E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

১৭ মে ১৯৮১ : বাঙালির উৎসবের দিন

২০১৫ মে ১৭ ১৪:৫১:১৯
১৭ মে ১৯৮১ : বাঙালির উৎসবের দিন

মোঃ মুজিবুর রহমান : আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে আবেগ আশ্রয়ী বাংলার মাটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  এদিনে  ফিরে আসার দিন। এ ছিল পুরনো মাটিতে নতুন করে ফিরে আসা।

সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে জননেত্রী শেখ হাসিনা পা রেখেছিলেন। এর আগেও তিনি বিদেশের মাটি থেকে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন । তবে চৌত্রিশ বছর আগে ১৯৮১ সালের আজকের দিনটির সঙ্গে ফিরে আসা অন্যদিনগুলো মেলানো যাবে না। এদিকে তখন বাঙালি ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের দখলদারি ও জবরদস্তি শাসনে, ছিল তাদের যাঁতাকলে পিষ্ট। তখন ছিল বাঙালিকে পাকিস্তানপ্রেমী বানানোর সে সময়কার শাসকচক্রের চরম প্রক্রিয়া। সেজন্য বলতে হচ্ছে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বপ্নের সোনার বাংলা ফিরে পাননি। বরং ছিল পথের বাঁকে বাঁকে বিছানো ছিল বাধার কাঁটা এ কাঁটার ভয় উপেক্ষা করে তিনি ফিরেছিলেন মাতৃভূমিতে। কি ভরসায় তিনি ফিরেছিলেন? জবাবটি হবে মানুষের ভালবাসা ও আস্থার ওপর ভরসা রেখে। অনুভূতি ও আবেগের বিবেচনায় আজকের দিনটি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যেমনটি স্মরণীয় তেমনি মুক্তিকামী বাঙালির স্মৃতিতেও আজকের ১৭ মে দিনটি উজ্জ্বল।

চৌত্রিশ বছর আগের এই দিনে জননেত্রী শেখ হাসিনা ছয় বছর প্রবাস জীবন থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করার পর তাঁকে এক নজর দেখার জন্য কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে অগণিত মানুষ বাস, ট্রাক, লঞ্চ, স্টীমার ও ট্রেনযোগে দেশের দূরদূরান্ত থেকে ঢাকা এসে সমবেত হয়। এদিকে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে অধিকারবঞ্চিত মুক্তিপাগল তথা গণতন্ত্রকামী লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী শ্লোগান ওঠে, ‘ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘আদর্শের মৃত্যু নেই, হত্যাকারীর রেহাই নেই, শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলানগর পর্যন্ত জনসমুদ্র। রাজধানীর সব পথ মিশে গিয়েছিল বিমানবন্দরে। সবার লক্ষ্য ছিল বিমানবন্দর। শাসক মহলের কাছে তো ছিল কল্পনার অতীত। শাসক মহল ধারণা করতে পারেনি যে এভাবে মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে ছুটে আসবে। সত্যিকার অর্থে দেশবাসী তো চাইছিল অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি।

১৮ মে ১৯৮১, সোমবার, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ই মে, ১৯৮১) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিছিল। শুধু মিছিল আর মিছিল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। শ্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের শ্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে। গতকালের ঢাকা ন’বছর আগের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি যে দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে এসেছিলেন, সে দিন স্বজন হারাবার কথা ভুলে গিয়েও লাখ লাখ জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। গতকালও হয়েছে তাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল ছ’ঘন্টা।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে।’ এছাড়াও ১৮ মে ১৯৮১, ঢাকা থেকে প্রকাশিত অন্যান্য সংবাদপত্রে তাঁর প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়। ১৭ মে ১৯৮১, বনানীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মায়ের ও নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ওই সময় প্রবাসে অবস্থান করায় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পান। ৩৩ বছর আগে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে দেশে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর নেতৃত্ব সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ওই বছর ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন এবং মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে অংশ নেন।

বিশাল সংবর্ধনায় ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘ আমি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-সহ পরবর্তীকালে বিভিন্ন হত্যাকা-ের বিচার চাই। বিচার চাই জনগণের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। আপনারা আমার সাথে ওয়াদা করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।’ এখানে উল্লেখ করতে হয়, স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্ব হতেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির প্রতি জনমত সংগঠনের কাজে প্রবাস জীবনে সার্বক্ষণিক আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় আর এক সংগ্রামের ইতিহাস। এদিকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনে নানামুখী কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতি পায় নতুন আশার আলো। গুণগত পরিবর্তন হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের।

সেই থেকে চৌত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির কা-ারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। অধিকারহারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।

স্বৈরশাসকবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি গৃহবন্দি হন। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় এক বছর কারান্তরীণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যেমন যোগ্যতার সঙ্গে দিয়ে চলেছেন তেমনি তিন বার জনগণের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার সঙ্গে রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি এখনো তিনি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে উন্নয়ন-সংস্কারের বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেন। দ্বিতীয় ও বর্তমান মেয়াদকালেও তিনি বহু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও সেগুলো করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিষ্পত্তি, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণসহ বাস্তবায়ন, শিক্ষা নীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার ও পর্যাপ্ত তহবিল যোগান বিষয়ের দাবি জোরালোভাবে বিশ্বপরিমণ্ডলে উত্থাপন, গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন, সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিজয় অর্জন, শ্রমজীবী মানুষের জন্য শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ, দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল ভারতের লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার বিষয়ে সফল কূটনৈতিক উদ্যোগগ্রহণসহ অসংখ্য কর্মকা- বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়, বলিষ্ঠ ও যোগ্য নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ। তিনি রাজনীতিতে এসে তাঁর পিতার ন্যায় দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য সংগ্রাম করছেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখে দেশ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

তাঁর নেতৃত্বে আজ বিশ্বের বুকে ক্রমেই মাথা উঁচু দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। চারিদিকে ছডিয়ে পড়ছে সমুদ্রজয়ী ও সীমান্তজয়ী কন্যা শেখ হাসিনার সাফল্যগাথাঁ। অন্যদিকে এই চৌত্রিশ বছরে প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে একরকম মোকাবেলা করে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর মানুষের প্রতি নিগূঢ় ভালবাসা রয়েছে।

অন্যদিকে তিনি বাবা-মায়ের মতই পার্থিব লোভের উর্ধে থেকে সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র দিনটির জন্য বাঙালি জাতি অপেক্ষা করেছে ছয়টি বছর। এ দিনটিতে সব বাধা উপেক্ষা করে বাঙালিকে আত্মার বাঁধনে বাঁধতে বাংলার মাটিতে পা রেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা।

সেদিন সমগ্র বাঙালি জাতি আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। তাই তো বাঙালির উৎসবের দিন আজ। এদিন বাঙালি পায় নতুন করে প্রেরণার উৎস। এদিন থেকে বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শত কষ্টের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাবা-মায়ের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হননি। তার প্রমাণ বহু রয়েছে। জাতির পিতার বাসভবন তিনি উৎসর্গ করেছেন এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই দিনে তাঁর প্রতি অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

লেখক : শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং আর্কাইভস ৭১ এর প্রতিষ্ঠাতা

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test