E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রিয়জন জামানভাই

২০১৪ জুলাই ০৮ ১৯:০৬:০৩
প্রিয়জন জামানভাই

প্রবীর বিকাশ সরকার: যখন খুব প্রিয়জন কেউ চলে যান চিরতরে তখন তিনিও যেন কিছুদিনের আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান, কোথাও নিজেকে খুঁজে পাই না। নিজের মধ্যেই এক গভীর শূন্যতার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাই। অব্যক্ত শোক-পরিতাপ-বেদনা ভারী পাথরের মতো চেপে বসে বুকের ওপর আমি শক্তিহীন হয়ে পড়ি। সহসা সেই অনুভূতি প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকে না। ধীতস্থ হয়ে নতুন করে সেই চলে যাওয়া বা আমাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষটিকে নিয়ে ভাবতে বসি। দ্রুত শোক জানানোর শিক্ষা বা সংস্কৃতি আমি আয়ত্ব করতে পারিনি আজও। এটা আমার দুর্বলতা। তাই কেউ কেউ আমাকে ভুল বোঝে থাকেন।

আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষদের অন্যতম ছিলেন জামানভাই ওরফে ফখরুজ্জামান চৌধুরী। এই বছর ১২ জুন তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দূরারোগ্য ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমনারি (সিওপিড) অসুখে ভুগছিলেন। তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখে আমি অশ্রুসিক্ত হয়েছি।

ফখরুজ্জামান চৌধুরী এই নামের সঙ্গে সব প্রজন্মের মানুষই পরিচিত বলে মনে করি। তথাপি অতিসংক্ষিপ্ত করে তাঁর পরিচয় তুলে ধরলে বলতে হয়: ১৯৪০ সালে চাঁদপুরে জন্ম ফখরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন একজন স্বনামধন্য মননশীল অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, উপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। একসময় কবিতাও লিখতেন তিনি গত শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে তাঁর লেখালেখির চর্চা শুরু। কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকায় গল্প ছাপা হয়েছিল। তাঁর অনুবাদগুলো বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের অমর সম্পদ। জনসম্মুখে স্পষ্টভাষী না হলেও লেখায় তিনি ছিলেন সুস্পষ্টভাষী, যুক্তিবাদী, তীক্ষè দৃষ্টিভেদ সচেতন এবং সূক্ষ্মঅনুভূতিসম্পন্ন। হিউমর বা রসবোধ ছিল তাঁর অসামান্য, তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন একমাত্র তাঁরাই বলতে পারবেন কেমন রসালো ভাষা, উপহাস, সমালোচনা তিনি করতে পারতেন শৈল্পিকভাবে। এইসব কারণে বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের বই অনুবাদ করতে পেরেছেন, কখনো কখনো রূপান্তর। সূক্ষ্মঅনুভূতিসম্পন্ন না হলে অনুবাদ বা ভাষান্তর সম্ভব নয়। এই বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। জাতির জন্য তিনি রেখে গেছেন কীর্তিময় অসাধারণ গ্রন্থসমূহ যেমন: অঙ্কুশ ঐরাবত, রিপভ্যান ইউঙ্কেল, আনাবাজ, দূরদিগন্ত, প্যালেস্টাইন প্রতিরোধের কবিতা, জনারণ্যে কয়েকজন, একা ও একাকী, লেখকের কথা, হাড়কিপ্টে বুড়ি, রাজা আর্থারের দরবারে, যাদুর রাজা হুডিনি, আঙ্কল টমস কেবিন, রবিনসন ক্রুশো, হাঞ্চ ব্যাংক অব নটরডেম, ট্রেজার আইল্যান্ড, রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, হে দুঃখ বিদায় এবং বিকিকিনির প্রেম। তাঁর শেষ গ্রন্থ অনুবাদ হিরোশিমার অগ্নিশিখা। এতো গেল তাঁর বুদ্ধিতাত্ত্বিক পরিচয়। এই পরিচয় তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিভার মূল্যায়নস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। শিশুসাহিত্যের জন্য অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার অর্জন করেছেন।

