E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বজ্রপুরের গল্প

২০১৪ জুলাই ০৬ ১৬:৫৩:২৪
বজ্রপুরের গল্প

প্রবীর বিকাশ সরকার : মানুষের জীবনে অনেক গল্প থাকে। ছোট ছোট পোকা-মাকড়ের মতো গল্প। অনেক সময় তা দেখা যায় না। ওরা গা লুকিয়ে রাখে পাতালতার আড়ালে। অনেক গল্প বিস্মরণের তলে তলিয়ে যায়।

আবার কোনো কোনো গল্প তুষের আগুনের মতো জেগে থাকে বহু বছর। কোনো কোনো গল্প মরে গিয়ে ফসিল হয়ে যায় যেন মৃত ইতিহাস। আমার জীবনেও এমন অনেক গল্প আছে।

ক্ষণিকের ভালোলাগায় কিংবা ঘটনার বশে সেগুলোর জন্ম হয়েছিল। আমার অন্যতম প্রিয় শিল্পী অনুপ ঘোষালের একটি বিখ্যাত গান আছে সেই গল্পগুলো সম্পর্কে খাটে, গানটি হল: ‘আমার এ ভালোবাসা / জানি গো তোমার / ক্ষণিকের ভালোলাগা ফুল / ক্ষণিক লহরি মাঝে দিয়েছিলে ঠাঁই / তারপরে ভেঙে গেছে ভুল..........।’

কুমিল্লা শহরের একটি বিখ্যাত পাড়ার নাম বজ্রপুর। কারণ এখানে রয়েছে ঐতিহ্যখ্যাত ইউসুফ হাই স্কুল। তাছাড়া অনেক পুরনো আনন্দময়ী কালীবাড়ী। মন্দিরের চত্ত্বরে রয়েছে শিবমন্দিরও। যেখানে কালী সেখানে মহাদেব থাকবেন।

আমার যৌবনের প্রথম দিকের কথা। যে সময় এই পাড়া শুধু নয়, কুমিল্লা শহরে প্রচুর হিন্দু পরিবার ছিল। বজ্রপুরেও ছিল। জায়গাটিতে কবে বাজ পড়েছিল নাকি আদৌ পড়েনি তা জানার দারুণ এক কৌতূহল আমায় পেয়ে বসেছিল। আমার হাই স্কুলের জীবনে সহপাঠি ছিল বরিশালের জগদীশচন্দ্র শীল নামে এক নেশাখোর বন্ধু। তার বাবা ছিল পুলিশ কনস্টবল। ওরা থাকতো গর্জনখোলার গিঞ্জি মুচি-মেথর পাড়ায়। মাঝে মাঝে ওর বাসায় যেতাম। তার আপন মা ছিল না। প্রায়শ সৎমার অত্যাচার সইতে হত। ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকত। যে কারণে সে মনের দুঃখে সেই বয়সে ভাঙ, গাঁজা টানত আর পাশের ডেরার মুচিদের তৈরি চোলাই পান করত। মিথ্যে বলব না, আমিও মাঝে মাঝে নিছক কৌতূহলবশত স্বাদ নেবার জন্য বা তাকে সঙ্গ দেবার জন্য কলকিতে টান দিয়েছি। তবে চোলাই গলধঃকরণ করিনি কারণ ওটার ভীষণ দুর্গন্ধ বাসায় গেলে দারোগার মেয়ে আমার মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাবই যাব। কারণ মা মাতালদের ভালো করে চেনে মামলার জন্য দাদুর কাছে আসত মাতাল হয়ে অনেকেই। এরা ছিল তখন ছোট খাটো পথব্যবসায়ী, পকেটমার, চোরাচালানী, ছিঁচকে চোর এরকম নিম্ন পেশার লোকজন। তাছাড়া আমার এক স্টাইলিস্ট মামা ছিলেন মাঝে মাঝে সিলেট থেকে এসে আমাদের বাসায় থাকতেন কাজ উপলক্ষে রাতের বেলা পাগলা পানি টেনে টুইটুম্বুর হয়ে আসতেন। মা গন্ধটায় বিরক্ত হত। কাজেই নচ্ছার গন্ধটা মা জানে। গাঁজা-ভাঙের গন্ধ টের পাওয়া যায় না। সুগন্ধী একটা পান চিবোলেই হয়। নাহয় দুধ খেয়ে নিলে ভালো। আমি যেদিন ওর দেয়া কলকিতে জোরে টান দিলাম অমনি হাতের তালু গরম হয়ে গেল! ধমক দিয়ে বলল ধোঁয়া না ছেড়ে গিলে ফেলতে হবে। আমিও তাই করলাম। ব্যাস অমনি মাথা দিল ভোঁ করে এক চক্কর, পড়ে যাচ্ছিলাম জগা ধরে ফেলল আমাকে এবং দড়ির খাটিয়ায় শুইয়ে দিল। ওভাবেই নেশার ঘোরে নাকি ঘুমের ঘোরে তিন ঘণ্টা নিশ্চেতন ছিলাম।

