E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

খোকার আদর্শ এবং শেখ হাসিনার অঙ্গীকার

২০১৯ মার্চ ১১ ১৮:০৪:১৮
খোকার আদর্শ এবং শেখ হাসিনার অঙ্গীকার

রহিম আব্দুর রহিম


১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ, ১৩২৭ বঙ্গাব্দে ২০ চৈত্র মঙ্গলবার রাত ৮ টায় পল্লী বাংলার ছায়াঢাকা নৈস্বর্গীয় টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রদুত শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর জন্মদিনটিকে বর্তমান সরকার ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। মিছিল, মিটিং মাঠে ময়দানে স্লোগান ‘শুভ শুভ শুভ দিন- বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন।’

মহান নেতার জন্মদিনই জাতীয় শিশু দিবস, রাষ্ট্রীয় ঘোষণা যথার্থ। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবন বিশ্লেষনে স্পষ্ট হয় তিঁনি ছোট থেকেই যেমন ছিলেন মুক্ত চিন্তার মানুষ, তেমনি তিনি ছিলেন উদার মনের মানবতার অগ্রনায়ক। তাঁর দেশাত্ববোধ, মানবতা, পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোদ্ধাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের অঙ্কুর রচিত হয় শৈশবেই।

পিতা-মাতার ভালোবাসা, শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় যে অঙ্কুর প্রস্ফুটিত হয়ে বিশ্ব ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক অবস্থা বিশ্লেষনে পাওয়া যায় ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবারটির দেড়শো বিঘা ধানী জমির মালিক, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবি। তাঁর পিতামহ আব্দুল হামিদ ছিলেন ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ।

শেখ মুজিবের মাতা সাহেরা বেগম ছোট থেকেই মুজিবকে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দেন। একরোখা শেখ মুজিব একদিন এক অবাক কান্ড ঘটিয়ে বসলো, সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে মাঠে ভাল ফসল হয়নি, এলাকায় প্রচন্ড অভাব গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। কারো পেটে ভাত নেই, পরনে নেই কাপড়; চারদিকে দুর্ভিক্ষ। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে এসেছেন। গ্রাম ঘুরে দেখলেন দুরাবস্থা। বাবা কর্মস্থলে, মায়ের সামনেই নিজের গোলার ধান বিলিয়ে দিলেন ক্ষুধার্থদের মাঝে। বঙ্গবন্ধু পরীক্ষিত, প্রমাণিত জন-মানুষের পরম বন্ধু,রাজনীতির মহাকবি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধু তাঁর এক বাণীতে উল্লেখ করেন, ‘আমার সবচেয়ে বড়ো শক্তি, আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড়ো দুবর্লতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি। শৈশব-কৈশোরকালের সাহসী, পরোপকারী, নেতৃত্বদানকারী, বিনয়ী ও ভদ্র স্বভাবের এই মানুষ জীবনে যা শিখেছেন, যা জেনেছেন, যা দেখেছেন, যা পেয়েছেন তার সকল কিছুই প্রকৃতি থেকে অনুসৃত; শুধুমাত্র অনুপ্রেরণাটুকু বাবা মা এবং শিক্ষক সমাজের। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিবেশে, পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সাহেরা বেগমের তত্ত্বাবধানে বাবা-মা তাঁদের আদরের সন্তান খোকার (শেখ মুজিবের) জন্য বাড়িতে ৩জন শিক্ষক রেখেছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষক মৌলভী সাহেব তাঁকে পড়াতেন আমপারা।

সাধারণ শিক্ষার জন্য পন্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী তাঁকে শিক্ষা দিতেন, বাংলা বর্ণমালা ও নামতা। কাজী আব্দুল হামিদ এঁর কাছে শিখতেন কবিতা-গল্প। বাল্যকাল থেকেই শেখ মুজিব বড় হয়েছেন স্বাধীন চিন্তা চেতনায়। শিক্ষকের আদর্শ আর গুণাবলী দ্বারা নির্মিত কিশোর মুজিব ছিলেন প্রচন্ড শিক্ষক ভক্ত। তিনি তাঁর শিক্ষকদের কাছে বহুবার শাসনে শিকার হয়েছেন, কখনও নির্যাতিত হননি ।