সামাজিক পরিচয় হিসেবেও তিনি ব্যাপকভাবে কর্মবিস্তৃত ছিলেন, বাংলা একাডেমীতে কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রশাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন।

ভাবগম্ভীর প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটির সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয়ের আগে তাঁর লেখায় তাঁকে চিনি সেই তরুণ বয়সে। জাপানে আমার কাগজ ‘মানচিত্রে’ তিনি লিখেছিলেন বলে মনে পড়ে। প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটল ২০০৯ সালে যখন তিনি বার্ধক্যে উপনীত কিন্তু সচল। প্রচন্ড শ্বাসকষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি কথা বলতেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। ফোনে কথা হলেই সম্বোধন করতেন ‘ও প্রবীর’ বলে, আহা এত মায়ামাখা কণ্ঠস্বর ভুলি কীভাবে! কথা বলতে চাইতেন কত কথা, কিন্তু অনর্গল বলতে পারতেন না, থেমে থেমে বলতেন। লেখা প্রকাশিত হলে সঙ্গেসঙ্গে মেইল করে দিতেন লিঙ্ক, বা পিডিএফ ফাইল।

২০০৯ সালে টোকিওর য়োয়োগি উদ্যানে সস্ত্রীক গিয়েছিলাম বাংলাদেশের একটি মেলায়। সেখানে গিয়ে দেখি দিলারা জামান মেলায় ঘুরছেন তাঁর সঙ্গে ছিমছাম দীর্ঘদেহী একজন মানুষ। পত্রিকায় দেখা ছবি মনে পড়ে গেল। দৌড়ে গেলাম তাঁদের দিকে। বললাম, ‘আরে জামানভাই না?’ তিনিও অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে পেয়ে বলে উঠলেন, ‘হে! আরে প্রবীর!’ (তিনি আমার লেখা পড়তেন, ছবিও দেখেছেন তাই সহজে চিনতে পেরেছিলেন।) করমর্দন করলাম। ভাবীর সঙ্গে পরিচয় হল। আমি আমার স্ত্রীকে তাঁদেরকে সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ছবি তুললাম। হাঁটতে হাঁটতে নানা কথা। এর ওর খোঁজ নেয়া। সেদিন জানলাম তিনি চাঁদপুরের লোক। তাঁর ছোটভাই আহমেদ জামান চৌধুরী চিত্রালী সম্পাদক, গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপরচয়িতা, ‘বাদী থেকে বেগম’খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। একসময় আহমেদ জামান চৌধুরী ও তাদের এক ছোটভাই কুমিল্লা ঝাউতলাতে থাকতেন। স্বাধীনতার পরও আমি তাঁদেরকে দেখেছি বলে মনে পড়ে। মাঝেমাঝে আসতেন কুমিল্লায় জামানভাই। আড্ডা দিয়েছেন পাকিস্তান আমলে কলেজরোডের প্যানোরমা বইয়ের দোকানে। এটা ছিল খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব আবু মিয়ার। তাঁর ছেলে আজাদ আমার বন্ধু। আমরাও ভিক্টোরিয়ার ছাত্র যখন প্রচুর আড্ডা দিয়েছি, বই কিনেছি এই দোকানে। প্যানোরমা এখনো আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ‘না এখন নেই। দোকানটি আছে আজাদই চালাচ্ছে তবে কপিয়ার, টাইপিং এর ব্যবসা হচ্ছে।’ স্মৃতিকাতর হলেন জামানভাই, ‘কুমিল্লায় কত স্মৃতি আমার।’