যাহোক, জগাকে বললাম, ‘তুই তো খুব পড়িস। বজ্রপুরের ইতিহাসটা আমাকে বলতে পারিস?’

সে হেসে বলল, ‘হেইডা তুমি কী কও? এইডা কাজ হইল? আমি ইতিহাস পড়ে জানায়ে দেবা নে।’

কিন্তু আমার সন্দেহ হল। সে আমাকে কী ইতিহাস জানাবে! প্রতিদিন স্কুল শেষে বিকেলবেলা ঢুকে পড়ে মুচিদের ঘরে। কি করে কি খায় সেই জানে। বাসায় গিয়ে পাই না। নিরুদ্বেগ ওর সৎমা বলে ফিরেনি এখনো। একদিন রাতের বেলা তাকে আবিষ্কার করি এক মুচির ছাপড়া থেকে টাল হয়ে বেরোচ্ছে। পথ আটকে বললাম, ‘জগা দাঁড়া। আমাকে বজ্রপুরের ইতিহাসটা তো বললি না। কবে বলবি? প্রতিদিন মাল খেয়ে টাল হয়ে থাকিস, খুঁজে পাওয়া যায় না। শালা মরে যাবি নাকি?’

জগা তখন চূড়ান্ত মাতাল। ঢুলে ঢুলে বলল, ‘মনু, রেগে যাচ্ছো ক্যান্, খেলাম আমি ধরল তোমাকে, উল্টা-পাল্টা বকছো দেহি! আরে বজ্রপুরটা কই জায়গায় য্যানো? বরিশালে তো বজ্রপুর নাই জানি।’

লে ঠ্যালা! বুঝলাম ও আর কুমিল্লায় নেই! ওর থেকে ইতিহাস আর আদায় হচ্ছে না। বাসনা ত্যাগ করতে হবে। তবে না সে ভুলে যায়নি। একদিন দুপুরবেলা ছুটির দিন। স্বাধীনতার পর তখনো সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রোববারে। হন্তদন্ত হয়ে আমার বাসায় এসে হাজির। আমরা তখন মধ্যাহ্নভোজ করব। বাবাও বাসায়। বাবা তো পুলিশ কোর্টের জিআরও। জগার বাবাকে তো চেনেই জগাকেও চেনে। আমরা একসঙ্গে ভাত খেলাম। খেয়েদেয়ে ছাদে ওঠে নারকেল গাছের ছায়ায় বসে সে তার ঝোলা থেকে কৈলাশচন্দ্র সিংহের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজমালা’ যা ত্রিপুরা জেলার ইতিবৃত্ত সেটা দেখালো। সেই সঙ্গে আরও তিনটে সংস্কৃতভাষায় লিখিত বই। জানালো এগুলোতেই আছে বজ্রপুরের ইতিহাস কোনো ভুল নেই। এক সপ্তাহ সময় ধার দিতে অনুরোধ করল এর মধ্যে সে পড়ে জানাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। যাক, আমি এবার নিশ্চিন্ত হলাম। আবার আশায় বুক বাঁধলাম। বজ্রপুরের ইতিহাসটা জানা যাবে তাহলে। কেন বজ্রপুর হল?

এরপর কত সপ্তাহ যে চলে গেল তার হিসেব নেই। সে বই পড়েই পড়ে। সংস্কৃতভাষা ভালো জানে না তাই কষ্ট করে পড়তে হচ্ছে বলে মনে হল আমার। একদিন স্কুলের হেডপন্ডিত যিনি সনাতন ধর্ম পড়ান তার ছেলে স্বপন আমাদের সঙ্গে পড়ত। রাস্তায় পেয়ে বলল, ‘আরে সাংঘাতিক অবস্থা!’

