E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ক্ষমার রাজনীতি, অতঃপর...

২০১৭ নভেম্বর ২৭ ১৫:৫২:০৪
ক্ষমার রাজনীতি, অতঃপর...

কবীর চৌধুরী তন্ময়


ক্ষমার রাজনীতির অভাব শুধু বাংলাদেশেই নয়; বিশ্ব রাজনীতিরও অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা একেবারেই অন্য রকম। মানুষ মানবতার সভ্যতার সৃষ্ট সমাজে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময় থেকে প্রতিটি কঠিন মুহুর্ত সৃষ্টকারীদেরও বঙ্গবন্ধু ক্ষমার চোখে অবলোকন করেছেন। আর তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে শেখ হাসিনাও।

সাম্প্রতিক খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করে দিয়েছে কথা শুনতে যেমন বেমানান আবার এ নিয়ে আলোচনা করলেও কেন ক্ষমা করেছে এই ধরনের উদ্ভট মন্তব্যের কোনো ছিটেফোটা তথ্য-প্রমাণও খুজে পাওয়া যায় না। বরং শেখ হাসিনা কখন, কাকে, কীভাবে, কী কারণে ক্ষমা করেছে; তা নিয়ে লিখতে বা আলোচনা শুরু করলে শেষ হবার কথা নয়।

তবে স্যোশাল মিডিয়াতে একএক জনের একএক ভাবনার প্রতিফলন দেখা গেছে। কেউ বলেছে, ক্ষমা করে দিয়েছি বলার মধ্যে মুলত নিজেই নিজের পরিস্থিতি টের পেয়ে কৌশলে বঙ্গবন্ধু’র কন্যা শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

তবে খালেদা জিয়ার এই রকম হাস্যকর মন্তব্য নিয়ে সাধারণ মানুষের অসাধারণ চিন্তা-ভাবনাগুলো উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর স্বাধীন-সার্বভৌম এই দেশটাকে নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান যে খেলা খেলেছে, জাতি তা কখনো ভুলতে পারবে না। রাজনীতির ছিটেফোটা যার অভিজ্ঞতায় নেই সেই খালেদা জিয়া জেনারেল এরশাদের পর জিয়ার সেই পাকিস্তানী ভাবধারার বাংলাদেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।

একদা বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত লে.কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন কুমিল্লায় তাঁর নিজ আসনে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আকবর হোসেন জিয়ার সাথে বসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছি। তখন খালেদা জিয়া চাকরানীর মত আমাদের চা বানিয়ে খাওয়াত। সে আমাকে বিএনপি থেকে কীভাবে বহিষ্কার করবে? আমিই খালেদাকে বহিষ্কার করে দিব। আর আপনারা আমাকে একবার হোসেন বলবেন না। আমি পাঁচবার হোসেন। কারণ আমি পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছি।’

এই কথাগুলোর সাথে মিল রেখে বিএনপি’র অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য খুজলে দেখবেন, খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁদের কী ধরনের অনুভব-অনুভূতি বা সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে তা পাঠক নিজগুণেই অনুমান করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

এবার আসুন খালেদা জিয়ার ক্ষমার প্রসংগে

চলতি মাসের ৯ নভেম্বর জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্যের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া বলেন, “আমার এবং শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি এবং প্রতিহিংসামূলক বৈরী আচরণ সত্ত্বেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি।’ একটু থেমে “আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপ্রবণ আচরণ করব না।”

প্রথমত ক্ষমার প্রসংগে আপনারা কিছু পেয়েছেন কীনা জানি না। তবে স্যোশাল মিডিয়ার অসাধারণ পর্যবেক্ষনের সাথে আমিও একমত হতে পেরেছি। আর তা হলো, কৌশলে শেখ হাসিনার কাছে খালেদা জিয়া নিজেই ক্ষমা চেয়েছেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু’র কন্যা শেখ হাসিনা এমন কোনও কর্মকান্ড করেনি যে খালেদা জিয়া কর্তৃক ক্ষমা পেতে হবে। বরং আমি-আপনি, আমরা পর্যবেক্ষন করলে দেখি, বাংলাদেশে একমাত্র মানুষ শেখ হাসিনা, যে বার বার আপন শত্রু থেকে আরম্ভ করে রাজনৈতিক শত্রুদেরও ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আপনি ৭৫ থেকে শুরু করলে দেখবেন, নিজ পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট রাসেলকেও যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে পেশি শক্তি কিংবা রাতের আধারে অস্ত্র ব্যবহার না করে আইনি কাঠামোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় বর্বরপশুদের ফাঁসি নিশ্চিত করেছে।

৭১’এর পরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে যত রকমের বর্বরতার নোংরা ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে তা শুধু বিএনপি-জামাতের বর্বরতায়। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়নক ও বিশ্বকে কাপিয়ে দিয়েছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। সেদিন আওয়ামী লীগের ২৪জন নেতাকর্মী শহীদ হয়েছিল। তখনও শেখ হাসিনা ধৈর্য না ধরে শুধু তার নেতাকর্মীদের ইশারা দিলেই খালেদা জিয়া আজ বড় বড় কথা বলার সুযোগ পেত না। হত্যার বদলে হত্যার রাজনীতি শেখ হাসিনার ডিকশনারীতে নেই। হাওয়া ভবন থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক জিয়া। তার পরেও খালেদার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেলে এই মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনা তখন তাঁকে শান্তনা দিতে গিয়ে বাড়ির গেইটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল যা শুধু বাংলাদেশের মানুষই অবাক হয়ে দেখেনি; মর্মাহত হয়েছে দল-মত নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের মানুষও!

