E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গ্রামীণ নারী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা 

২০১৫ ডিসেম্বর ১৫ ১৭:২৫:৩৭
গ্রামীণ নারী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা 

মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল : মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা ও গ্রামের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা উভয় স্থানেই উপেক্ষিত। এই উপেক্ষা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।

দেশের মূলধারার ইতিহাস সবসময় রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়ায় রচিত ইতিহাস। জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র তৈরি করে কিন্তু সমাজ গঠন করে না, এটা আমারা প্রায়শঃই ভুলে যাই। সমাজের ইতিহাস সবসময় রাষ্ট্রের ইতিহাস থেকে আলাদা হয়ে থাকে।

আমরা সবসময় রাষ্ট্রের ইতিহাস বর্ণনা করে থাকি এবং আমাদের ভাবনা-চিন্তা কেবলই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এমনকি রাষ্ট্রনেতা ব্যতীত কোনো ইতিহাসকে মৌলিক ইতিহাস মনে করি না। বাংলাদেশের যে ষোড়শ’ খন্ডের ইতিহাস রচিত হয়েছে সেখানেও রাষ্ট্রের ইতিহাসই বিধৃত হয়েছে। আমাদের পাড়াগাঁয়ের মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধা এবং সাধারণ কুলবধূর ভূমিকা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের গ্রামের চিত্রের দিকে তাকালে সেখানে মানুষ নির্যাতিত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল অর্থাৎ বহুলাংশে যুদ্ধটা সম্ভব করে তুলেছিল। কিন্তু তাদের এই অংশগ্রহণ রাষ্ট্রিক ছিল না, ছিল সামাজিক।

বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হয়েছে; কিন্তু দেশের মানুষের জীবন, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, টিকে থাকা ইত্যাদির ইতিহাস তৈরি হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হলেও গ্রামীণ যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ নারীর ভূমিকা উপেক্ষিত থেকে গেছে। এরা সবসময় ইতিহাসের নিচের তলার বাসিন্দা হয়ে এসেছে, কখনো মূলধারায় স্থান পায়নি। কারণ, ওই যে আমরা রাষ্ট্রের ইতিহাস তৈরি করি। বাইরের কিছু এর ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে আমরা বিব্রত ও চিন্তিত হই। কেননা তাতে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে অনেক উত্তর দেয়ার দাবি রাখে।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালিরা একত্র হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের রাজনীতিবিদরা সবসময় এড়িয়ে গেছেন, শুধু রাজনীতিকরাই নন-সবাই এড়িয়ে গেছেন। কারণ ওই একত্রিত মানুষ ও তাদের সমন্বিত যুদ্ধের মাধ্যমে করায়ত্ব ভূ-খন্ডের সামাজিক ইতিহাসের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। স্বল্পসংখ্যক মানুষ এই ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করে।

অনেক সময় অনেকে টেলিভিশনের টকশো বা লেখালেখিতে দেশের চলমান অবস্থা ও রচিত ইতিহাসকে ভাবনায় নিয়ে দুঃখ ও অভিমান প্রকাশ করে বলেন ‘আমরা কি এ রকম দেশ চেয়েছিলাম, এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। কথাটা শুধু অনেকে নয়, আমরা অর্থাৎ মধ্যবিত্তের লোকজনও বলে থাকি। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে অনুধাবন করা যাবে, আমরা এ রকম একটি দেশই চেয়েছিলাম। কেননা সে সময় আমরা অর্থাৎ আমাদের একটি বিশেষ ‘শ্রেণি’ই যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্বে ছিল, তারাই যুদ্ধের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা সমাজের শ্রেণি বৈষম্যে বেড়ে ওঠেছে, সে বৈষম্য লালনও করেছে, কেউ অজান্তে আবার কেউ অবচেতনে। তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সে রকম একটি রাষ্ট্রই আমরা পেয়েছি, যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, যেমনভাবেই হোক চালাতে পারি, যার ভিত্তিতে আমরা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারি।