আমি মাথায় বজ্রপড়ার মতো চমকে উঠে বললাম, ‘কেন? কী হল আবার? সারা বছরই তোর অসুখ লেগে থাকে। স্কুলে এসে তো সারাক্ষণ পায়খানাতেই থাকিস! ভালো করে চিকিৎসা করা কোনো ডাক্তারকে দিয়ে, না হলে তো মরবি ব্যাটা!’

স্বপন লাফিয়ে ওঠে বলল, ‘আরে না আমি এখন ভালো। জগার কথা বলছি।’

আমি আরও অবাক, ‘জগা কী আবার তোকে মেরেছে? ব্যাটা একটা মাতাল। শালা মরবে দেখিস।’

স্বপন গলা চড়িয়ে বলল, ‘আরে না। এখন আর মারে না। এক ঝামেলা বাঁধিয়েছে। প্রতিদিন ভোরবেলা এসে বাবার কাছে সংস্কৃতভাষা শিখছে। কী নাকি বজ্রপুরের ইতিহাস খুঁজছে। জানিস তো বাবা এখন বুড়ো হয়ে গেছে কি বলতে কি বলে। কি শুনতে কি শোনে। ভোর পাঁচটা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত দুজনে সেকি সংস্কৃতভাষা নিয়ে লড়ালড়ি পাড়াপাড়ি দাপাদাপি আমরা ঘুমুতে পারি না। এক মহা মুশকিলে আছি দুই পাগলকে নিয়ে!’

‘এ্যাঁ’ করে চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমি। এবার সত্যি আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন, লে বাবা! হায়রে কেন যে তাকে বজ্রপুরের ইতিহাস জানাতে বললাম! এখন তো দেখছি পাড়া মাথায় তুলে নেবে। কী বিপদ!

যাহোক, স্বপনকে শান্ত করে জগাকে ধরব বলে চিন্তা করলাম। কিন্তু পরের দিন পুকুরের ঘাটে জমে থাকা শ্যাওলাতে পিছলে পড়ে ডান পা মচকে ফেললাম। এবার মা আমাকে নিয়ে ডাক্তার- হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। পা ভালো হতে হতে এক সপ্তাহের ওপর লেগে গেল। স্কুলে গিয়ে শুনলাম গত কয়েকদিন ধরে জগা আসে না। কেন? কী অঘটন ঘটিয়েছে কে জানে। মনে মনে বললাম, ‘ও হরি ওকে রক্ষা কর্ বাবা। মামরা ছেলে, বাপ উদাসী!’ বিকেলবেলা গেলাম গর্জনখোলার মুচিপাড়ার বস্তিতে। গিয়ে দেখি মেসোমশাই মানে জগার বাবা ঘরের বাইরে টুলে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন মাথায়। হালকাপাতলা গড়নের মানুষ ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যার শতভাগ। বললেন, ‘আরে কইয়ো না। পরতি সন্ধেবেলা মদ খায়। এই পাড়ায় আমার মানইজ্জৎ ডুবাই দেছে। পুলিশ দিয়া ওরে বরিশাল গ্রামে পাঠায়ে দেলাম। আর আইবো না।’

‘এ্যাঁ’। আবার আমার মাথায় বজ্রপাত হল! বলে কী! জগার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হবে না! তাই কী হয়! বজ্রপুরের ইতিহাস জানার পথঘাট সব সিলগালা করে দিয়ে জগা উধাও হয়ে গেল বিনা নোটিশে!

