায়গার খবর সংগ্রহ করা আর পরিস্থিতির উপর নজর রাখা। ময়মনসিংহ শহর জুড়েই ছিল একই অবস্থা।

এভাবেই মার্চ শেষ হলো। ১ এপ্রিল ভোরে আমার ভাসুর আতংকে ছুটে বাসায় ঢুকলেন এবং হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী শহরে ঢুকছে। যে যেদিক সম্ভব বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ আমরা তখন যেভাবে ছিলাম সে অবস্থাতেই বাসা ছাড়তে শুরু করলাম। আমাদের তখন মাত্র নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে। আমার শাশুড়ি ঘরের কিছু জিনিষপত্র নিয়ে গফরগাঁও এর উদ্দেশে রওনা দিলেন। তিনি কিছু রুটিও সাথে নিলেন। আমি ও আমার স্বামী সুনীল বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হই। সুনীল বাবু ছিলেন আমার স্বামীর সহকর্মী। সুনীল বাবুর বাড়ি ছিল শহর থেকে ১৮/১৯ মাইল দূরে ফুলবাড়ীয়া থানার রাধাকানাই গ্রামে। সুনীল বাবুর বাড়িতে আমরা এক সপ্তাহ ছিলাম। এরই মধ্যে খবর শোনা যায়, সুনীল বাবুর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হবে। তখন আমরা সুনীল বাবুর বাড়ি ছেড়ে অন্য এক মুসলমান ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিই। রাধাকানাই গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি এভাবে আমরা একমাস লুকিয়ে রইলাম। স্বাধীনতার এত বছর পরও একবিন্দু ভুলিনি রাধাকানাই গ্রামের আশ্রয়দানকারীদের আদর-আপ্যায়ন।

রাধাকানাই গ্রামে একদিন হঠাৎ করে আমার ভাসুর এসে উপস্থিত হলেন। অনেক খোঁজের পর তিনি আমাদের সন্ধান পেয়ে ছিলেন। ভাসুর আমাদের নিয়ে রওনা হলেন আরও গ্রামের ভিতরে উনার শ্বশুরবাড়ি। পথে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রিক্সায় ভিজে যাচ্ছি। ভিজে কাপড়ে ভাসুরের শ্বশুর বাড়ি পৌঁছলাম। সেখানে একরাত থেকে গফরগাঁও আমার শ্বশুর বাড়ি চলে আসি। ভয়ভীতির মধ্যে থেকেও আমরা ভালো খাবার দাবার পাচ্ছিলাম। তখন মাছ, মাংস, দুধ, সবজি সব কিছু সস্তা। ক্রেতা নেই। নদীর মাছ তো লাশের কারণে মানুষ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। হাট-বাজার বন্ধ। খাবার আছে ঠিকই কিন্তু কারো পেটে খাবার ঢুকছে না। আতংঙ্কে সবাই দিশেহারা। কে কখন আর্মির হাতে পড়ে। এর মাঝে ইয়াহিয়া দেশের সমস্ত কর্মচারীকে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়। আমার স্বামী ময়মনসিংহ শহরের রাধাসুন্দরী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। চাকরিতে যোগদানের খবর নিয়ে আসে আমার দেবর। তখন আমাদের সিদ্ধান্ত হয় আমরা সবাই ময়মনসিংহে চলে আসব। শ্বশুর বাড়ির লোকজনসহ ময়মনসিংহে চলে আসি। আমার ও ননদের গায়ে ছিল বোরকা। আমার গায়ে নিরেট গাঁয়ের মেয়েদের মতন এক পেঁচে শাড়ি। মাথার চুল এলো করা। পায়ে জুতো নেই।

গফরগাঁও স্টেশনে ট্রেন পৌঁছলে দেখি বেশির ভাগ ট্রেনের কামরা পাকিস্তানি সেনাদের দখলে। আমার স্বামী ভুল করে সবাইকে নিয়ে পাকসেনাদের কামরায় উঠে পড়েন। কিছু বুঝে উঠার আগেই এক সেনা তার গালে প্রচণ্ড জোরে এক চড় বসিয়ে দেয়। আমরা তখন পড়ি তো মরি করে অন্য কামরায় গিয়ে উঠি। আমরা যে কামরায় উঠি সেখানে কয়েকজন বিহারী। আমাদের তখন হাত পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিহারীদের মধ্য থেকে একজন আমার স্বামীর হাতে পাখা তুলে দিল। আর আমার স্বামীকে গফরগাঁও থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত একটানা বাতাস করে যেতে হল তাদের। ময়মনসিংহের বাসায় এলাম। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে অনবরত পাক সৈন্যদের গাড়ি চলে। জীবন হাতে নিয়ে বসে থাকি। রাত কাটে তো দিন কাটে না। আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। আজকের দুই কন্যাকে পেটে ধরে আছি। এমতাবস্থায় জন্মদানের সময় এল। হাসপাতালে ভর্তি হই। একদিন দেখি অনেক আহত পাকিস্তানি সেনা ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। হাসপাতালের সবাই বুঝতে পারলাম কাছে কোথাও আঘাত হেনেছে মুক্তিফৌজ।

আমার পাশের সিটে ভর্তি হল সুরুজের বৌ। সুরুজ আমার স্বামীর বন্ধু। সুরুজ মিঞা উকিলের ছেলে। আমার কন্যাদের জন্মের পরদিন সুরুজের বৌয়ের ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। সুরুজ মিঞা প্রতিদিন ছেলের জন্যে দুধ নিয়ে আসত বাইরে থেকে। একদিন দুধ আনতে যে গেল আর ফিরল না। রাজাকার ধরে নিয়ে গেছে। লাশটিও স্বজনরা খুঁজে বের করতে পারল না। শোনা গেলো হত্যার আগে সুরুজের চোখ দুটি আগে উপড়ে ফেলা হয়েছিল। সুরুজের অপরাধ কি ছিল আজ অবধি কেউ জানে না।

তখন জুন মাস। আরো খবর এল আমার নিকট আত্মীয় যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এই সব মৃত্যু সংবাদের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলো। প্রতিদিন অগণিত মানুষের মৃত্যু ঘটতে লাগল। যারা বেঁচে রইল তারা মানসিক দিক থেকে অর্ধমৃত হয়ে। আমরা কেউ বেঁচে থাকব বা পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাব এ ভরসা কেউ সেদিন রাখতে পারিনি। পুরো নয় মাস ধরে যে বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতা চলছিল তার বর্ণনা করা সম্ভব নয়। পুরো দেশ ছিল যেন আগুনের কুণ্ড। আগুনে হাত দিয়ে যেন আমরা বসে আছি। কখন পুড়ে ছাই হব শুধু তারই অপেক্ষা। অবশেষে ডিসেম্বর এল। এল আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তির সেই আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না।

লেখক : শিক্ষক ।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test