প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে আমরা ওই কথা বলি কেন? উত্তরে বলা যায়, আমাদের নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে আমরা ওই কথা বলি। এটা আমাদের প্রয়োজনীয় হিপোক্রেসি বৈ অন্যথা নয়। আমরা মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে বলতে থাকি, সামরিক ও বেসামরিক রাজনীতিবিদদের জন্য আমরা যেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম তা পাইনি। এ বিষয়ে একমত হওয়ার অভিপ্রায় জাগে না, হইওনা। কারণ সুবিধাভোগীরা এমন রাষ্ট্রই চেয়েছিল, যেখানে তারা সুবিধা পাবে। তারা সফল হয়েছে। সেই সাফল্যের ভিত্তিতে তারা যখন ইতিহাস রচনা করতে শুরু করে তখন তারা নিজেদেরই সফলতার ইতিহাস বর্ণনা করেছে।

ইতিহাসে রাষ্ট্রের বড় বড় লোকের কথা এসেছে, তাদের সহযোগী হিসেবে যারা ছিল, তাদের কথা এসেছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ৬৮ হাজার গ্রাম ও গ্রামের কুলবধূর বিশেষ ভূমিকাও কখনোই ইতিহাসের মূলধারায় আসেনি কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের ইতিহাস প্রয়োজনীয় নয়। তাছাড়া মূলধারায় নিয়ে এলে তাদের যে দাবিদাওয়া আছে, তা পূরণ করার প্রশ্নটাও সামনে চলে আসে, এই ভয়ও রয়েছে। ১৯৭১ সালে তাদের অংশগ্রহণ ছিল বলে স্বীকার করলে তাদের দাবিদাওয়া থাকবে, অবদানের স্বীকৃতি সে দাবিকে পোক্ত করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ জন্যই এড়িয়ে চলা-এটা অস্বাভাবিক নয়।

আবার অনেকেই মাঝে মধ্যে বলে থাকেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে, মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো চলমান, এখনও পরিপূর্ণ ইতিহাস বর্ণনা করা হয়নি; পরিপূর্ণ ইতিহাস বর্ণনা করার পর তা হারানোর প্রশ্নটা আসতে পারে বলে মনেকরি-তার আগে নয়। সত্যি বলতে, আমরা কখনোই মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ ইতিহাস জানতে চাইনি। আমরা কখনোই জানতে চাইনি মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের লোক বা নারী কিংবা কন্যা-জায়া-জননীদের কী ভূমিকা ছিল। বরং আমরা সবসময় রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক নাকি জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক এ নিয়ে আমাদের বিতর্কের শেষ নেই। আমরা এ বিতর্ক বাঁচিয়ে রাখছি সুবিধাভোগী শ্রেণিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। বিতর্ক বাঁচলে ইতিহাসে অন্যদের ভূমিকা স্বীকার করতে হবে না। এসব নানাবিধ বিতর্কের কারণেই ইতিহাস থেকে বাদ পড়েছে গ্রামের হাজারো সাধারণ মানুষ ও নারী যোদ্ধা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীরাঙ্গনারা চরম নির্যাতিত মানুষ। ১৯৭১ সালে ধর্ষণের ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি এক রকম ছিল না। আমাদের মিডিয়ায় দেখানো হয়, মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেয়ার কারণে পাকিস্তানি সেনারা নারীকে এসে ধর্ষণ করেছে, যা ছিল প্রতিশোধমূলক। এটা এক রকম অবস্থা।