সেদিন সন্ধে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। তিনি তখন সাইতামা-প্রিফেকচারে মেয়ে তানিয়ার বাসায় উঠেছেন। তানিয়া দাঁতের চিকিৎসা বিষয়ে উচ্চগবেষণা করছে। এর আগে ছিল জাপানেই ফুকুওকা শহরে। সেখানেও জামানভাইরা মাঝে মাঝে এসে থেকেছেন। কিন্তু জাপানকে ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ মেয়ে ও তার জামাই দুজনেই খুব ব্যস্ত গবেষণা নিয়ে। আমি বললাম, ‘টোকিওর কাছেই যখন আছেন আমি একদিন আপনাদেরকে টোকিওর কিছু জায়গায় নিয়ে যাবো সেগুলো বিশ্বখ্যাত বাঙালির স্মৃতিবিজড়িত যা উভয় বাংলার বাঙালিরা জানে না বললেই চলে।’

শুনে দুজনেই এত খুশি হলেন যেন এখনি উড়াল দেন। পরক্ষণেই ভাবী বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের যে হাঁটার সমস্যা।’ আমি জামানভাইকে বললাম, ‘মনে করুন আপনি অজানা এক বিস্ময়কে আবিষ্কার করতে যাচ্ছেন, তাহলে দেখবেন আপনার শরীরে শক্তি এসে গেছে। মনের জোরে এগিয়ে যেতে হবে। টোকিও হচ্ছে হেঁটে হেঁটে আবিষ্কার করার জগৎ। গাড়িতে নয়। চলুন।’

এক রবিবারে সকালবেলা আমি সাইতামা গেলাম তানিয়ার বাসায়। তার সঙ্গে পরিচয় হল। ছোট্ট একটি ছেলে জামাই নিয়ে তার সংসার। অবশ্য তানিয়া তখন সন্তানসম্ভবা ছিল। আমি জামানভাই ও ভাবীকে নিয়ে বেরোলাম। ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে বাসার কাছেই বাসে চড়লাম, তারপর ট্রেনে সোজা শিনজুকু। জামানভাই বইয়ের দোকানে যেতে চেয়েছিলেন। নিয়ে গেলাম শিনজুকু শহরে বিখ্যাত ‘কিনোকুনিয়া’ বইয়ের দোকানে যেখানে বিদেশি বই বিস্তর। সাততলাবিশিষ্ট বইয়ের দোকানে প্রবেশ করে জামানভাই ও ভাবী অভিভূত। ভাবী একসময় গল্প, উপন্যাস লিখেছেন। এই লেখালেখি থেকেই জামান ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বলছিলেন ঘুরতে ঘুরতে। কিনোকুনিয়ার পাশেই জাপানখ্যাত শতবর্ষপ্রাচীন ‘নাকামুরায়া’ রেস্টুরেন্ট। সেটার দোতলায় নিয়ে গেলাম। তখন দুপুর প্রায়। বসে বললাম, ‘এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর শ্বশুরালয়। এই দোতলায় তিনি একটি প্রথম ভারতীয় কারির রেস্টুরেন্ট ‘ইনদো নো মোন’ বা ‘ভারতের তোরণ’ স্থাপন করেছিলেন ১৯২৭ সালে শ্বশুরের সহযোগিতায়। এর আগের বছর তাঁর জাপানি স্ত্রী তোশিকো বসু লোকান্তরিত হন। এবং এই রেস্টুরেন্টই হয়ে উঠেছিল কালক্রমে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অঘোষিত দপ্তর, যোগাযোগ মাধ্যম। আজও তাঁর রন্ধনকৃত মুরগীর কারি পরিবেশন করা হয়। শুধু তাই নয়, এখন প্যাকেটজাত নাকামুরায়ার ইনদো কারি সারা জাপানেই বিক্রি হচ্ছে ব্রান্ড হিসেবে। জাপানের ঐতিহ্য এখন এই কারি।’ এই অজানা ইতিহাস শুনে চমৎকৃত হলেন দুজনেই। এখানে খাওয়াদাওয়া হল। স্মারক ছবি তুললাম।

শিনজুকু থেকে কাছেই নিয়ে গেলাম সুগিনামি-ওয়ার্ডের রেনকোওজি বৌদ্ধমন্দিরে। এখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে। জাপানিরা মনে করেন ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট নেতাজি তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর জাপানি সহকর্মীরা চিতাভস্ম জাপানে নিয়ে এলে এই মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয়। এই মন্দিরের প্রাঙ্গণে একটি আবক্ষ স্মারক ভাস্কর্য রয়েছে তাঁর। সেই ভাস্কর্য দেখে দুজনেই আনন্দিত হলেন। ছবি তুলে দিলাম।

