E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা বললেন মাহবুবুল

‘স্ত্রীকে বলি, বেঁচে থাকলে দেখা হবে, যুদ্ধে গেলাম’

২০১৪ নভেম্বর ২৪ ১৬:৪৬:২৯
‘স্ত্রীকে বলি, বেঁচে থাকলে দেখা হবে, যুদ্ধে গেলাম’

শ্রুতি লিখন : শঙ্করী দাস : ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পূর্ব থেকে আমি এর সাথে যুক্ত। মূলত: ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল তখন থেকে আমি এই সংগ্রামের অংশীদার হই। পাকিস্তানী সামরিক শাসক দ্বারা বাঙালী জাতির শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন একজন শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার বিবেককে তাড়িত করে। বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার চেতনায় আমি এই মহান মুক্তিযেুদ্ধ নিজেকে সম্পৃক্ত করি।

১৯৬৯ সাল থেকে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ছিল টালমাটাল। ১৯৭০ সালে দেশে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হল। কিন্তু ফলাফলে একদিকে যেমন ছিল আশা ব্যঞ্জক অন্যদিকে তেমনি ছিল শঙ্কার। আওয়ামীলীগের নিরংকুশ বিজয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী মেনে নিয়ে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এ আশঙ্কা অনেকের মনেই ছিল। সে আশঙ্কা সত্যে পরিণত হল একাত্তর সালে। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন ৭ মার্চে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণে পরিস্কার হয়ে গেল যে একটি সশস্ত্র সংঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের পাকিস্তানিদের সাথে রাজনৈতিক রফা করতে হবে এবং সেই সংঘাতের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে বাঙালিদের।

তাই ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের পর আমরা যুদ্ধ ঘোষণার আগেই যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকি। ভাওয়াল চাঁদপুরে আমরা সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। আমি ছিলাম সেই কমিটির আহ্বায়ক। মাহমুদুল হাসান বেনু সাহেব এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পূর্ণ উদ্যোমে ভাওয়াল চাঁদপুর কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে আসে ২৬ মার্চ। ছাব্বিশ মার্চ সকালে বিবিসি শুনে ঢাকায় শুরু হয়ে যাওয়া যুদ্ধের খবর পাই। আমরা তাৎক্ষণিক সবাই একত্রিত হয়ে কী করা যায় তাই নিয়ে আলোচনা শুরু করি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার খবর লোক মুখে আসতে থাকে। কিন্তু সেই খবর কতটা ভয়ঙ্কর সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

২৭ মার্চে আমরা খবর পেলাম জয়দেবপুর রাজবাড়ী বাঙালী অফিসারদের গ্রেনেড চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তখন আমরা জরুরি বৈঠক করে বাকি বাঙালী সৈন্যদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেই। এই উদ্দেশ্যে প্রথমত আমরা মার্তা গ্রামে যাই। মার্তা গ্রামটি জয়দেব পুরের নিকটবর্তী। মার্তা গ্রামে পৌঁছেই মাঠে দেখতে পাই দুজন আহত বাঙালী সৈন্য। তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাঠে পড়ে ছিল। তাদের উদ্ধার করে আমার বাড়িতে পাঠাই। জয়দেবপুরের অবস্থা এতটাই সঙ্গীন ছিল যে, নিরস্ত্র অবস্থায় আমাদের রাজবাড়ী ক্যাম্পে তো দূরের কথা জয়দেবপুর ঢোকাও সম্ভব হল না। ব্যর্থ হয়ে আমরা ভাওয়াল চাঁদপুরের দিকে রওনা হই। সন্ধ্যার পর বাড়ী ফিরে আসি। বাড়ীতে এসে দেখি পঁচিশ ছাব্বিশ জন সৈন্য আমার বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। এদের বেশির ভাগই আহত। আমি এদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করি। ওষুধ সংগ্রহ করি এবং শুশ্রষা দিই। তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী পরদিন বর্মী যাওয়ার ব্যবস্থা করি লঞ্চে করে।

তখন জয়দেবপুর রাজবাড়ী ক্যাম্পে আমার একজন ছাত্র ছিল আর্মি। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাম ছিল হারুন অর রশিদ। তাঁর গ্রামের নাম জলিশা চাঁদপুর। জয়দেবপুর ক্যাম্পে শহীদের তালিকায় তাঁর নাম আছে কিনা জানিনা। তবে হারুন অর রশিদ স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদ বাঙালী সৈনিক।

