E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একাত্তরের স্মৃতিকথা বললেন সামাদ

‘...সামনে এসে দেখি আরো একজনের লাশ’

২০১৪ নভেম্বর ১০ ১৫:১৩:০৫
‘...সামনে এসে দেখি আরো একজনের লাশ’

শ্রুতি লিখন : শঙ্করী দাস : স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র বারো বছর। প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। অনেক কিছুই বোঝার মত বয়স তখন আমার ছিল না। তবে দেশে গণ্ডগোল চলছিল এটা বুঝতে পারতাম। কেননা ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। যা এ অঞ্চলের মানুষ কখনো দেখেনি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মত কাওরাইদ বাজারেও স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল প্রচণ্ডভাবে। প্রতিদিন ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিত সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন শ্রেণীপেশার তো বটেই, বেকার, কিশোর, বালক অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশ নিতো। মিছিলের শ্লোগান ছিল ‘তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা, যমুনা’। এই শ্লোগান তখন ছিল কাওরাইদের মানুষের মুখে মুখে। তো এভাবে আসে পঁচিশ মার্চ। ছাব্বিশ মার্চ সকালে ঘুম থেকে জেগে সবাই আকাশবানী ও বিবিসির খবরের মাধ্যমে জানতে পারে ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বাঙালী ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে ঢাকার বিভিন্ন ধরনের খবর আসতে শুরু করে। এলাকার নেতারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেলা শেষে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাওরাইদ আসতে শুরু করে। তারা নদীর পাড়, রেলস্টেশন, বাজার, স্কুল ইত্যাদি স্থানে অবস্থান নেয়।

এ অঞ্চলের জনগণ খাওয়া দাওয়াসহ তাদের স্বত:স্ফূর্তভাবে সর্ব প্রকার সহায়তা প্রদান করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা একত্রিত হয়ে বাঙ্কার খনন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। সে সব বাঙ্কার খননে আমি অংশ নিই। ছাবিবশে মার্চের দু’এক দিন পর পাক বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান আঁচ করতে পেরে বিমান হামলা চালায়। বাঙ্কার লক্ষ্য করে সৈন্যরা বোমা বর্ষণ করে। এবং ট্রেনে করে সৈন্যরা দ্রুত কাওরাইদ আসে। পথে যাকে দেখে তাকেই হত্যা করে। গোলাঘাট ব্রিজে পৌঁছলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গোলাঘাটে যুদ্ধ হয় বিকেলের দিকে। এখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু বিমান হামলার কারণে বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাধ্য হয় পালিয়ে যেতে। সেদিনের যুদ্ধে পাকসৈন্য বা বেঙ্গল রেজিমেন্টের হতাহতের সংখ্যা বলতে পারব না। তবে পরদিন বাজারে ছয়জনের লাশ আমি নিজের চোখে দেখেছি। এরা সবাই সাধারণ জনগণ। কাওরাইদ আক্রমণের দিনে আমি পাঁচ কিলোমিটার দূরে খালার বাড়িতে ছিলাম। বোম্বিংয়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার চোখে রক্ত এসে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে খালার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে এসে বাবাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মা বলল বাবাকে খুঁজে আনতে। ধান কাটা হবে। তখন বাবা বোরো ধানের চাষ করত। ধান পেকে গিয়েছিল। মা আরও বলল ঘরে কোন চাল নেই। এদিকে বাজারেও কিছু নেই। বাবার খোঁজে আমি বাজারের দিকে আসি। বাজারের কাছাকাছি আসতেই দেখি পশ্চিম পাশে ধানের ক্ষেতে একটি লাশ পড়ে আছে। লাশটি উপুড় হয়ে ছিল। পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট। উপুড় হয়ে ছিল বলে চিনতে পারিনি। আমার সঙ্গে এলাকার আরও দু’জন ছিল। ভয়ে আমরা কেউ কাছে যাইনি।

