E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফুটবলের সেই নানা রঙের দিনগুলি

২০১৬ নভেম্বর ২৪ ১৫:১৯:৪৭
ফুটবলের সেই নানা রঙের দিনগুলি

মাহবুব আরিফ


আজ একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করবো। অন্তরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো কাউকে না কাউকে কোন না কোন একদিন জানাতেই হতো। ফুটবল ছিল আমার আজীবনের স্বপ্ন যা জেনেটিক সূত্রেই আবার বাবার কাছ থেকে পাওয়া, যা কিনা রক্তের প্রতিটি শিরা উপশিরায়, ধমনীতে প্রবাহিত। কেউ কোনদিন বিশ্বাস করবে না হয়তো যে আজ টেলিভিশনের সামনে বসে ফুটবল খেলা দেখতে পারিনা, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, প্রবাসে চলে আসার পর আর কোনদিন ফুটবল খেলা দেখিনি এটাই চরম সত্য। ফুটবলের অধঃপতন যতটা কাছে থেকে দেখেছি সেটা আপনাদের জানাতেই হবে, এর মাঝে কিছু মানুষের এই ফুটবলকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা খুব কাছে থেকে দেখেছি যাদের নাম না বললে আমি সারাটা জীবন আমার বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো।

খেলাধুলার জগতে খেলাধুলা নিয়ে চিন্তা ভাবনা যারাই করতেন তাদের মাঝে ফুটবলার বঙ্গবন্ধুর নাম প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যিনি কিনা অপর একজন খেলাধুলার মানুষ জনাব ফজলুর রহমান আরজুকে যতটুকু ভালোবেসে ছিলেন হয়তো তার চাইতেও বেশী তার চিন্তা ভাবনাকে সহযোগিতা করতেন, ভালোবাসার একটা স্বাভাবিক কারণ, বঙ্গবন্ধু যখন শেখ মুজিবর রহমান ছাত্র নেতা বাবা তখন উপমহাদেশের ফুটবলের তারকা তাই এই তারকাকে ভালবাসতেন অগাধ তার একটি প্রমাণ হচ্ছে ১৯৭৪ সালেই বাবার অনুরোধে খেলাধুলার সরঞ্জামাদি থেকে আমদানি শুল্ক মৌকুফ করা। সেই ভালোবাসার সূত্র ধরেই ঢাকার সাভারে তৈরি হয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া অনুশীলন কেন্দ্র (Bangladesh sports academy) যা নিয়ে আমার বাবা ঐ সময়ে ইত্তেফাকে ধারাবাহিক ভাবেই দেশের খেলাধুলার উন্নয়নের চিন্তা ভাবনা লেখা শুরু করেন, আজ সাভারের জাতীয় ক্রীড়া অনুশীলন কেন্দ্রটি আমার বাবার স্বপ্নের ফসল। আরও কিছু মানুষ যাদের দেখেছি ফুটবল ও তার উন্নয়ন নিয়ে রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সময় কাটাতেন তাদের মাঝে জনাব জাকারিয়া পিন্টু , জনাব গোলাম সরওয়ার টিপু। এই দু’জন মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে রক্ষনা-বেক্ষণ করা সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলাতে তাদের অবদানের কথা ভোলার নয়। আজকের সালাউদ্দিন যিনি কিনা বাংলাদেশ ফুটবলের হর্তা কর্তা তাকে প্রথম দেখেছিলাম সেই দিন যেদিন এই বরেণ্য ফুটবলার ও গোলাম সরওয়ার টিপুকে আমার বাবা চট্টগ্রাম কাস্টমস ফুটবল টিমের পক্ষে চট্টগ্রাম ফুটবল লীগ খলতে নিয়ে আসেন, সেই সাথে তাদের দুজোনকেই চট্টগ্রাম কাস্টমসে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন। ৬০ ও ৭০ দশকের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত গোলাম সরওয়ার টিপুর খেলা দেখেছিলাম সেই ছোট বেলাতেই , মনে হয়েছিল যেন বল নিয়ে রং তুলি দিয়ে মাঠে ছবি একে চলেছেন এই বরেন্য ফুটবলার টিপু। সেই অপূর্ব স্মৃতি আমি আজো ভুলে থাকতে পারি না, অনেকের খেলাই তখন ভালো লেগেছে।