এখান থেকে বেরিয়ে বিবেলবেলা গেলাম চিয়োওদা-ওয়ার্ডে অবস্থিত কুদানশিতা শহরের বিখ্যাত ইয়াসুকুনি জিনজা মন্দিরে। এটা শিন্তোও ধর্মের মন্দির। আবার যুদ্ধমন্দিরও বলা হয়। প্রাচীনকাল থেকে এই পর্যন্ত দেশবিদেশে যুদ্ধে যত জাপানি এবং প্রাণী নিহত হয়েছে তাঁদের আত্মাকে এই মন্দিরে সমাহিত করা আছে। এখানে রয়েছে যুদ্ধবিষয়ক একটি অসাধারণ জাদুঘর। মন্দিরের পরিবেশ দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন দুজনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা কথা জেনে নিচ্ছিলেন জামানভাই ও ভাবী। তাঁরা শুনে আশ্চর্য হলেন যে, একজন বিশ্বতোলপাড়করা বাঙালির স্মৃতিফলক রয়েছে এখানে! আমি বললাম, ‘তিনি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার সলিমপুর গ্রামে জন্ম এবং কলকাতায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বিচারপতি ড.রাধাবিনোদ পাল। ১৯৪৬-৪৮ সাল পর্যন্ত যে টোকিও আন্তর্জাতিক মিলিটিারি ট্রাইব্যুনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার ১১ জন বিচারকের অন্যতম ছিলেন তিনি, ভারতীয় বিচারপতি হিসেবে মিত্রশক্তি কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর হাজার পৃষ্ঠারও অধিক রায়ে জাপানকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। এটা বিশ্বব্যাপী অনলের মতো ছড়িয়ে যায় তখন। এখন বিশ্বইতিহাস। অনেক দেশের ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর এই ঐতিহাসিক রায়। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনের নেতাও ছিলেন। ১৯৫২ সালে হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বশান্তি সম্মেলনে তিনি সভাপতি ছিলেন। অনেক ইতিহাস আছে তাঁকে নিয়ে জাপানে।’ দুজনে আমার বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনলেন মনে হল। সেই স্মৃতিফলকের সামনে তাঁদের স্মারকছবি তুলে দিলাম।



গ্রীষ্মের বিকেল কিছুটা দীর্ঘ। তাই সেখান থেকে মেট্রোতে করে গেলাম উয়েনো উদ্যানে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন। উদ্যানে অবস্থিত প্রাচীন কানয়েইজি বৌদ্ধমন্দিরে বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন। সারা জাপান থেকে প্রায় ৩০০ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওওকুবো শিগেনোবু, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যসহ। তাছাড়া টোকিওতে এসে যে বাড়িতে প্রথম দশদিন ছিলেন সেখানেও নিয়ে গেলাম। উদ্যানের পাশেই শিনোবাজুইকে নামক স্থানে। জাপানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের দ্বিতল বাসভবন ছিল সেটা তখন। এই শিল্পী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ১৯০৩ সালে কলকাতায় পরিচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাঠের বাসভবনটি পুড়ে যায়। পরে সংস্কার করে তাইকান স্মৃতিজাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সেদিন বন্ধ ছিল জাদুঘরটি। তবু ফটকের সামনে তাঁদের ছবি তুলে দিলাম।

দেখলাম জামানভাই খুব উত্তেজিত বললেন, ‘প্রবীর কী বলব! তুমি এইসব মূল্যবান ইতিহাস না বললে কিছুই জানতাম না। কৌতূহল বেড়ে গেল। জানোই তো ইতিহাসের প্রতি আমি দুর্বল।’ আমি বললাম, ‘এইসব ইতিহাস আমি লিখে চলেছি। আপনাকে আমার বই দিলাম না সকালে সেখানে পাবেন।’

