E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইন্টারনেট বন্ধ করলেই কি প্রশ্নফাঁস বন্ধ হবে?

২০১৮ ফেব্রুয়ারি ১৩ ১৬:৪৬:৪২
ইন্টারনেট বন্ধ করলেই কি প্রশ্নফাঁস বন্ধ হবে?

কবীর চৌধুরী তন্ময়


প্রশ্নফাঁস নিয়ে সরকার বর্তমানে সত্যিই বিব্রত অবস্থায় আছে। একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভভ হচ্ছে না। আবার প্রশ্নসহ কিছু লোককে গ্রেফতার করেও তার প্রতিকার পাচ্ছে না। বরং আগের মতই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রশ্নফাঁস অব্যাহত রয়েছে, করছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পরীক্ষা। সমালোচিত হচ্ছে সরকারও।

তাই সরকার উপায়ন্তর না পেয়ে অবশেষে চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষা শুরুর দুই ঘণ্টা আগে থেকে মোট আড়াই ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে ধীর গতি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা মুলত ওই সময়ের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করার মতই। এখানে আইআইজিগুলোকে এএনএস অপারেটরগুলোর ইন্টারনেটের ডাউনলোড (ডাউনস্ট্রিম) গতি ২৫ কেবিপিএস (কিলোবিট পার সেকেন্ড) সরবরাহ করা মানে ইন্টারনেট এক ধরনের বন্ধ করার মতন। কারণ এই গতিতে কিছু ডাউনলোড করা তো দূরের কথা, ইন্টারনেট ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

এখন প্রশ্ন হল, যাঁরা ইন্টরনেটে ধীর গতি; মুলত বন্ধ করার মত করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাঁরা কী নিশ্চিত হয়েছে যে ইন্টারনেট প্রশ্নফাঁস করে? আসলে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের মাঝেই সমস্যা প্রতীয়মান। গোড়ায় হাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরে ইন্টারনেটে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাও নির্দিষ্ট কিছু ফেসবুক পেজ, গ্রুপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতেও। আর এই ধরনের সাইটগুলোতে অগ্রিম কিছু কাস্টমারও তৈরি করে রাখে। তাঁদের মাধ্যমেই প্রশ্নফাঁস ছড়িয়ে দেয়।

ইতোমধ্যেই প্রশ্নপত্র ফাঁস-এর সাথে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আবার প্রশ্ন ফাঁসে ব্যবহৃত ৩০০ মোবাইল ফোন নম্বরও চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা ইতবাচক। এখন তাঁদের সাথে আরও কারা-কারা জড়িত, তাঁদের পিছনে কে আছে, কীভাবে প্রশ্নফাঁস করে মাঠের কর্মীদের হাতে হাতে পৌছে দিচ্ছে; সেটা খুজে বের করার একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেদিকটায় একটু পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে।

আরেকটা বিষয় অত্যন্ত দুঃখজনক। অতীতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে যাঁরা গ্রেফতার হয়েছিল তারা জামিনে ঘুরে বেরাচ্ছে। তাঁদের অপরাধ প্রমাণ করে দৃষ্টান্ত শাস্তির বার্তা দিতে না পারাও প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত মহলের মধ্যে ঔদ্ধত্য সৃষ্টি হয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যত রকমের ঘোষণাই আসুক না কেন, প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং তাঁরা সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস করে যাচ্ছে।

আমাদের বুঝতে হবে, যে দেশে কতিপয় অপদার্থ শিক্ষক ও অভিভাবক মিলে-মিশে জেনে-শুনে প্রশ্নফাঁস ও ক্রয় করে শিক্ষার্থী ও সন্তানের জীবন ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী প্রশ্নফাঁস রোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সরকারসহ সামাজিক আন্দোলন, জন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।

প্রশ্নফাঁস যে শুধু পরীক্ষার ক্ষেত্রে হয় তা নয়। সরকারি, বেসরকারি চাকুরির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র-ও সমানতালে ফাঁস হয়ে আসছে। অর্থাৎ এই অপরাধের সাথে একটি অপশক্তি সরাসরি সম্পৃক্ত যাদের হাত অনেক গভীরে। যাদের একটি অভিজ্ঞ টিমও রয়েছে। তাই চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে মুল অপরাধীদের দিকে যেতে হবে। মাঠের কর্মীদের হাত ধরেই প্রশ্নফাঁসের মুল অপরাধীর দিকে এগুতে হবে।

সাম্প্রতিক দুর্নীতি দমন কমিশনের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক দলের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রও যুক্ত থাকতে পারেন বলে দুদকের তদন্তকারীদের ধারণা বলে উল্লেখ করেছে।

এবং দুদকের ওই প্রতিবেদন দেওয়া হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে, যেখানে প্রশ্ন ফাঁস, নোট-গাইড, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতি রুখতে ৩৯ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।