এগুলোর কথা চিন্তা না করে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে শেখ হাসিনা এই খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিল। তখনও পুরো জাতি খালেদার ব্যবহার শুনে শুধু দুঃখই পায়নি বরং মনে মেন নিজেদের ধিক্কারও দিয়েছে যে, এতোদিন কোন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের শাসনভার ছিল-এ কথা ভেবে!

একটু চিন্তা করে দেখুন, আমরা অতি সাধারণ হওয়ার পরেও আমাদের বাবা-মা’র নামে কোনও ধরনের মিথ্যা তথ্য বা কটুক্তি আমরা সহ্য করতে পারি না। এই নিয়ে রীতিমত ঝগড়া থেকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে যায়। আর শেখ হাসিনার সামনে এমন কী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী থাকার পরেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিএনপির খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তার পলাতক ছেলে তারেক জিয়াও বিভিন্ন সময় কটু মন্তব্য করতে দ্বিধা করেনি। বিকৃত করে মিথ্যাচার করেছে। তথ্য বিভ্রান্ত করে জাতির সামনে খালেদা মিথ্যাররাণী আর তারেক জাতীয় বেয়াদব হলেও শেখ হাসিনা কিন্তু কোনো ধরনের নোংরা কিংবা ভ্রান্ত পথ বেচে নেয়নি। নেতাকর্মীদেরও ভুল পথে অন্ধকার সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রেখেছে।

আবার রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে আপনি নিজেই ভাবুন! পরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনার নামে, শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে, পদ্মা সেতুর নামে, দেশ ও দেশের মানুষের নামে শুধু নিজ দেশেই নয়; বিদেশীদের যারে যখন যেখানে পেয়েছে বিচার দিয়েছে! ব্যক্তি শেখ হাসিনার পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অনর্গল মিথ্যাচার করেছে এই খালেদা জিয়া।

বন্ধুবর! মোট কথা আসলে দেখবেন শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য একবার দুইবার নয়, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ পরিকল্পিতভাবে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল এবং আজও সে চেষ্টা অব্যাহত আছে। বিএনপি-জামাতের মতন জাতীয় শত্রুর বুলেট ২৪ ঘন্টাই শেখ হাসিনার দিকে তাক করা।

এখন আপনিই বলুন, কে কাকে বার বার ক্ষমা করেছে? শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের নেত্রী কিংবা দেশের প্রধানমন্ত্রীই নন! তিঁনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। যার শরীরে আন্দোল-সংগ্রামের পবিত্র রক্ত বহমান। যিঁনি রাজনৈতিক পরিবারের মাধ্যমে রাজনীতি আর ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে মাঠে-ময়দানের স্লোগানে-স্লোগানে মিছিল-মিটিং করে আজ প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ব বরেণ্য ক্ষমতাধর নেতাদের একজন! তাই খালেদা জিয়া ক্ষমা করার কথা বলে কৌশলে নিজেই শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ একমাত্র শেখ হাসিনাই ক্ষমা করার অধিকার রাখে। কারণ এই খালেদা-তারেক জিয়াই শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রসহ মিথ্যা অপপ্রচারে সর্বখাতে দালিলিক প্রমাণ রেখেছে।

দ্বিতীয় “আমি তাঁর (শেখ হাসিনার) প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপ্রবণ আচরণ করব না” মর্মে এখানেও খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার কাছে অঙ্গিকারনামা দাখিল করেছে এবং অতীতে এই ধরনের আচরণ যে করেছে তাও জাতির সামনে নিজের অজান্তেই প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই সময়ে এসে এই ধরণের অঙ্গিকার কেন (?) এই প্রশ্ন আপনিও করতে পারেন!

তার কারণ একটাই, আমি-আপনি, আমরা এখন আর খালেদা জিয়ার আমনে নেই। জাতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সচেতন হয়েছে। দেশ ডিজিটাল হওয়ার কারণে খালেদা জিয়ার পাঁচ-পাঁচটি মিথ্যা জন্মদিন নতুন প্রজন্মের হাতে হাতে। আর অন্যদিকে যেখানে শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করে, বিশ্ব ইতিহাসে স্থান দেয় সেখানে নিরুপায় হয়েই আদালতের মত শেখ হাসিনার তথা জাতির কাছেই এই ধরনের আচরণ না করার অঙ্গিকার করছে।

এবারও আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে, বেগম খালেদা জিয়া আপনি কী সেই ধরনের সুযোগ পাবেন?
কারণ জাতিকে জিম্মি করার সেই সিরিজ বোমা হামলা আর আমরা চাই না। নেতার নেতৃত্বশূণ্য ৭৫এর পর ২১ আগস্টে আর কোনও মা’র বুক খালি হোক এ জাতি আর চায় না। জোট সরকারের সময় ঘরে-ঘরে ঢুকে মানুষ হত্যার সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখতে এদেশের জনগণ চায় না। পাঁচ পাঁচবারের দুর্নীতি, বাংলাভাইসহ রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের হাতে রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজের পতাকা তুলে দিতে চায় না। প্রেট্রোল বোমার সেই অগ্নিশিখায় আর কোনো মানুষকে জ্বালিয়ে হত্যা করুন আমরা তা চাই না।

প্লীজ! অতীত কর্মকান্ড নিয়ে কৌশলে নয়; প্রকাশ্যে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতিও ক্ষমা চান। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আছে সেইজন, যিঁনি না হলে আপনিও দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মন থেকে ক্ষমা চান। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের চিরতরে বয়কট করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিএনপিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে চেষ্ঠা করুন। শেখ হাসিনা ও তার নেতাকর্মীরা অত্যন্ত মানবিক। আপনার জন্য ক্ষমার দরজা খোলা...।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ),

মেইল :[email protected]

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test