এরপর আমরা চরমভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই। ব্যাপক লোককে সংগঠিত করি। এদের মধ্যে বিভিন্ন পেশার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সবাই ছিল। ছিল নানা বয়সের লোকজন। এক পর্যায়ে জানতে পারি যুদ্ধের জন্য ভারতে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। তখন ভারতে লোক পাঠাই খোঁজ খবর নিতে এবং সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার গ্রুপ ঠিক করি। এরি মধ্যে কাপাসিয়া ক্যাম্প থেকে হঠাৎ একদিন পাকসেনা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে। তারা প্রথমত আমার বাড়ি ও হিন্দু বাড়ি গুলি জ্বালিয়ে দেয়। ব্যাপকভাবে এলাকায় লুটতরাজ চালায়। আমি বাজারে ছিলাম। সময় ছিল নাস্তা খাওয়ার বেলা। চাঁদপুরের দিকে পাকসেনা আসছে খবর পেয়ে দৌড়ে গ্রামের সবাইকে সংবাদ পৌঁছায়। সেদিন গ্রামের সকলের সম্পদ ক্ষতি হলেও প্রত্যেকেই প্রাণে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাজার থেকে বেড়াতে আসা এক বেয়াই ও আমার বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের আটকে রাখে টঙ্গী ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন তাদের উপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। ইয়াহিয়া ক্ষমা ঘোষণা করলে তারা মুক্তি পান।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমরা নিরাপদ নই। ঢাকা ম্যাসাকার এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অত্যাচারের যে খবরাখবর আসছিল তাতে এ ব্যাপারে সবাই নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম। পাক ফৌজ চাঁদপুরে ঢোকার পর আমি আর চাঁদপুরে অবস্থান করা যুক্তিযুক্ত মনে করলাম না। তখন আমার দুই কন্যা সন্তান এবং স্ত্রী তৃতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা। ঠিক করি এদের একটা আশ্রয়ে রেখে ভারতে চলে যাবো। কিন্তু সে সুযোগ হয়না। খবর আসে চাঁদপুরে আবার পাকসেনা আসবে। সে দিনই গভীর রাতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বের হয়ে পড়ি। আমাদের বাড়ীর মাইল খানেক দূরে একটি বিল ছিল। প্রথমত সেখানে যাই। সেই বিল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ কোথাও আশ্রয়ের চিন্তা করি। নৌকা করে বিল পাড়ি দেই। বিলের পাড়ে মহিষবাথান নামে যে গ্রাম সেখানেই আমি নেমে যাই। স্ত্রী এবং সন্তানরা থেকে যায় নৌকায়। এখান থেকেই তাদের সাথে আমি বিছিন্ন হই। সে সময় মানসিক বিপর্যয় বলে বা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। স্ত্রীকে বলি বেঁচে থাকলে দেখা হবে। যুদ্ধে চললাম। আমার সন্তানদের দেখ। স্ত্রী তখন পূর্ণমাস অন্তঃসত্ত্বা। চারদিন পর এক ছেলে সন্তান জন্ম নেয় এবং পাঁচ দিন পর আমার সেই ছেলে সন্তানের মৃত্যু হয়। তার নাম রাখা হয় বিপ্লব। স্ত্রী আশ্রয় নিয়েছিল বাপের বাড়ি পাবুর গ্রামে। আমার কথামত পরিচিত মাঝি মাল্লারা তাদের সে রাতে পাবুরে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিল।

মহিষাবাথান গ্রামে অবস্থান করে আমি চাঁদপুর ও আশেপাশে লোকজনের সাথে গোপনে যোগাযোগ করি এবং সবাইকে মহিষাবাথান বিলের পাড়ে আসতে বলি। আমার পাঠানো সংবাদের ভিত্তিতে তারা দ্রুত বিলের পাড়ে উপস্থিত হয়। তারিখটি ছিল ৭ জুলাই। বিলের পাড়ে সবাই একত্রিত হয়ে রায়পুরার দিকে হাঁটতে শুরু করি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল রায়পুরা হয়ে ভারত চলে যাবো। আমরা খবর নিয়েছিলাম যে রায়পুরা হয়ে হাজার হাজার লোক দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পুরো রাস্তা আমরা পায়ে হেঁটে রায়পুরা পৌঁছি। মেঘনা নদীর পাড়ে রায়পুরা। নদীর পাড়ে রায়পুরা হাইস্কুল। আমরা রায়পুরা হাইস্কুলে যাই। সেখানে বহু লোকজন হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। এরা সবাই ভারত যাবার অপেক্ষায়। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ভারত গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নেবে। দেশে ফিরে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অভ’তপূর্ব সাড়া। কারো ভেতর এতটুকু মৃত্যু ভয় নেই। নেই মাতৃভূমি ও স্বজন ছেড়ে যাবার বেদনা। একচল্লিশ বছর পরেও সেই দিন গুলো মনে হলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। মাতৃভূমি মানুষের কাছে কতটা প্রিয় হতে পারে একাত্তরের সেই দিনগুলো তা প্রমাণ করে দিয়েছে।