আবার দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ৪০টি ধাপে প্রশ্ন ফাঁস হয়। যেমন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, বিজি প্রেসে কম্পোজ, প্রুফ দেখা, সিলগালা করা ও বিতরণ এবং পরীক্ষার দিন কেন্দ্রে অসাধু শিক্ষকের মাধ্যমেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। আর এ কারণেই শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে শিক্ষাবোর্ড, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, কোচিং সেন্টার, গাইড বই ব্যবসায়ী ও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অনেকে সরাসরি জড়িত। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে আকারভেদে ২০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থের লেনদেন হয় বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আমার মনে হয় এগুলোকেও আমলে নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ না করে যত রকমের নতুন-নতুন সিস্টেম চালু করা হোক না কেন, তার সুফল আসবে না।

এখানে ফেসবুক বন্ধ, ইন্টারনেটে ধীর গতি প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব নয়। বরং এতে সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন আসবে।

সরকারি, বেসরকারিসহ বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যেই কিছু পরামর্শ এসেছে। প্রতিটা কেন্দ্রে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র তৈরি করা, ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষার হলেই প্রশ্নপত্র বড় ডিসপ্লেতে-শো করা কিংবা পরীক্ষার্থীর সামনে রাখা একান্ত মনিটরে পরীক্ষার শুরুর সময় প্রশ্নপত্র আপলোড করা ইত্যাদির বিষয়াদি সাময়িক সুবিধা দিলেও আমাদের দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান নকল বন্ধ, নকল না করে পরীক্ষা দেওয়ার প্রবনতা এবং অভিভাবকদের মাঝে ফাঁসকৃত প্রশ্নের প্রতি অনিহা সৃষ্টি করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেই সাথে এই ধরনের অপরাধের সাথে যারা জড়িত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।

শুধু ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগযোগ বন্ধ করলেই প্রশ্নফাঁস বন্ধ হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ দেশে ধারাবাহিক জঙ্গি হামলা ও হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিদের যোগাযোগের পথ বন্ধ করার লক্ষে ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর দেড় ঘণ্টা ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে ইন্টারনেট চালু করলেও পরবর্তী ২২দিন বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বেশ কয়েকটি অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ ছিল।

ফলাফল- গ্রামের সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীও বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর তখন ইন্টারনেট বন্ধ করার কারণেই জঙ্গি হামলা বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং দেশের মানুষের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযান আজ সন্ত্রাস-জঙ্গি প্রায় সরকারের নিয়ন্ত্রণে।

এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের ইন্টারনেট গ্রাহক ছিল ৮ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে সাড়ে ৭ কোটি গ্রাহকই মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ছোট্ট দেশের বিশাল এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাঝে আমরা শৃঙ্খলা ও মানুষে-মানুষে সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করতে পারিনি। প্রকাশ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য, ভিডিও ভাইরাল করার পরেও তাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। বিতর্কিত পোস্ট ডিলেট করা আদৌ সম্ভব হয়ে উঠেনি। ব্যক্তি বিদ্রুপ ছড়িয়ে সমাজ-রাষ্ট্রকে আঘাত করছে। ধর্মীয় অনুভুতির নামে ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রগুলো ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, আমরা এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুকের অ্যাডমিন বসাতে পারেনি। এটা সরকারের ব্যর্থতা।

ইন্টারনেট মানুষকে চালায় না, মানুষ ইন্টারনেট আবিষ্কার করে ইন্টারনেট চালায়। ইন্টারনেটে এই মানুষ ইতিবাচক, নেতিবাচক যার যার মতন করে তথ্য-ছবি ভাইরাল করে। আর সেখানে বিভিন্ন অ্যাপ যুক্ত করে নিজের সুবিধা মত ব্যবহার করে থাকে। যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ভাইরালের মাধ্যমে কতিপয় মানুষ নিজের একান্ত স্বার্থ লাভে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। ইন্টারনেট বন্ধ সাময়িক সুবিধা আসলেও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ইন্টানেটে প্রশ্নফাঁস ভাইরাল করা সাময়িকভাবে বন্ধ করা গেলেও প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ কতিপয় অসাধু ব্যক্তি প্রশ্নফাঁস করে, ইন্টারনেট নয়।

আধুনিক সভ্যতায় দিন-দিন নতুন কিছু আসছে। সেদিকে মানুষও দৌঁড়াচ্ছে। আর এ দৌঁড় বন্ধ করা সময় উপযোগি সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ইন্টারনেট ব্যবহার, উন্মুক্ত তথ্য সরবরাহ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের সত্যিকারের সেবা সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌছে দিতে ইন্টারনেটের বিকল্প এখনো কিছু সৃষ্টি হয়নি। আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের রাস্তা বের করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি বন্ধ করে নয়, বরং তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সকল অপসংস্কৃতি, ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড প্রতিহত করার কৌশল গ্রহণ করাই হবে সময় উপযোগি সিদ্ধান্ত।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test