বাজারে এসে দেখি সুকুমারের বাবার লাশ। সুকুমারদের বাড়ি ছিল বাজারের কাছেই। বাজারে ওদের দোকান ছিল। বাড়ির সবাই সরে গিয়েছিল। সুকুমারের বাবা ছিল বাড়িতে। তাকে গুলি করেছিল গলার পাশে। গায়ে ছিল জড়ানো লেপ। ভয়ে লেপ জড়িয়ে দরজার পাশি গুটি মেরেছিলেন। ওই অবস্থাতেই গুলি খেয়ে পড়েছিলেন। খানিক সামনে এসে দেখি আরও একজনের লাশ। সে ছিল একজন মিস্ত্রি। কাওরাইদ বাজারে সে মিস্ত্রির কাজ করত। আমি তখন বাবাকে খোঁজার কথা ভুলে লাশের খোঁজ করতে থাকি। স্টেশনের পেছনে মাঠে দেখি গলবৎ মাড়োয়ারীর লাশ। লাশটি গলা থেকে পেট পর্যন্ত ফেঁড়ে রেখে দিয়েছে। মারোয়ারীর ভুঁড়ি ছিল বিশাল। পরে লোকে বলল পাঞ্জাবীরা হয়ত ভেবেছিল গলবৎ নিশ্চয়ই পেটের ভেতরে টাকা পয়সা জমা রেখেছিল। কাওরাইদ বাজারে প্রেমানন্দ নামে এক এক পাগল ছিল তখন। প্রেমানন্দ পাগলকে হত্যা করে লাশটি অর্ধেক মাটিতে পুঁতে রেখে দেয়। গলবৎ মাড়োয়ারী ও প্রেমানন্দের লাশ ছিল পাশাপাশি। একদিন পর প্রেমানন্দের সম্প্রদায়ের লোকেরা এসে লাশ নিয়ে যায়। নিজের গ্রামে তাকে কবর দেয়া হয়। এখন সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এর এক সপ্তাহ পরে পাঞ্জাবীরা ঘাঁটি করে কাওরাইদ বাজারে। ঘাঁটি করার পর অত্র অঞ্চলে চালায় নির্মম নির্যাতন। যাকে যেখানে দেখতে পায় তাকেই গুলি করে মেরে ফেলে। এখানে নারী নির্যাতনও হয়েছে বেশ কিছু। তবে সম্ভ্রম বিবেচনায় কেউ স্বীকার করেনি। ঘটনাচক্রে একটি নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। সেই পরিবারের লোকজনের সাথে আমিও আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। ধর্ষিতা ছিল বাড়ির বৌ। মেয়েটির ভাসুর আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে নিয়েছিল। আমি কারো কাছে কখনো যেন প্রকাশ না করি। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। বিয়াল্লিশ বছরে প্রকাশ করিনি। তাই নাম পরিচয় বলতে পারলাম না। কাওরাইদ বাজারের এক মাইলের সব ছিল ফর্সা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব ছারখার করে দিয়েছিল। পরে মুক্তি বাহিনী ঘাঁটি করে হাসেম মৃধার বাড়ি। এলাকার লোকজন খাদ্য সরবরাহসহ সর্বাত্মক স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতা করে মুক্তিবাহিনীকে। তখন মানুষের মাঝে কোন দল ছিল না। সবার লক্ষ্য ছিল এক। দেশের স্বাধীনতা অর্জন। এবং শত্রু পাকিস্তানি সৈন্য নিধন। আমি গর্বিত যে সেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ ছিল পরিবারের সম্মতিতে।

আমার কাজ ছিল শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখা। বাজারে ও আশেপাশে গরু ছাগল চরানোর অজুহাতে আমি সেই কাজটি করতাম। ময়লা ছেঁড়া ফাঁড়া হাফপ্যান্ট বা লুঙ্গি থাকতো পরনে। গা কখনো উদোম। কখনো বা প্যান্টের মতোই জরাজীর্ণ গেঞ্জি। গরু চরানোর ভান করতাম সারাদিন। শত্রুর গমনাগমনের খবর সংগ্রহ করে আমার এক মুক্তি ভাইয়ের মাধ্যমে পৌঁছে দিতাম মুক্তিবাহিনীর কাছে। আমার আরও একটি কাজ ছিল। সংগৃহীত সকালের নাস্তা মুক্তির বাঙ্কারে পৌঁছে দেয়া। তারিখটি আজ আর মনে নেই। তবে দিনটি ছিল শনিবার। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল এক সঙ্গে তারা তিনটি স্থানে আক্রমণ চালাবে। স্থান তিনটি হল গোলাঘাট, পিঠাগৈড় ও কাওরাইদ ক্যাম্প। গোলাঘাট, পিঠাগৈড় আক্রমণ সফল হলেও কাওরাইদ ক্যাম্প আক্রমণ সফল হয়নি। কাওরাইদ পৌরসভার সামনে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালে সঙ্গে সঙ্গে শত্রু সৈন্য প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে। পিছু হটার সময় ক্যাম্প থেকে প্রায় দেড় কিলো দূরে একটি ঝোপড়া জঙ্গলের পাশে গুলির বাক্স ফেলে যায়। পরদিন তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী রাতের অন্ধকারে সেই গুলির বাক্স উদ্ধার করে জমা দিই মুক্তিবাহিনীর হাতে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কাওরাইদ বাজারের আরও দুই দুঃসাহসিক যুবকের নাম উল্লেখ করতে হচ্ছে। তারা হল বাবুল ও মান্নান। মান্নান মারা গেছে। বাবুল বর্তমানে কাওরাইদ বাজারে বাবুল বাবুর্চি নামে পরিচিত। যুদ্ধের এক পর্যায়ে একদিন মান্নান টঙ্গী ব্রিজের কাছে নারী সেজে পাক সৈন্যদের প্রলুব্ধ করে। শাড়ি পরিহিত মান্নানকে ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নারী লোলুপ একজন পাকসৈন্য মান্নানের দিকে এগিয়ে আসে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে মান্নান সৈন্যটিকে ধরে ফেলে এবং ব্রিজের অদূরে জঙ্গলে নিয়ে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। বাবুল বাবুর্চি তাকে সহযোগিতা করে। পাকসৈন্যটির সাথে একজন বিহারীও ছিল। তাকেও হত্যা করে। হত্যা করার সময় মান্নানের হাতের কব্জি কেটে যায়। সে কব্জি আর সারেনি। সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায় মান্নানের হাত। তারপর পালিয়ে টঙ্গী থেকে কাওরাইদ চলে আসে। কাওরাইদ এসে তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনটি পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান অসামান্য।


লেখক : শিক্ষক

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test