তিনি বললেন, ‘তুমি বিজয়ী ভাই। আমার অচল শরীরকে তুমি সচল করে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছ। ভাবতে পারছি না। কী দেখলাম, কী জানলাম জাপান যে এক বিস্ময় তুমি প্রায়শ বলো আসলেই তাই। সারাটা জাপান তো বাকিই রয়ে গেল।’

ভাবী দেখলাম খুবই খুশি হয়েছেন এই ভ্রমণে। উদ্যানটি চমৎকার বলেই তাঁর আরও ভালো লেগেছে বুঝলাম। পদ্মফোটা পুকুরের পাড়ে তাঁর ছবি তুললাম। বললেন, ‘প্রবীর তুমি যা দেখিয়েছ ভাই চিরদিন মনে থাকবে। তুমি না থাকলে টোকিওর এসব দেখা হত না।’

ইচ্ছে ছিল আরও দুএকটি জায়গায় নিয়ে যেতে হল না। সন্ধে হয়ে গেল। পাশেই আকিহাবারা। জিরিয়ে জিরিয়ে আমার বন্ধু সানাউলের অফিসে এলাম। আগেই বলা হয়েছিল। ঢাকার তরুণ সাংবাদিক সাইফ বরকতউল্লাহও জানিয়েছিল। সাইফের সঙ্গে জামান ভাইয়ের খুব খাতির। সানাউল হক টেলিকমিউনিকেন্স এর ব্যবসা করে। সে মাসিক ‘দশদিক’ নামে একটি চমৎকার কালার ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করে। আমি এটাতে তখন নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলাম। এখানে আমরা বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। খাওয়াদাওয়া হল। খুব আনন্দ করলাম। তারপর তাঁদের দুজনকে সাইতামার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম।

তারপর জামানভাই বাংলাদেশে ফেরার আগে দুজনকে বাংলাদেশ সাংবাদিক-লেখক ফোরাম এক সংবর্ধনা দিল সেখানে আমিও ছিলাম। বাংলাদেশে ফিরে গেলে প্রায়শ ইমেইলে যোগাযোগ হয়েছে। আমিও ফোন করেছি। দশদিক কাগজের প্রতিবেদক সাইফ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার না লেখা এনেছিল সেটা প্রকাশ করেছি। ভাবী একটা পুরস্কার পেলেন তার সংবাদও যতœ করে দশদিকে তুলে ধরেছি। তিনি একটি বই অনুবাদ করছেন বললেন। ফুকুওকাস্থ নাকামুরা গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মারি কাইগো রচিত একটি ইংরেজি বই: ঞযব শববঢ়বৎ ড়ভ ঃযব ভষধসব : ধ ংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ধঃড়সরপ নড়সন রহ ঐরৎড়ংযরসধ (২০০৮), বেশ আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই। ২০১০ সালে একুশের বইমেলাতে বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলে পরে এক কপি পাঠালেন। আমি দশদিকে আলোচনা করে দিলাম। আর এই বিষয়েই জাপানের সবচে প্রচারবহুল দৈনিক য়োমিউরিশিম্বুন সংবাদপত্রে তাঁর একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে থাকতেই। আমি তাঁর অনুরোধে জাপানি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। ওদিকে ভাবী দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় জাপান ভ্রমণ নিয়ে একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছিলেন আমার কথাও তিনি লিখেছেন। বুঝতে পারলাম যে, টোকিও ভ্রমণ তাঁর মনে খুব গভীর ছাপ ফেলেছিল। জামানভাই সেটা স্ক্যান করে ইমেইলযোগে পাঠালেন। আমি পড়ে ভাবীকে ধন্যবাদ জানালাম।