আমরা হাইস্কুলটিতেই আশ্রয় নেই। পরদিন পহর খানেক রাতে দেখি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা একটি নৌকা ভাসাল মেঘনা নদীতে। নৌকায় বসে দরাজ গলায় কাউয়ালি গাইতে শুরু করল। অন্যদিক থেকে পাকফৌজের একটি নৌকা কাউয়ালি গাইতে গাইতে এগুতে শুরু করে। পাকফৌজের ধারনা এরা তাদেরই লোক। ওরা মুক্তির নৌকার কাছে আসতে থাকে। এদিকে ছেলেরাও প্রস্তুতি নেয়। ওদের নৌকা কাছে আসা মাত্রই ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে এবং নৌকা ডুবিয়ে দেয়। সাথে পাকফৌজও ডুবে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা কোন প্রতিরোধের সুযোগ পায়নি। জীবিত একজন সেনাকে ছেলেরা তীরে টেনে তুলে আনতে সক্ষম হয়। তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তোমরা এখানে এসেছ কেন? সে জবাব দেয় যে, তাদের বলা হয়েছিল এখানে সব হিন্দু। হিন্দু মেরে ফেলতে হবে। লোকটি জানায় সে পাঞ্জাবের একটি গোডাউনে প্রহরীর কাজে নিযুক্ত ছিল। মুক্তিরা তাকেও আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেরে নদীতে ছুড়ে ফেলে। কাউয়ালির কৌশলটি নেয়া হয়েছিল ওদের ধরার জন্য। এখানে উল্লেখ্য রায়পুরা হাইস্কুলে সে সময় আশ্রয় নেয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে অপেক্ষমান গ্রুপগুলোর কোন কমান্ডার ছিলনা। নিজেরাই সার্বক্ষণিক পরামর্শ করত। আর শত্রু নিধনে নানা রকম কৌশল উদ্ভাবন করত।

এই ঘটনার পর আমরা নিজেদের ওখানে নিরাপদ মনে করলাম না। যেহেতু ওদের লোক হতাহত হয়েছে অতএব আমাদের বিপদ অনিবার্য। মাঝরাত থেকেই গ্রুপগুলো বেরিয়ে যেতে শুরু করল। আমরা ভোরে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে চারগাছ নামে একটা জায়গায় পৌঁছি। চারগাছ থেকে আবার নৌকা করে ইন্ডিয়ান বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। তখন বেশ রাত। নৌকায় উঠতেই মাঝিরা নিচে যেতে ইশারা করল। আমরা পাটাতনের নিচে গেলাম। উপরে রাখা হল লাকড়ি। সে সময় নৌকার চালকরা মুক্তিবাহিনী ও যুদ্ধে অংশগ্রহনেচ্ছু ছেলেদের এভাবেই পারাপার করত। শরনার্থীদেরও এ ভাবে পারাপার করা হত। নিচে মানুষ উপরে পাট অথবা লাকড়ি। আমরা ছিলাম চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জনের একটি দল। এ দলে শুধু জয়দেবপুরের লোক ছিল না। ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানের।

দুপুরে আমরা ইন্ডিয়ান বর্ডারের খুর কাছে আসি। জায়গাটা একটা টেকের মত। চারদিকে নির্জন। কাছে জীবিত কোন জনপ্রাণী নেই বলে অনুভ’ত হচ্ছে। মাত্র আমরা নৌকা থেকে নেমে টেকে পা রেখেছি, হঠাৎ কয়েকজন বন্দুকধারী আমাদের ঘিরে ফেলে। আমরা কেউ কিছুই বুঝতে পারি না। মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। বন্দুকধারীরা অস্ত্রের মুখে কাছেই একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। সবাইকে আটকে রাখল ঘরে। প্রস্তাব দিল টাকা দিলে আমাদের ভাত খেতে দেবে। আমরা রাজী হয়ে গেলাম। কিন্তু ভাবিনি ভাত দেবে। সত্যি সত্যিই ভাত দেয়া হল। ঘরের ভেতরে আটকে রেখে। এদের পরিচয় এবং উদ্দেশ্য কি ছিল ভয়ে মুখ ফুটে সেদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি। রহস্যজনক বিষয়টি আজও আমার অজানাই থেকে গেল।