অন্যটা হলো, যেভাবে নারীকে ভোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি গ্রামে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করেছে। তার পর রাজাকাররা তাদের আনন্দের জন্য আশপাশের গ্রাম থেকে বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের নিয়ে আসত অনেক ক্ষেত্রে। এর পর তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। এটা এক রকম অবস্থা। নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত অর্থাৎ ধর্ষিত হয়েছেন। শুধু ধর্ষণ ও খুন নয়, ধর্ষণের পর ধর্ষিতার স্তন কেটে হাতে নিয়ে খেলা করার মতো চরম নৃশংসতা দেখিয়েছে পাকিরা। এ বিষয়গুলো বিস্তারিত বর্ণনা করা হলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন অবস্থা বুঝতে সুবিধা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমাদের গ্রামের নারীরা একই সঙ্গে সংসার টিকিয়ে রেখেছেন, সন্তান-স্বামী নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছেন, আবার নানাভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন- এ বিষয়গুলো সবসময় ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন কিন্তু সেই নয় মাস নারী সংসার আগলে রেখেছেন, স্বামী-সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন, সেটা আমাদের সামনে কখনোই আসেনি কারণ সবসময় তারা এটা করেন বলে বোধহয় আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে; আমরা এ বিষয়গুলোকে স্বীকৃতি দেইনি। সেক্ষেত্রে আমরা পুরুষরা অর্থাৎ সুবিধাবাদীরা সবসময় নারীদের যৌন পরিচয়ে পরিচিত করেছি, তাদের সামাজিক ভূমিকাকে সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছি, ইতিহাসেও তাই। সেক্ষেত্রে আমরা যদি জানতে পারতাম যে, নির্যাতিত হয়ে জীবনধারণ করা কতটা কষ্টের, তাহলে বোধহয় আমরা তাদের এভাবে ব্যবহার করতাম না। সাধারণ মানুষের এই নির্যাতনের মাত্রা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই নেই।

যারা মাঠ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের এক-আধটু খোঁজখবর নেন, তারা জানেন গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ ও গ্রামীণ নারীরা কী ধী-শক্তিতে একহাতে সংসার সামলেছেন আর অন্যহাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন।

অনেকে মনে করেন, যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিংবা যারা নির্যাতিত হয়েছিলেন তাদের ভূমিকাই বেশি। এছাড়া যারা ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যুদ্ধের নাগরিকত্ব আমরা দিয়েছি ছেলে অথবা ক্ষমতাবানকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পুরুষরা প্রথম শ্রেণির নাগরিকত্ব পেয়েছে। কিন্তু যারা নয় মাস গোটা সংসারকে আগলে রাখলেন, তাদের স্বীকৃতিকে অস্বীকার নয় ধূর্ততার সাথে আড়াল করছি অবলীলায়। কারণ স্বীকৃতি দিতে চাইলে নারীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সেটাও আমরা দিতে চাই না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাজাকারদের বর্ণনা যেভাবে এসেছে, সেভাবে সাধারণ মানুষ কিংবা গরিব মানুষের কথা আসেনি। এটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়। গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ নারীদের কথা বললে তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে-এটা আমরা চাইনা। আর স্বীকৃতি দিলে সুবিধাভোগীরা তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ কারণে আমাদের ইতিহাসে শুধু যুদ্ধের বর্ণনাই এসেছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা বই লিখেছেন-লিখছেন, তাদের অধিকাংশই এ বিষয়কে উপেক্ষা করেছেন; কেউ অজান্তে-কেউ না বুঝে আবার কেউ কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।

যুদ্ধের বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তখনকার নারীরা কীভাবে জীবনযাপন করেছেন, কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে ঘর-বর সামলেছেন আবার মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পৌঁছেছেন তা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে বলে মনে করিনা। তাদের না খেয়ে থাকা, সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা, অসুখ-বিসুখ, খাদ্য সংগ্রহের সংকট, ইজ্জত আর জীবন বাঁচাতে গিয়ে পালিয়ে থাকার মতো বিষয়গুলো সামনে আনা হয়নি। শুধু নারীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ, মৃত্যু, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গরিবদের ভূমিকার বর্ণনা নেই। বিষয়টা অনেকটা এ রকম, ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে কোনো গরিব মানুষ ছিল না। তাদের কথা ইতিহাসে যথাযথভাবে আসেনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা গরিবের বাড়িতেই খেয়েছেন।