তিনি যা শিখেছেন, তা, দেশ ও জাতিকে দেওয়ার জন্য, নেওয়ার জন্য নয়। শিক্ষক সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয়। খেলাধুলা ও পড়ার সাথী শেখ আশরাফুল হক ওরফে আমিন মিয়া (১৯১৪-২০০৯ সূত্র) ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চাচা। তাঁরা একই সঙ্গে পড়তেন শিক্ষক সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারীর কাছে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ও মুরুব্বিদের খুবই ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারীর বাড়ি ছিল নোয়াখালীতে। তিঁনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে লজিং থাকতেন, লেখাপড়ার ব্যাপারে তিনি খুবই কঠোর ছিলেন। জিজ্ঞাসিত কোন প্রশ্নের জবাব না দিতে পারলে তিনি ছাত্রদের নানাভাবে শাস্তি দিতেন। একদিন শেখ মুজিব খুবই অসুস্থ, পড়া তৈয়ার করতে পারেনি; ফলে পাটোয়ারী স্যার কিশোর মুজিবকে খুব জোরে থাপ্পর মারেন, এতে করে মুজিব মাটিতে পরে যান। এরপরও তিনি কখনও শিক্ষকদের সাথে কোনরুপ বেয়াদবি করেনি। কিছুদিন পর পাটোয়ারী স্যার অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় তাঁর বিছানাপত্রের গাঁটটি নিজের মাথায় করে বঙ্গবন্ধু পাটগাতি পৌঁছে দিয়েছিলেন (তথ্যসূত্র: ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ভক্তি’ নিবন্ধন অনুপম হায়াৎ) ।
পৃথিবীর সকল জ্ঞানী গুণীরাই শিক্ষক কর্তৃক শাসিত হয়েছেন, তবে নির্যাতিত হন নি। সভ্যতার পরম যুগে শিক্ষক নামের মহা-মানুষদের আড়ালে আবডালে কিছু জঘন্য মানুষ দ্বারা নিষ্পাপ শিশুরা চরম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গত ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা উল্লেখ করছি। ঠাকুরগাঁও জেলা সদরের নিশ্চিন্তপুর ফয়েজে আম কওমি মাদ্রাসার বাথরুম থেকে মো: আবু বকর (১৬) নামে এক ছাত্রের পোড়া লাশ পুলিশ উদ্ধার করেছে। যে সংবাদটি দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এ ব্যাপারে আমার একটি লেখা ছিলো, ‘মাদ্রাসায় পোড়ালাশ’ শিরোনামে। আবু বকরের মৃত্যু রহস্যজনক। ৯ মার্চ-২০১৮, একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম ছিলো, ‘শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার’। শিরোনামের সারসংক্ষেপ, ঢাকার কদমতলী থানাধীন জামিয়া ইসলামিয়া দারুন এহসান মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আলাউদ্দিন, গত ১মার্চ তার প্রতিষ্ঠানের ৯ বছরের এক এতিম শিশুকে ওই মাদ্রাসার তৃতীয় তলায় অধ্যক্ষের আবাসিক কক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি এলাকায় জানা-জানি হলে মুফতিকে জনতা আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। গত ৮মার্চ-২০১৮ অন্য একটি জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম ছিলো, ‘মসজিদের ভেতর শিশুকে শিকলে বেঁধে ৩ ঘন্টা মারধর।’

শিরোনামের সারসংক্ষেপ, ঢাকা শহরের ধামরাই পৌরসভার কাগুজিয়াপাড়া মসজিদের ইমাম মো: সাইফুল ইসলাম, ওই পাড়ার ৯ বছর বয়স্ক শিশু সিয়াম মাহমুদকে মসজিদের ভেতর ঢুকিয়ে তিন ঘন্টা মারধর করেছে। শিশুটি অজ্ঞান হওয়ার পর ইমাম শিশুটির মৃত্যু হয়েছে ভেবে এলাকা ছেড়েছে। মুমূর্ষ অবস্থায় সিয়ামকে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। সিয়ামের অপরাধ সে বোতলে প্রস্বাব ভরে বন্ধুদের সাথে খেলছিলো। এই প্রস্বাব নাকি ছিঁটিয়ে ইমামের গায়ে পড়েছে। শিশু সিয়াম শিশুর কাজ করেছে। কিন্তু মসজিদের ইমাম একি করলো !

