E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বাস্থ্যসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে জনঅংশগ্রহণ ও কমিউনিটি স্কোরকার্ড 

২০১৮ জুলাই ২১ ১৫:২০:৫৬
স্বাস্থ্যসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে জনঅংশগ্রহণ ও কমিউনিটি স্কোরকার্ড 

অমিত বণিক


রাষ্ট্রের প্রতিটি সেবা খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে নাগরিকদের কার্যকারী ভূমিকাই প্রধান বলে মনে করি। রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রাপ্য বিভিন্ন সেবা প্রদান করবে এটা সাংবিধানিক দায়িত্ব । সরকারী সকল সেবা পাওয়া নাগরিকদের অধিকার । কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নাগরিকগণ তাদের প্র্প্যা অধিকার সঠিক ভাবে পাচ্ছে না । যারা সেবা প্রদানের দায়িত্ব থাকেন তাদের বেশীর ভাগই কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত । সেবা খাত সমূহের এ দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নাগরিক এবং নাগরিক সমাজের যথেষ্ট ভুমিকা রয়েছে ।

যে সকল প্রতিষ্ঠান সেবা প্রদান করে সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার মাধ্যমে সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং সেবাদাতা ও গ্রহিতার মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে কাজ করা যেতে পারে। তেমনি একটি কার্যকর ও বাস্তবধর্মী উপায় হলো কমিউনিটি স্কোরকার্ড পদ্ধতি। কমিউনিটি স্কোরকার্ড পদ্ধতি এমন একটি কার্যকর ও আশাব্যাঞ্জক পদ্ধতি যার মাধ্যমে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবার মূল্যায়ন, পরিকল্পনা, নিরীক্ষণ এবং স্ব্চ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটি চলমান অংশগ্রহণকারী প্রক্রিয়া ।

সেবা মূল্যায়নে এটি ব্যবহার করা সহজ এবং সে সকল সেবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে, যেখানে একটি সেবা প্রদানের দৃশ্যকল্প আছে। কমিউনিটি স্কোরকার্ড স্থানীয় পর্যায়কে প্রাধান্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তুলনামূলক কম সময়ে সভা আয়োজনের মাধ্যমে জনগণ, সেবা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এবং সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে স্কোরকার্ডের ফলাফল নিয়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে। এটি শুধুমাত্র একমুখি প্রক্রিয়া নয় বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং কার্যকর সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকার ও জনগনের মাঝে নিবিড় ও আস্থার সম্পর্ক তৈরি করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিকগণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে অনিয়ম ও দুর্নীতি হ্রাস করার জন্য ভূমিকা রাখতে পারে ।

নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে স্থানীয় সেবা প্রতিষ্ঠান সমূহ যেমন- প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্যখাত, শিক্ষাখাত, ভুমিখাত ইত্যাদিতে প্রয়োগ করা উচিত । বিশেষ করে স্থানীয় ভাবে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (ইউএইচএন্ডএফডাব্লিউসি) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (ইউএইচসি), ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সরকারী-বেসরকারী বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমূহে খুবই ভালো ভাবে কমিউনিটি স্কোরকার্ড পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং এশিয়ার দেশ গুলোতে কমিউনিটি স্কোরকার্ড পদ্ধতির ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমে কিছুটা সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকান দেশ গুলো এ বিষয়ে এগিযে আছে, উগান্ডা, তান্জানিয়া, ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ পদ্ধতি প্রয়োগের অভিজ্ঞতা রয়েছে ।

সরকারি সেবাখাতের নাগরিক পরিবীক্ষণের জন্য কমিউনিটি স্কোরকার্ড প্রক্রিয়া প্রগতির মূলনীতিগুলোর সাথে সম্পকিত যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে । এই মূলনীতি গুলো অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করে, অংশীদারিত্বমূলক প্রক্রিয়ায় সরকারের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি এবং পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করে । স্কোরকার্ড প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহীতারা সরকারি সেবার গুণগত মান, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার বিষয় গুলোতে মতামত দেন, যেখানে সরবরাহ ও ব্যায়ের হিসাব রাখা যায়, বরাদ্দ ও বাজেট নির্ধারণে পারফরমেন্সের একটি ভিত্তি তৈরি করা যায়, সেবার মানের পরিবীক্ষণ করা যায়, বিভিন্ন সুবিধা গুলোর মধ্যে তুলনামূলক মূল্যায়ণ করা যায়, সেবা প্রদানকারী ও সেবাগ্রহণকারীর কাছ থেকে সরাসরি মতামত নেয়া যায়, স্থানীয়ভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করে এবং এর মাধ্যমে সাধারন জনগন ক্ষমতায়িত হয় ।

বাংলাদেশেও বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমুহ কমিউনিটি স্কোরকার্ড ব্যবহার এবং এই পদ্ধতির প্রয়োগ করার জন্য ইতিমধ্যেই বিভিন্নভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে । গবেষনামূলক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) বর্তমানে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও টেকনাফ উপজেলাতে স্বাস্থ্যখাতে বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকটি সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র; কমিউনিটি ক্লিনিকে স্কোরকার্ড পদ্ধতির পরিক্ষামূলক প্রয়োগ ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছে । এতে স্থানীয় জনগনের মাঝে দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে।

সেবাদানকারীর প্রতিষ্ঠান যেমনঃ স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, স্থানীয় প্রশাসন ও উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স সমূহ যথেষ্ট সহযোগীতা মূলক মনোভাব দারুণ ভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি(আইসিডিডিআর,বি) কমিউনিটি স্কোরকার্ড বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করেছে, যেমন-কমিউনিটি ক্লিনিকের এলাকা চিহ্নিত ও বাছাইকরন, কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিচালনা কমিটি ও সাপোর্ট কমিটির (নাগরিক ফোরাম)সাথে স্কোরকার্ড নিয়ে মতবিনিময় সভা এবং এফজিডি করা, সেবাখাত বা সূচক নির্ধারণ, কমিটিগুলোর সাথে সভার মাধ্যমে উক্ত ক্লিনিকের সঙ্গে সম্পকিত অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা, স্কোরকার্ড প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্থানীয় জনগনকে সচেতন করা, স্থানীয় সেবাখাতের চাহিদা ও সরবরাহ বিশ্লেষণ, সুচক চিহ্নিতকরণ ও কমিউনিটি স্কোরকার্ড তৈরি, সেবাখাত ও স্কোরকার্ডের তথ্যের বিশ্লেষণ ও একত্রিকরণ, সেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এবং জনগনের সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে মতবিনিময়, ফলোআপ ইত্যাদি ।

চকরিয়া উপজেলায় মানিকপুর, বরইতলী ও শাহারবিল ইউনিয়ন এবং টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং ইউনিয়নে এ উক্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে । এ সকল কমিউনিটি ক্লিনিকে যেখানে কমিউনিটি স্কোরকার্ড বাস্তবায়ন হয়েছে সেখানে দৃশ্যমান উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। স্কোরকার্ডর ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া এবং চলমান প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হচ্ছে ফলে সাধারণ মানুষ আগের চেয়ে বেশী স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানছে এবং সেবাদানকারীদের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও স্থানীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় সেবাখাত সহ বেসরকারী সেবাখাত গুলোর সঠিকসেবার মান বৃদ্ধি, অনিয়ম হ্রাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং সাধারণ জনগনের ক্ষমতায়নের জন্য গবেষনামূলক কমিউনিটি স্কোরকার্ড পদ্ধতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সামাজিক নিরীক্ষণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে ।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test