যথারীতি কুমিল্লা হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করলাম। জগার জন্য মনটা খুব খারাপ ছিল কিছুদিন। সে বরিশালে গিয়ে পরীক্ষা দিল কিনা তাও জানলাম না। ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলাম আমি। এর মধ্যে সাহিত্যচর্চা শুরু হয়ে গেছে আমার। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ সেটা করেছে বলে জানা নেই। সবই ঈশ্বরের লীলা খেলা। আমরা তার হাতিয়ার মাত্র। ছড়া লিখি। কবিতা লিখি। কিশোরী দেখলেই কবিতা মাথায় চলে আসে। বাংলা সাহিত্যের মহারথিদের বই গোগ্রাসে গিলছি। সাহিত্য পত্রিকায় ডুবে থাকি। যেমন দেশ, শিলাদিত্য, চতুরঙ্গ, সমকাল, অনুষ্টুপ ইত্যাদি। এখানে সেখানে ছড়া ও কবিতা পাঠ করি। পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে। মোটামুটি শহরে একটা পরিচিতি এসে গেছে। কলেজের চায়ের স্টলে তো বটেই, কলেজরোডের কালুদার চার দোকান, দাদার টি স্টল, সুইট হোমে সকাল বিকাল সন্ধে পর্যন্ত তুমুল আড্ডা আর আড্ডা। শরীরে মরদ মরদ ভাব। নাকের নিচে কালো গোঁফ বেশ ঘন হয়ে উঠছে। এনার্জি ক্ষয় না করলে টিকে থাকা মুশকিল। তাই সিগারেট একটার পর একটা ঠোঁটে ঝোলাই থাকে। নেশায় তো হাতেখড়ি হয়েই গেছে প্রিন্সিপাল জগার হাতে। এগুলোতে এনার্জি ক্ষয় হয়, ক্লান্তি আসে শরীরে তারপর নির্ভেজাল ঘুম।

বজ্রপুরের গলির মুখে একটা চায়ের দোকান ছিল। নামটা ভুলে গেছি। সুস্বাদু পুরী ভাজত মৌ মৌ করত এলাকাটা। ভিড় লেগে থাকত সবসময়। সেখানেও আমরা কবিবন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। প্রায় তিরিশ বছর পর এবার গিয়ে দেখি দোকানটি বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। খুব দুঃখ পেলাম। কত স্মৃতি এই দোকানে আছে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্তের। বিশেষ করে দুর্গা ও সরস্বতী পুজোর মৌসুমে এখানে বসে আড়ালে মৃতসঞ্জিবনী গিলে ফেলার। পুজোর সময় হিট হিন্দি গানগুলো শুনে শুনে বন্ধুরা মিলে হৈ হল্লা করতাম। পাশেই মন্দিরে গিয়ে এক প্রস্ত নেচে আসতাম। ডোপিং তো আছেই। মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে সন্ধেবেলা আমি একা মৃতসঞ্জিবনীর বোতল নিয়ে একেবারে শেষ বেঞ্চিতে বসে পুরীর সঙ্গে টানতাম। দারুণ এক রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে যেতাম। কেন তা বলতে পারব না। মনে হয় সেই বয়সে এরকম একটা প্যাশন দেহমনে কাজ করে। অনেক ঘটনা। অনেক স্মৃতি। ওই যে বললাম জীবনে ছোট ছোট গল্প থাকে যা ভুলে যায় মানুষ। পুনরায় স্মরণ হয় কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই ঘটনাই এবার দেশে ফিরে ঘটল। আনন্দময়ী কালীবাড়ী মন্দিরে গেলাম প্রায় ৩০ বছর পরে। চত্ত্বরে দাঁড়ালে পরে কত স্মৃতি কত মুখ মনে পড়ে গেল। একটি কিশোরীকে দেখে তখনই চট করে মনে এসে গেল শিবানীর মুখ। আরে শিবানী তো এই বজ্রপুরেই ছিল! আমার বন্ধু সুব্রত কুমার সাহার ছোট বোন। ফর্সা গোলগাল দুগ্গা-দুগ্গা চেহারা ছিল মেয়েটির। হৃদহন্তারক হাসি দিয়ে কতবার যে এলোমেলো করে দিয়েছে আমাকে। এখনো আছে কি ওরা? এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত খোঁজ করলাম কিন্তু তাদের একতলা টিনশেডের বাড়িটি দেখতে পেলাম না। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। এত বদলে গেছে পাড়াটি। এ পাড়া কেন পুরো কুমিল্লা শহরকে এখন আর চেনা যায় না নগরায়ণের ক্রংকিটের জঙ্গলের কারণে।

