E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাইফুদ্দিন খান: অগ্রজের প্রতি স্মৃতিতর্পণ

২০১৪ জুন ২৮ ০৯:৩৬:০৩
সাইফুদ্দিন খান: অগ্রজের প্রতি স্মৃতিতর্পণ

পংকজ ভট্টাচার্য : পালাবদলের এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী, পরিবর্তনকালের এক নির্ভীক অগ্রনায়ক সাইফুদ্দিন খান তথা এস ইউ খান দুনিয়া কাঁপানো যুববিদ্রোহের পরের বছর ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন পটিয়ার বড়উঠান গ্রামে। জন্মেই তিনি দেখেন ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। চট্টগ্রামে বীর যুববিদ্রোহীদের হাতে ব্রিটিশরাজের বাহিনীর পরাজয় বরণ এবং চট্টগ্রামে ভারতের স্বাধীনতার পতাকা চারদিন উড্ডীন থাকা প্রভৃতি সৃষ্টি করে এক অগ্নিগর্ভ অধ্যায়।

এস ইউ খানের শৈশব ও কৈশোর কাটে উথাল পাথাল করা ঘটনার ঘনঘটায় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মহামন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের অনুষঙ্গ, লক্ষ লক্ষ নরনারীর মৃত্যু, সম্ভ্রমহানী, ধ্বংসলীলা ও দেশত্যাগের কলঙ্কময় এক কালো অধ্যায়। এস ইউ আহমেদ মানতে পারেন নি দ্বি-জাতিতত্বের নামে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রকে।

ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খান বাঙালীর ভাষা-সংস্কৃতি অধিকারসহ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যে অনুকরণীয় অবদান রেখেছেন তা অনন্য।

সাইফুদ্দিন খান ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সমগ্র চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার মধ্যে সচেতন প্রতিরোধ তরঙ্গ তৈরি করে গেছেন। পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জেলা শাখার প্রথম কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ব্যাংক কর্মচারীদের মধ্যে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত কমিউনিষ্ট পার্টির প্রকাশ্য টিমের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৪ সনের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পার্টির সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সামরিক শাসন জারির পর ১৯৫৯ থেকে ’৬২ সন পর্যন্ত নিরাপত্তা আইনে কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন, ১৯৬৩-’৬৪ সন পর্যন্ত কয়েক দফায় কারারুদ্ধ হন।

১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই সময়ে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে । তারা চট্টগ্রামের পুরানো টেলিগ্রাফ রোডে ডালিম হোটেলে তার ওপর টানা তিন সপ্তাহ নির্মম নির্যাতন চালায়; তারপর তাকে জেলে পাঠায়। ১৯৭১ সনের ১৭ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

সাইফুদ্দিন খান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সভাপতি ছিলেন বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার। চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ছিলেন হারুন অর রশীদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মৌলানা আহমেদুর রহমান আজমী, জেলা সাধারণ সম্পাদক এ এন এম নুরুন্নবী, শ্রমিক নেতা এম এস হক, ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী প্রমুখরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতেন।

পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতা-উত্তর সকল আন্দোলন সংগ্রামে ন্যাপ নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সর্বশেষ ১৪ -দলীয় ঐক্যজোটের চট্টগ্রাম বিভাগীয় আন্দোলন, চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারিকরণ থেকে রক্ষার আন্দোলন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়নের স্বার্থে গড়ে ওঠা আন্দোলন সংগ্রামে তার অবদান ছিল অপরিসীম।

ন্যাপ বিভক্ত হলে এন এ পি, গণতন্ত্রী পার্টি প্রভৃতিতে তিনি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে সমমনাদের সম্মান করে তাদের সাথে নিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে যথাযোগ্য ভূমিকা পালনে সজাগ থাকতেন। এই বিভক্তি ও শক্তি হ্রাস তাকে ব্যথিত করতো প্রতিনিয়ত।

একদিকে প্রধান রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলগুলো দুর্বৃত্তায়িত দুর্নীতি কবলিত কালোটাকা নির্ভর হয়ে উঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতি আদর্শ ও মূল্যবোধের বিরাট শূন্যতা তাকে প্রচণ্ড পীড়া দিতো।

অপরদিকে দ্বি-দলীয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক নীতিহীন প্রতিযোগিতার ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী শক্তির যে সাংগঠনিক বিস্তৃতি তা দমন ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র যে স্থিতিশীল ও বিকশিত হবেনা। এজন্যে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় উদ্যোগ যে অগ্রগতির পূর্বশর্ত - এই উপলব্ধি খান সাহেবের মনে দৃঢ়মূল ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গরীব মেহনতী মানুষের স্বার্থ এবং গণতন্ত্র বাঁচাতে রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করতে বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যকে অনিবার্য ও অপরিহার্য প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করতেন তিনি।

পাকিস্তানের জন্মাবধি মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাহীন ক্ষোভ ও স্বার্থবুদ্ধির যে প্রবল ¯্রােত সৃষ্টি হয় অদ্যাবধি সেই ট্রেন্ড সমানে চলছে। ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রযন্ত্র সবকিছুই দুর্বৃত্তায়িত ও দুর্নীতিকবলিত হয়ে জাতীয় জীবনকে এইডসতুল্য মরণব্যাধিতে গ্রাস করছে- এইরূপ উপলব্ধি ছিল খান সাহেবের।

লোভ, স্বার্থ ও ক্ষমতার রাজনীতিকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করেছেন- প্রত্যাখান করেছেন। নির্যাতন, দুর্যোগ, প্রতিকূলতা তাকে সততার পথ থেকে জনগণের জীবন সংগ্রামের ধারা থেকে একবিন্দু দূরে সরাতে পারেনি; পারেনি তাকে সংশয়-দ্বিধায় কাবু করতে।

