E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বুলেটবিদ্ধ ১১ জন, পরিচয় মিলেনি স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও

২০১৬ ডিসেম্বর ০৭ ১৫:৩৮:২১
বুলেটবিদ্ধ ১১ জন, পরিচয় মিলেনি স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও

ত্রিশাল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : সেদিন ছিল ভাদ্র মাসের ২৩ তারিখ তথা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ । দুই তিনদিনের অনাহারি ১৬ মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চালসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে রান্নার আয়োজন করেছিল। সবাই মিলে দু’মুঠো খেয়ে পাকিস্তানী ক্যাম্পে হামলার পরিকল্পনা।

তাদের ভাগ্যে আর খাবার জুটল না, না খেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলো সেই ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশালের হরিরামপুর ইউনিয়নের রায়েরগ্রামে সম্মূখ যুদ্ধে শহীদ হন তারা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলে তাদের বয়সী বেঁচে থাকা সমবয়সী বন্ধুরা।

স্থানীয় রায়েরগ্রামে এসএসসি পরীক্ষার্থী যুবক মোখলেছুর নিজের পড়াশোনা রেখেই ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার জোগাড়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি বাড়ি। ভোর রাতে রান্না শেষে যখন খাবার গ্রহন করতে যাবে ঠিক ঐসময় অতর্কিত হামলায় নিহত হয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের সাথে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয় মোখলেছ।

ছেলের শোকে কাতর ৯০ বছর বয়সী মোখলেছুর রহমানের মা খতিজা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রতিবেদককে বলেন, আমার বাপজান মেট্রিক পরিক্ষার্থী আছিল। মুক্তিবাহিনিরে খাওয়াইবার গ্যা বাবা আমার লাশ অইয়া ফিরছে। আমার বাবার জান গেল দেশও স্বাধীন অইল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও সরকার থেকে কোন স্বীকৃতি পায়নি আজও।

জানাযায়, ভারত থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে দেশে ফেরার পর মেজর আফসার বাহিনীর নির্দেশে হরিরামপুর আমতলা মোড়ের পাকিস্থানি মিলিটারি ক্যাম্প গুড়িয়ে দিতে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নেন রায়েরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাকিস্থানি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দুরত্বে ছিল রায়েরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ত্রিশালে আসা ১৬ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন শেষে দায়িত্ব নেয়া পর্যন্ত তাদের পেটে কোন খাবার পড়েনি। দুই তিনদিনের অনাহারি মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয়দের সহযোগিতায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে চালসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে রান্নার আয়োজন করেছিল। এদিকে রাজাকারদের দেয়া খবরে গফরগাও ক্যাম্পে থাকা পাকিস্থানী হানাদাররা রায়েরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় হানাদার বাহিনীর সাথে শুরু হয় যুদ্ধ।

এ সময় প্রান হারান ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ রান্নাবান্নার সহযোগি মোখলেছুর রহমান নামে স্থানীয় এক যুবক। ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জীবিত ৬ জনকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্থানি হানাদাররা। পরে স্থানীয়রা জানতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের তথ্য জানার জন্য ওই ৬ জনের উপর অমানবিক অত্যাচার করার পর ব্রক্ষপুত্র নদীর পাড়ে নিয়ে তাদেরকে নিশংসভাবে হত্যা করা হয়।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস না খেয়েই চিরনিদ্রায় শায়িত হতে হলো ওই ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগি এক মুক্তিযোদ্ধার। নিতদের কোন পরিচয় না থাকায় একসাথে স্থানীয়রা মিলে রায়েরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তাদের দাফন সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতেও আজও পর্যন্ত কেউ তাদের পরিচয় সনাক্ত করতে আসেনি। খোজ মেলেনি তাদের পরিবারের অন্যকোন সদস্যদের। সেই বধ্যভূমির পাশেই তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

স্থানীয় ইব্রাহিম মিয়া (৬০) ও নিজাম উদ্দিন (৭০) সেদিন সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পাকিস্থানি হানাদারদের আক্রমনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তারা বলেন, ওদের প্রান বাচাঁনোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। অনেক কষ্ট করে খাবারের ব্যবস্থা করেও উপোষ অবস্থায় দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হলেন তারা। এখন কবরের পাশে এসে নামাজ কোরআন তেলাওয়াত করেন। কিছুটা অভিমান নিয়েই বলেন দেশে কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সাটিফিকেট নিয়ে বীরত্ব প্রদান করে থাকে কিন্তু সত্যিকারের বীর শহীদ ও তার পরিবারের সদস্যদের দেখার কেউ নেই।

(এমএন/এএস/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test