সন্ধ্যার দিকে আমাদের বলা হল কিছুক্ষণ পর অর্থাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে তিনটি ফায়ার হবে। ফায়ার হলে আপনারা সি এন্ড বি পার হবেন। ওরা আমাদের ছেড়ে দিল। কিন্তু নজরে রাখল। ফায়ার হলে ওদের কথা মত আমরা রাস্তায় উঠলাম। এ ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প ছিল না। আমরা ছিলাম নিরস্ত্র। রাস্তায় দাঁড়ালে ওরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জলে ফেলে দিল। পুরো এলাকাটাই ছিল নিচু। চারদিকে জলে থই থই করছিল। আমাদের ইশারা করল ইন্ডিয়ান বর্ডারের দিকে যেতে। জল ভেঙ্গে আমরা হেঁটে যেতে থাকি। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটি। জলে শব্দ হচ্ছিল। কাছে কোথাও পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। জলের শব্দে ওরা ফায়ার শুরু করল। তখন মধ্য রাত। ইন্ডিয়ান বর্ডার থেকে ওরাও শুরু করে ফায়ার। মাঝখানে আমরা। জলের পরিমান কম থাকায় কিছুটা উপুর হয়ে থাকতে পারি। সে ভাবেই সবাই থাকি। শেষরাতে ফায়ার বন্ধ হয়। উপরে উঠে আসি। তখন আর বন্দুকধারীরা কেউ নেই। তখনকার আমাদের মানসিক, শারীরিক অবস্থা অবর্ণনীয়। সামনে একটা রেলপথ দেখতে পাই। রেললাইন অতিক্রম করে আবারও একটা টেকের মত জায়গায় আসি। এখানে সমবেত হাজার হাজার লোক। সব অসহায় শরণার্থী আর যুদ্ধ উম্মাদ তরুণের দল। এখান থেকে নৌকা যোগে সবাই আগরতলা ঢুকছে। আমরা সেদিন নৌকা যোগে আগরতলার মাধববাড়ী পৌঁছি। মাধববাড়ী থেকে আমার দলের সবাইকে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে গ্রুপ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে পাঠানো হয় আগরতলা কংগ্রেস ভবনে।

আগরতলায় প্রতিদিন স্রোতের মত লোক আসছে। খোলা হয়েছে শরণার্থী শিবির। আমার পরিচিত লোকজনও পাচ্ছি। কয়েকদিন পর আমাকে পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগটি হয় ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে। আমার সাথে নিয়োগ প্রাপ্ত হন অধ্যাপক জগবন্ধু। তিনি তখন নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে জয়বাংলা ইয়ুথ ট্রানজিষ্ট ক্যাম্পে যোগদান করি। আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি বাঙালীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে মোটিভাইট করা। সকালে ও বিকেলে আমাদের ক্লাস চলত। সশস্ত্র ট্রেনিংএ যাবার আগে এখানে তাদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হতো। এখান থেকে আমি বহু ছেলেকে বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠাই। আমাদের লোকাচারের বিষয়গুলো ছিল যেমন: ছেলে মুক্তি বাবা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী না। তাকে ত্যাগ করতে হবে। অথবা তাকে হত্যা করতে হবে। আমাদের সিলেবাস দেয়া হয়েছিল। সম্পূর্ণটাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের উপর। মূলত ছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিটি বাঙালীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ধাবিত করা। নভেম্বরের শেষ পর্যায়ে ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয় আর্মি তখন সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ছিল শুধু ভারতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গেলে আমি অনুমতি সাপেক্ষে দেশে ফিরে আসি। তখন দেশে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল পুত্রশোক। আমি জানতাম না আমার সেই সন্তান আর বেঁচে নেই। মহিষবাথান বিলের পাড়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি।

যুদ্ধস্মৃতির আর একটি স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। আমি যখন কংগ্রেস ভবনে থাকি তখন একদিন রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে এল এক মহিলার আর্তচীৎকার। বাইরে এসে দেখি এক বৃদ্ধা। অঝোর বৃষ্টির মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে কাঁদছে। পাঁজা কোলে করে তাকে ভেতরে নিয়ে আসি। সেবা দিয়ে কিছুটা সুস্থ্য করে পরদিন শরনার্থী ক্যাম্পে পাঠাই। জানতে পারি বাংলাদেশ বর্ডার পার হওয়ার সময় ব্যাপক গোলাগুলির মাঝে ছেলে মাকে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে কিভাবে এখানে আসে মহিলা সেটুকু স্মরণে আনতে পারে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয় কতটা নিপীড়ন, নির্মম নির্যাতন হলে ছেলে মাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে!

আমাদের এই চরম বিপর্যয়ের দিনে ভারতের সর্বস্তরের জনগণ যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন ও সহায়তা করেছেন তা অতুলনীয়। তারা আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিণতি দান করেছেন। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সর্বোপরি বাঙালী জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী অবিস্মরনীয় অবদানকে স্মরণ করতে হবে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ঋণ আমাদের অপরিশোধ্য।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন : আলহাজ্ব মাহবুবুল আলম, প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধান শিক্ষক, ভাওয়াল চাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয়, কাপাসিয়া, গাজীপুর।



পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test