জাগরণের কালপর্বের নায়ক হিসেবে শোষিত, বঞ্চিত ও অধিকারহারাদের ভাগ্যবদলের সংগ্রামে নিত্যসাথী হয়ে থেকেছেন আমৃত্যু। উচ্চশিক্ষা ও উচ্চবংশ খান সাহেবকে উচ্চাভিলাষী করতে পারেনি। ব্যাংকের উচ্চপদ ও তার মধ্যে উচ্চাশা জাগাতে পারেনি- উচ্চ ও উন্নত আদর্শ, মূল্যবোধ, মানবিকতা, শোষনহীন সমাজের স্বপ্ন তাকে একনিষ্ঠ ও একরোখা করে তুলেছিলো।

সংসার জীবনে সবসময়ে স্বচ্ছলতা থাকেনি। খান সাহেব যখন কারাজীবন ও পলাতক অবস্থায় বা অসুস্থ তখন তার সহধর্মিনী নারী আন্দোলনের খ্যাতনামা নেত্রী নূরজাহান খানকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। অস্বচ্ছলতা ও অশান্তির মধ্যে সন্তানদের নিয়ে জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু হাসিমুখে সততা ও নীতি- আদর্শের প্রতি অনুগত থেকেছেন ‘এস ইউ খান’।

পাকিস্তানের শুরু থেকে লোভ- প্রলোভন- প্রতিষ্ঠা- প্রতিপত্তি প্রত্যাখ্যান করে যুব উন্নয়ন ও জাগরণের ধারায় গণতন্ত্র, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রের যে পতাকা তিনি দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধারণ করেছিলেন আমৃত্যু তা বহন করেছেন সাইফুদ্দিন খান।

ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও ঋণ স্বীকার

প্রয়াত সাইফুদ্দিন খানের কন্যা সাহসী সাংবাদিক সুমি খান যখন তার পিতা সম্পর্কে আমাকে কিছু লিখতে বলে, তখন আমি রোগশয্যায় শায়িত হলেও আনন্দের সাথে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধানিবেদন ও প্রয়াতের কাছে ঋণ স্বীকারের এ সুযোগটি গ্রহণ করি। এ যেন রোগীর নববর্ষ।

সাইফুদ্দিন খান ছিলেন আমার বড়ভাই পরিতোষ ভট্টাচার্যের অভিন্নহৃদয় বন্ধু । তিনি ও চট্টগ্রাম চার্টার্ড ব্যাংকে এস ইউ খানের সহকর্মী ছিলেন কিছুকাল। ব্যাংক কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে নেমে উভয়েই কর্মচ্যুত হন। একই সাথে কারারুদ্ধ বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের পক্ষে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী যুদ্ধে নামলে উভয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। পরিতোষ ভট্টাচার্য পিতার সরকারি চাকরি রক্ষার্থে দেশত্যাগে বাধ্য হন। বন্ধু খান সাহেব পলাতক জীবনের কষ্টকর পথে রাজনীতি ও গণস্বার্থে আত্মনিবেদন করেন।

বন্ধুবিচ্ছেদের চার দশক পরে সাইফুদ্দিন খান পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে গিয়ে মেহনতী কয়লা শ্রমিকের কল্যাণে নিবেদিত তার চিরকুমার বন্ধু পরিতোষ ভট্টাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পত্রালাপও ছিল তাদের মধ্যে। তাদের উভয়ের অগ্রজ বন্ধু ও সুহৃদ কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী, সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী, গায়ক চিন্ময় চক্রবর্তী, মৌলানা আহমেদুর রহমান আজমী, চিরেন সরকার প্রমুখের সাথেও কিছুটা যোগাযোগ ছিল।

ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পদে দীর্ঘদিন দায়িত্বপালনকালে জেলা ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খানের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল গভীর শ্রদ্ধাযুক্ত। অগ্রজ খান সাহেব আমার বড়ভাইয়ের বন্ধু হয়েও আমাকে সাথী, সহকর্মী ও বন্ধুর আসনে বসিয়েছেন, বন্ধুবৎসল হয়েছেন।

চট্টগ্রামে বড় ধরণের সভা-সমাবেশের সঙ্গে নূরজাহান ভাবীর হাতযশের রকমারী রান্নার আপ্যায়ন এবং এস ইউ খানের দিলখোলা আড্ডা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠতো। ভুলি কেমনে?

আমার অগ্রজ এস ইউ খান আমার জেলমেট হলেন ১৯৬৪ সনে চট্টগ্রাম কারাগারে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, শরদিন্দু দস্তিদার, ননী দত্ত প্রমুখেরাও তখন জেলসাথী হলেন।

কন্যাতুল্যা সুমির সুবাদে তার প্রখ্যাত পিতা আমার অগ্রজ, একাধারে বড় ভাইয়ের এবং নিজের বন্ধু ও সহযোদ্ধার প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও সম্মান এবং ঋণ স্বীকারের সুযোগ নিলাম। নূরজাহান ভাবীকে মানবাধিকার নিয়ে আমৃত্যু সংগ্রামরত দেখে যেতে মনে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি - এ তো খান সাহেবের আকাঙ্ক্ষারই পুনরুক্তি মাত্র!! জয়তু এস ইউ খান!!

লেখক : বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।

সৌজন্যে : বাংলানিউজ ২৪। প্রকাশকাল : ২৭ জুন ২০১১

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test