৬ মার্চ-২০১৮ জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ছিলো, ‘বাঁচল না মাদ্রাসার শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার শিশুটি।’ শিরোনামের সারসংক্ষেপ, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া মাদ্রাসায়ে ওমর (রা) হাফিজিয়া এন্ড ইসলামী কিন্ডার গার্টেন। এই প্রতিষ্ঠানের হেফজ শাখার ছাত্র তাওহিদুল ইসলাম, যার বয়স মাত্র ১০ বছর। যে ছাত্রটি বিগত ৪ বছর ধরে এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। শিশুটি পড়া মুখস্ত করতে পারেনি বলে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম ছেলেটিকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে এমন মার মেরেছে যে শিশুটির পাঁজর ও পায়ের হাড় ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। শরীরের নানা জায়গায় এলোপাথারি আঘাত করায়, সারা শরীর জখম হয়েছে। মুমূর্ষ শিশুটিকে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আনার পর সে মারা গেছে।

মৃত তাওহীদের বাবা কয়েশ মিয়া জানান, ‘গত ২০১৮খ্রি. ২৩ ফেব্র“য়ারি রাতে মাদ্রাসার শিক্ষক আমিনুল ইসলামের নির্যাতনে তাওহিদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ধর্মীয় শিক্ষার বিরোধীতা নয়, নবী করিম (সা:) সর্বপ্রথম মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন করেন যে শিক্ষা এখন অদক্ষ, অজ্ঞ, অযোগ্যদের হাতে পড়া এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম, সুযশ ধ্বংসের পথে । বর্তমান যুগের শিশুদের যারা শিক্ষা দিচ্ছেন, তারা কি শিশুদের বোঝেন, জানেন? কিংবা তাদের কি পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে হয় সে কৌশল রপ্ত করেছে। মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই কি ভূমিকা থাকবে এধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নিয়েছে? এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সভ্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকারের কোন উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে?

গত,২০১৮খ্রি. ১৩মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ১ম পাতায় দুটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে তার একটি শিরোনাম ছিলো, ‘এক বছরে ১৫১১ শিশুর মৃত্যু’ শিরোনামের সংবাদটিতে ‘মানুষের জন্য’ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়েছিল। ১২ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত, ‘শিশু পরিস্থিতি ২০১৭ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩৭৫ জন, অন্যান্য দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬৭৯জন, অপহরণের পর খুন হয়েছে ১০ জন বাল্যবিবাহের কারনে ১জন, নির্যাতনের কারনে ৭ জন এবং আত্মহত্যা করে ২০৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ২০১৭ সালে ধর্ষনের শিকার শিশুর সংখ্যা অনেক । তবে শিশু ধর্ষনের মোট ৪৫৬টি সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত, যৌন নিপীড়নের শিকার ১০১ জন। যে সরকার শিশুদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করলো, যে সরকার সাধারণ শিক্ষা থেকে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন বন্ধে কঠোর, সেই সরকারের আমলে মাদ্রাসার শিশু শিক্ষায় এ কোন জাহেলী যুগের কর্মকান্ড চলছে ?

আমাদের শিশুদের জন্য শু-খবর হলো চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া শেখ হাসিনার হাতেই মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়টি রযেছে। তিনি টানা তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শ-পথ গ্রহণ করেছেন। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন, ভাষণের শেষ পর্যায় বাংলা সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র করিতার চরণ,‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,প্রাণ-পণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।

এই বিশ্বকে, এই শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি নবজাতকের কাছে এই মোর দৃঢ় অঙ্গীকার। শিশুদের পরিবেশ সম্মত সামাজিক,পাবিবারিক,প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হয়নি, তেমনি শিক্ষা স্বাস্থ্যে, ক্রিড়া- সাংস্কতিতে শিশুদের প্রতিবন্ধকতা ব্যাপক । যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণই শিশু প্রেমিকদের একমাত্র ভরসা। বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্ম দিবস ও জাতীয় শিশু দিবসের অঙ্গীকার হোক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিজ্ঞা পুরণের চলন্ত সূচী।

লেথক : সাংবাদিক, শিক্ষক, শিশু সংগঠক।

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test