E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা বললেন হারেছা খাতুন

‘আমার মেয়ে দু’টোকে কিছুদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করে এবং পরে মেরে ফেলে’

২০১৪ ডিসেম্বর ০১ ১৮:৩১:২২
‘আমার মেয়ে দু’টোকে কিছুদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করে এবং পরে মেরে ফেলে’

শ্রুতিলিখন : শঙ্করী দাস : কয়েকমাস ধরে শুনতে পাচ্ছিলাম দেশে গন্ডগোল চলছে। কিন্তু যুদ্ধ হবে কেউ বলেনি। কেউ ভাবেওনি যে দেশে যুদ্ধ হতে পারে। হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হলে আমরা তাৎক্ষনিক মামা শ্বশুর বাড়ি সাইটালিয়া গ্রামে আশ্রয় নিই। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে ভিন্ন ভিন্ন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে যায়। সবার এক কথা গ্রামে একদিন পাঞ্জাবী ঢুকবে। আর পাঞ্জাবী ঢুকলে মেয়ে, বৌদের ধরে নিয়ে যাবে। বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেবে। যাকে পাবে তাকেই গুলি করে মেরে ফেলবে। এমতাবস্থায় আমরাও বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া মন স্থির করি। গ্রামে দু’চারজন যারা থেকে যায় তারাও খুব অস্থিরতার ভেতর দিন কাটাতে থাকে।

সাইটালিয়া গ্রাম ছিল ভিতরে। রাস্তাঘাট তখন ছিল খুব খারাপ। গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী থাকায় সে গ্রামকেই আমরা নিরাপদ মনে করি। এখানে আমরা পুরো তিনমাস কাটাই। তখনও সাত খামারে পাঞ্জাবী ঢোকেনি। হয়তো পাঞ্জাবী আর আসবে না ভেবে তিনমাস পর আমরা গ্রামে ফিরে আসি। বাড়ি ফেরামাত্র পাঞ্জাবী গ্রামে ঢোকে এবং বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মুহুর্তে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলাম আবার টেংরা গ্রামে। নিজের মামার বাড়ি। কাহাতক অন্যের বাড়ি। বাড়ি ফেরার ঠিক পরদিন রাতে পাঞ্জাবীরা আসে বাড়িতে। বাড়ি ঢুকে দরজা ধাক্কাতে থাকে। ভয়ে, আতঙ্কে তখন মনের কি অবস্থা হয়ে ছিল বলে বোঝাতে পারবনা। দরজা খুলে দেই। দরজা খোলার সঙ্গে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগে ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট শুরু করে। তারপর আমাদের বের করে এনে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সবগুলো ঘরে। আগুনে আমার গরু, ছাগল, শস্য ও অন্যান্য জিনিস সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আশেপাশের আরো কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয় একসাথে। আগুন দিয়ে বাড়ির মানুষগুলোকে এনে একত্রিত করে আমাদের সাথে। একত্রিত করে আমার বাড়ির কাছে লালবাগ নামে একটি জায়গায় বসিয়ে রাখে। আমার জ্যাঠা কলেমা পড়তে থাকে। পাঞ্জাবীরা আমার জ্যাঠাকে বন্দুকের নল দিয়ে জোরে আঘাত করতে থাকে। জ্যাঠা এক সময় উপুড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ধরা পড়া আতর আলি নামের ছেলেটি মায়ের কাছে পানি খেতে চায়। আতরের মা কেঁদে বলে, বাবারে পানি নাই। আতর আলির মার পরনের কাপড় ছিঁড়ে ওরা পুরুষদের চোখ বেঁধে ফেলে। কিছুক্ষণ পর মহিলাদের আলাদা করে এবং পুরুষদের বাঁধন খুলে লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর ব্রাশফায়ার করে। আমার বোনের স্বামীও ছিল সেই লাইনে। আমার বোন চিৎকার করে ওঠে। রাজাকাররা বলে মরেনি। কাল আসবে।

সেদিন সাতজন জ্বলজ্যান্ত মানুষকে এক পলকে মেরে ফেলা হল আমার চোখের সামনে। এদের অনেকেই ছিল আমার আত্মীয়। আমার স্বামীকে তখন মেরে ফেলেনি। ধরে নিয়ে গেল। সাথে নিয়ে গেল আরও দুটি মেয়ে। একজন নতুন বিবাহিত। অন্যজন সাতমাসের অন্তঃসত্তা। আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে রেখেছিল লুট করা গরু শ্রীপুরে ওদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার জন্য। অন্তঃসত্তা মেয়েটিকে পাঞ্জাবীরা জাপটে ধরে রেখেছিল। যখন ওরা চলে যায় মেয়েটির গায়ে শাড়ি ছিল না। পাঞ্জাবীদের বাহুর মধ্য থেকে আর্তনাদ করে অনুনয় করেছিল । বড় বীভৎস সে দৃশ্য। চোখে না দেখলে কোনক্রমে বোঝানো সম্ভব নয়। মেয়ে দু’টোকে কিছুদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করে এবং পরে মেরে ফেলে। চল্লিশ বছর পরও সে সব স্মৃতি আমারেএকটুও ম্লান হয়নি। যুদ্ধদিনের স্মৃতি এখনও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। একদিন ভাত রান্না শেষ করেছি। এই মুহুর্তে খবর আসে পাঞ্জাবী আসছে। শুধু ভাতের হাঁড়ি নিয়ে দৌড়তে থাকি। বাকি সব কিছু ফেলে। পেছনে ছোট ছোট বাচ্চারা। প্রায় এক মাইল পর্যন্ত দৌড়ে পেছনে ফিরে তাকাই। এ জায়গাটা ছিল একদম জঙ্গলের ভেতরে। জায়গাটার নাম ডালেশ্বর।

স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল আর ফিরে এলো না। পরে জানতে পারি শ্রীপুরের পাশে লোহাগাছা গ্রামে রেললাইনের পাশে গুলি করে ফেলে রেখেছিল। স্বামীর লাশটিও দেখতে পেলাম না। এদিকে পোড়া বাড়িতে থাকার অবস্থা রইল না। গ্রামের অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেই। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাই। আমার ছোটছেলের বয়স তখন তিন বছর। বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও চোখের সামনে পরিচিত মানুষের হত্যাকাণ্ড দেখে আতঙ্কে পরদিন তার খালুর সঙ্গে চলে গেল। সেই যে গেল, আর আমার কাছে ফিরে এল না। স্বামীকে হারালাম, ছেলের সঙ্গেও সৃষ্টি হলো আমার দুরত্ব। আজ পর্যন্ত সে আমার কাছে এসে থাকে না। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যায় এতটুকুই। পাঞ্জাবীরা আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। স্বামীর স্মৃতি মনে হলে বিয়াল্লিশ বছর পরেও ধৈর্যধারণ করতে পারিনা। বাঁধ ভাঙ্গা চোখের জলে বুক ভাসাই দিনের পর দিন রাতের পর রাত।

আতর আলির কথা আগেই বলেছি। সেই আতর আলির বাস্তভিটাতেই সাতখামাইর একাত্তরের গণকবর। পাঞ্জাবীরা আতর আলিসহ সাতজনের লাশ এক সঙ্গে করে এখানেই কবর দিয়েছিল। এ কবরে স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মবলি দিয়ে আমার স্বজনেরা চিরনিদ্রিত হয়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন : গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার সাতখামাইর গ্রামের গৃহবধূ হারেছা খাতুন

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test