গ্রামের মাতব্বরদের দুটি পক্ষ ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এক পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আরেক পক্ষ পাকিস্তানের। মুক্তিযোদ্ধারা সাহায্যের কথা চিন্তা করলে আগে গরিবদের কথাই চিন্তা করেছেন। আর প্রভাবশালী পরিবার যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হয়, তাহলে তারা সাহায্য করেছেন। এক্ষেত্রে গরিব মানুষরা এগিয়ে থেকেছে। তারা ছিল গ্রাম্য রাজনীতির বাইরে। গরিব মানুষের সমস্যা ছিল, অধিক বাজার করতে দেখলে তাদের সন্দেহ করা হতে পারে। তাই তারা নিজেদের খাবার মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াতো অনেক ক্ষেত্রে। এছাড়া কৃষকের ধান চাষ, অনেক পরিবার মাঠ থেকে ফসল তুলতে পারেনি, তখন জিনিসপত্রের দাম কেমন ছিল, অনেক হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করেছিল, পালাতে গিয়ে মানুষের কী হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধে গরিব মানুষ নিজে না খেয়ে মুক্তিদের খাইয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সেই গরিব মানুষের কী হয়েছে, সেটা আমরা দেখতে যাইনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো এমন ছিল, যেখানে গরিব মানুষকে নিয়ে কেউ কিছু করবে, সেটা অসম্ভব ছিল। কেননা আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে। এসব বিষয়ের বর্ণনা ইতিহাসে আসা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের এ ক্ষেত্রে বিশেষ তৎপরতা প্রয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গ্রামীণ নারী ও গ্রামের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার কৃতি তো অনেক বড় বিষয়। দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও তাদের অনেকের নাম স্থান পায়নি। যারা ধণীক ও শাসক শ্রেণির শুধুমাত্র তারা এবং তাদের অনুসারিদের স্থান হয়েছে তালিকায়।

২০০৩ সাল থেকে সরকারিভাবে তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট প্রকাশ শুরু হয়। মন্ত্রণালয় গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা দু’টি তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সংরক্ষিত ভারতীয় ভলিউম বুক। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। এর আগে ১৯৮৬-৮৭ সালে এরশাদ সরকার জাতীয় তালিকা প্রণয়ন করে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে।

বিএনপি সরকার ভারতীয় ভলিউম বুককে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৯৪ সালে নতুন তালিকা করলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ হাজারে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের খসড়া তালিকায় ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন।

সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯। তবে মহাজোট সরকারের গঠিত জাতীয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন। আর বর্তমান সরকারের তথ্য মতে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন।

সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাও বদলে যায়। আকার পরিবর্তিত হয়। মহাজোট সরকারের গত আমল থেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ ব্যবহার করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো যাচ্ছে। ফলে সনদের গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেক গুণ। এ কারণে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমান সময় পর্যন্ত অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন। এরই মধ্যে নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধা হতে আবেদন করেছেন এক লাখ ৩৩ হাজার জন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও খোঁজ মিলছে। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত আছেন, তাদেরও নাম-ঠিকানাসহ সনদে ভুলভ্রান্তি রয়েছে। এসব সমস্যা নিরসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করতে আবারও তালিকা যাচাই-বাছাই করছে সরকার। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও আমরা পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির কাজ শেষ করতে পারলাম না। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত না হওয়ার এটাও বড় কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের গ্রাম, গ্রামের অবহেলিত নিম্ন আয়ের মানুষটি, গ্রামের সাধারণ কন্যা-জায়া-জননীদের যে ভূমিকা তা খতিয়ে দেখে গবেষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইসিহাস রচনায় উদ্যোগী হওয়ার এখনই সময়।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার টাঙ্গাইল জেলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test