এরপর আমেরিকায় চলে গেলেন তাঁরা বড়মেয়ের কাছে। কিন্তু এক বছরের বেশি থাকতে পারলেন না। প্রচন্ড শীতে কাবু হয়ে গেছিলেন বললেন একদিন ফোনে। এরমধ্যে ২০১১ জাপানে স্মরণকালের মধ্যে ঘটেনি এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং তৎজনিত কারণে মহাগ্রাসী ৎসুনামি বা জলোচ্ছ্বাস হল। তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ফোন করেছিলেন। তাঁর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। আমি ফোন করে তাদের নিরাপদ সংবাদ জানালে পরে তিনি স্বস্তিবোধ করলেন। তিনি বললেন, ‘প্রবীর তুমি থাকাতে কী উপকার যে হয়েছে ভাই কী বলব! তুমি এত কর্মঠ এবং ক্ষিপ্র এমন কাউকে আমি আর দেখিনি। তোমাকে ঈশ্বর বড় যতœ করে সৃষ্টি করেছেন তোমার জন্য নয় মানুষের জন্য।’ এই কথায় আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলাম। পরে হেসে বললাম, ‘কী যে বলেন জামানভাই। এতটুকু যদি মানুষের জন্য করতে না পারি তাহলে আর মানুষ হলাম কেন।’

তিনি চড়াগলায় বললেন, ‘আরে এইটুকুই তো করে দেবার মতো লোক এখন নেই প্রবীর। বাংলাদেশের কী জঘন্য অবস্থা দেখছ তো। ওখানে মানুষ আর মানুষ নেই।’

আমি বললাম, ‘তবু নিজের দেশেই ফিরতে হবে জামানভাই।’

জামানভাই ফিরেছিলেন দেশে। আমিও ফিরেছিলাম কলকাতা হয়ে দেশে। বলছিলেন তাঁর একটি লেপটপ দরকার নতুন দরকার নেই পুরনো হলেও চলবে। আমি একটি সোনি ভায়ো ছোট লেপটপ সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম। তাঁর আত্মীয় একটি ছেলে তাঁদের কেয়ার টেকার বলা যায় খুব বুদ্ধিমান সে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে দেখিয়ে দিয়েছিল। উত্তরায় তাঁর বাসায় একাধিকবার গিয়েছি। আমার ছোট বোন থাকে তাঁর সেক্টরের কাছেই তাকেও একদিন নিয়ে গিয়েছিলাম। কী যে খুশি হয়েছেন দুজনে ভালোলাগায় আমার দুচোখ এখনো ভিজে আছে। জামানভাই যেমন তেমনি দিলারা জামান দুজনেই ছিলেন পরস্পরের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত এবং অমায়িক। মানবিক সকল গুণ তাঁদের মধ্যে সদা পরিস্ফূট ছিল। জামানভাই নিভৃতচারী ছিলেন। ঢাকার অনেক বুদ্ধিজীবী বা লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে দুভাগে বিভক্ত এক পক্ষ মনে করতেন তিনি বিএনপির লোকÑÑÑআমাদের লোক নয়। কিন্তু আমি সেরকম কোনো লক্ষণ বা চিন্তা ফখরুজ্জামান চৌধুরীর মধ্যে দেখতে পাইনি। তথাপি ব্যক্তিগত ব্যাপার এটা। মুক্তিযুদ্ধের লোকেরাইবা কী করে ফেলেছেন!

এরমধ্যে তিনি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন সে খবর পাচ্ছিলাম। ছোটভাই আহমেদ জামান চৌধুরী সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারালে তাঁর দৈহিক-মানসিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ে চলে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে দেখতে গিয়েছিলাম। নাকে অক্সিজেনের যন্ত্র। স্কাইপে কানাডায় থাকে তানিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘ও প্রবীর। তুমি আসছ ভাই।’

এরপর আর দেখা হয়নি আমিও খুব ব্যস্ত ছিলাম। তারপর তো জাপানেই চলে এলাম। আমার দীর্ঘ জীবনপথের আরেকটি ফলকস্তম্ভ মুছে গেল যেখানে আমি মাঝে মাঝে থামতাম।


লেখক : জাপান প্রবাসী।


(ওএস/অ/জুলাই ০৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test