পরে আমার মতোই সমবয়সী একজনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সুব্রতর নাম ‘চাঁদের হাট’ শিশু সংগঠন করত ছেলেটি চেনে কিনা। একটু ভেবেই জানালো চিনেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে জানালো, ‘ভাই, ওরা তো অনেক আগেই আগরতলা চলে গেছে। তবে ওর বোনের বিয়ে হয়েছে চট্টগ্রামে মনে হয় ওখানেই আছে। বিয়ের পর আর দেখিনি।’

কী আর করা। বজ্রপাতের মতোই বটে এই দুঃসংবাদ। কতকিছু বদলে গেছে। বদলে গেছে জীবন। হাঁটতে হাঁটতে চললাম নানুয়া দিঘির দিকে। এখন সিমেন্টের পাকা রাস্তা। জল জমে থাকে না। কাদাও নেই। দুপাশে এখনো অনেক ছোট ছোট স্বর্ণকারের দোকান হিন্দুদের। তবে আগের মতো জৌলুস নেই একেবারে। এক-দুই ঘর হিন্দুর মাঠা-দই বিক্রির দোকান এখনো বিদ্যমান।

দিঘির পাড়ে আসতেই প্রবল বাতাস ঝাপটে ধরল। বিশাল দিঘির চারদিকে চমৎকার সব বাড়িঘর এবং বিখ্যাত শৈলরানী বালিকা বিদ্যালয়। ছবির মতো অপূর্ব। যৌবনের উত্থানলগ্নে মাঝে মাঝে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে এসেছি এখানে বন্ধুদের সঙ্গে। প্রচুর মাছ ছিল এই দিঘিতে। কুমিল্লা একসময় ব্যাংক আর ট্যাঙ্কের জন্য বিখ্যাত ছিল। বৃটিশদের কৃত পরিকল্পিত শহর ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে তার জৌলুস হারাতে থাকে। একসময় চারদিকে প্রায় সবাই ছিল হিন্দু এখন কয়েকটি পরিবার ছাড়া নেই চলে গেছে দেশান্তরী হয়ে। উত্তরপূর্ব কোণায় ছিলেন যশস্বী ডাক্তার নিত্যহরি সাহা। তিনি মারা যাওয়ার পর বাড়িটি মনে হয় ছেলেমেয়েরা বিক্রি করে দিয়েছে না হয় কেউ দখল করে নিয়েছে জানি না সঠিক। বুকটা কেমন করে উঠল ফটকওলা দ্বিতল বাড়িটি দেখে। ছোট্টবেলায় মায়ের সঙ্গে এসেছি একাধিকবার তাঁর কাছে তিনি আমার পায়ের চিকিৎসা করেছিলেন।

দিঘির প্রাচীন ঘাটের সিঁড়িতে বসলাম। মনে পড়ল অনেক আগে এক চাঁদনী রাতে বসে বেশ কয়েকটি সিগারেট টেনেছিলাম একা একা। যে বছর শিখার বিয়ে যায়। শিবানীর মুখ আবার মনে পড়ল। দেখা হলেই হন্তারক হাসিটি দিয়ে বলত, ‘পটুদা, কই চিঠি তো লিখলেন না আমাকে!’ একবার কোন্ ক্ষণে সুব্রতর সামনেই ওকে দুষ্টুমি করে বলেছিলাম, ‘এত সুন্দর হচ্ছিস দিনকে দিন তোর সঙ্গে প্রেম করতে হবে। চিঠি লিখব কিন্তু!’

হেসে গড়িয়ে পড়েছিল শিবানী, ‘আমার সঙ্গে প্রেম করবে! বলো কি পটুদা! বেশ একটা চিঠি লিখো আগে।’ যেখানেই দেখা হত বলত, ‘কই পটুদা, তুমি চিঠি কবে লিখবে! দিন যে ফুরিয়ে যায়। আকাশে চাঁদ জেগে থাকতে থাকতে চিঠি লিখো।’ আমি হা হা করে হেসে উঠতাম, ‘লিখব। লিখব। ঠিক লিখব। উত্তর দিবি তো?’

‘কেন? সন্দেহ হচ্ছে? তবে উত্তর দেবার মতো না হলে কিন্তু উত্তর পাবে না!’ দারুণ জবাব দিয়েছিল শিবানী।

না। শিবানীকে কোনোদিন চিঠি লেখা হয়ে ওঠেনি।

লেখক জাপান প্রবাসী

(এটিআর/জুলাই ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test