অপর একজন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ফুটবলার জনাব জাকারিয়া পিন্টু হয়তো আমাকে তার নিজের সন্তানের মতই ভালবাসতেন তা না হলে আমার সেই অল্প বয়সেই তিনি আমাকে মধ্য বাসাবো থেকে খুব ভোরে আউটার স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করাতে চলে আসতেন। আমি তখন সবে মাত্র বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ২০ ফুটবল টিমে খেলার সুযোগ পাই, সালটা হয়তো ১৯৮০ কি ৮১ হবে । ততদিনেও ফুটবলের ধস শুরু হয়নি তবে ১৯৮২ সালেই খুব বুঝতে পারছিলাম যে খেলাধুলার মান নীচের দিকে চলে যাচ্ছে।

১৯৭৫ সাল ১৫ই আগস্ট জাতি তার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হারিয়ে খেলাধুলার জগতেও নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা, রাজনীতি, দুর্নীতিতে আস্তে আস্তে ধস নামতে থাকে বাংলাদেশের খেলাধুলাতেও ক্লাব পলিটিক্স থেকেই শুরু হয় দুর্নীতি। ফুটবলের দুর্নীতিকে খুব কাছে থেকে দেখে থাকলেও আমি আমার লেখাতে কাউকেই অসম্মান করছি না, কারণ তাদের মাঝে অনেকই আমার শ্রদ্ধাভাজন প্রাক্তন ফুটবলার। তখন বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে খেলাধুলা প্রেমিকদের চাইতে ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটতে থাকে আর তারাই হয়ে উঠেন ক্লাবগুলোর কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীদের ভিড় জমার একটাই কারণ ক্লাব গুলোতে অংশ গ্রহণ করার, তা হচ্ছে কোন ব্যবসায়ী যদি তাদের উপার্জনের থেকে কিছু টাকা ক্লাবগুলোতে দান করেন, তবে সেই টাকার পরিমাণ অথবা আংশিক কর মৌকুফ করে নিতে পারেন, এই সুযোগে ১০ লক্ষ টাকা দান করে ২০ লক্ষ টাকার রশিদ গ্রহণ করার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়ে প্রথম বিভাগের সব ক্লাব গুলোতেই দারুণ রকম দুর্নীতি ঢুকে পড়ে, ওপর দিকে ক্লাব কোচদের মাঝে অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরেন, একজন মধ্যম মানের বা ঢাকা লীগে নতুন আগত খেলোয়াড় যদি ৪০ হাজার টাকাতে কোনও ক্লাবের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ২০ হাজার টাকাই গোপনে কোচের পকেটে চলে যেতো তাই খুব সহজেই একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে সারাটা বছর সাইড লাইনে বসে থাকতে হতো। ক্লাবের রেগুলার টিমে এরকম অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুব সহজেই বাদ পড়ে যেতো, আর তাতেই দিন দিন দিন ফুটবলের মান যাচ্ছে তাই জগতের দিকে ধাবিত হতে থাকে।

ঢাকার ফুটবল ৮০ দশকের মাঝা মাঝি সময়ে তার মান সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে ফেলে, যদিও ৯০ দশক পর্যন্ত কিছু মান সম্পন্ন ফুটবলার ঢাকা মাঠে থাকলেও ফুটবল তার জৌলুস হারিয়ে নির্জীব হতে থাকে সেই ৮০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। তারপর সমস্যা ছিল আরও, দুর্নীতিবাজ ক্লাব কর্মকর্তাদের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে অনেক অযোগ্য খেলোয়াড়কেও ক্লাবের রেগুলার টিমে সুযোগ করে দেয়ার প্রবণতাও কোচদের মাঝে লক্ষ্য করা যেতো, এমনকি বা ফু ফে'র কর্মকর্তারাও নিজেদের দলের খেলোয়াড়দের জাতীয় যুব ও জাতীয় দলে জায়গা করে দিতে অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিতেন ।

আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না এগুলো আমার স্বচক্ষে দেখা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই লিখছি। আমার বাবাকেও দেখেছি খুব অসহায় চিত্তে এসব অবলোকন করতে। আমিও তখন ফুটবল পাগল, অনেক বড় বড় তারকাদের খেলা দেখে শুধু মুগ্ধই হতাম না বরং তাদের স্বপ্ন দেখতাম। অনেকের খেলা আজও আমার চোখে ভেসে বেড়ায় বাঁটু, আশরাফ, বাদশা, রকিব, অমলেশ, সালাউদ্দিন, টুটুল, চুন্নু, ছোট নাজির, নাউশের, বড় নাজির, রামা লুসাই, শরীফ, সান্টু, সুহাস বড়ুয়া, মোতালেব, মহসীন, সেলিম, বাবুল, নান্নু, মনজু, মুকুল, আফতাব, হাসান, লোভন, বাবলু, কাওসার, আশীষ ভদ্র এ রকম আরও অনেক তারকাদের মিছিলে ঢাকা স্টেডিয়াম ছিল মুখরিত ।

আমি তখন সবে মাত্র ঢাকার খেলাধুলার জগতে প্রবেশ করেছি কি করছিনা এরকম একটা অবস্থায়, আর ঠিক সেই সময়েই খেলাধুলার মানের ধস আমার গায়েও আচড় দিয়ে যায় , আমার আজ মনে পরে, সালটা হয়তো ১৯৮১ কি ৮২ হবে , জাতীয় যুব দলের বাছাই প্রতিযোগিতায় আমাকে শেষ মুহূর্তে জাতীয় যুব দল থেকে বাদ দেয়া হয়, কারণটা ব্যাখ্যা আমাকে এ ভাবেই দেয়া হয়েছিল যে যোগ্যতা থাকলেও ঢাকার মাঠে আমার খেলার অভিজ্ঞতা খুবই কম যদিও সে বছর আমি অনূর্ধ্ব ২০ যুব দলের অধিনায়ক হয়ে সমগ্র জেলাতেই খেলে বেশ সুনাম অর্জন করেও জাতীয় যুব দল থেকে বাদ পরি , আমার বাবার কাঁধে মাথা রেখেই প্রতিজ্ঞা করি, এ দেশে আমি ফুটবলের ইতি টানছি, আমি সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম অনেকেই চাইতো না ছেলেও বাবার মত বড় হবে।

ফেডারেশনের বড় বড় কর্মকর্তারা তাদের ক্লাবের নিজস্ব খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে দুর্নীতির মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেবার প্রবণতা বেশ লক্ষনীয় ছিল। ফুটবলের কোচদের মাঝেও দুর্নীতির প্রভাব লক্ষ্য করেছিলাম, ক্লাব পলিটিক্স এর কারণে একজন খেলোওয়ারের যোগ্যতা না থাকলেও কোচের পকেটে টাকা ঢুকে যাবার কারণে একজন যোগ্য খেলোয়াড়কে মাঠের বাহিরে বসিয়ে রেখে অযোগ্য খেলোয়াড়কেই খেলতে সুযোগ করে দেয়া হতো, অযোগ্য খেলোয়াড়ের কন্ট্রাক্টের টাকার একটি অংশ কোচদের পকেটে চলে যেতো, এ সব কিছুই গল্পের মত শোনালেও, এ গুলো ছিল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা । বিভিন্ন ক্লাবে খেলার সুবাদে আমি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে এইসব লিখতে বাধ্য হচ্ছি । আমি ৮০ দশকের ফুটবল ও তার ধসের একটা চিত্র আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test