E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বীরজায়া

২০১৯ মার্চ ২১ ১৬:৪২:১৯
বীরজায়া

পি.কে সরকার


বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী চলে গেলেন ১লা মার্চ/২০১৯ রোজ বৃহস্পতিবার, না ফেরার দেশে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ও মহামান্য প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন প্রেস সচিব রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী মুজিব নগর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিন জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন। ৭১ এ শরনার্থীদের কেন্দ্র করে মুুর্শিদাবাদে এক অনভিপ্রেত সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাকে তিনি অত্যান্ত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রন তথা প্রশমিত করেছিলেন। তিনি তার সমস্ত মেধা-শ্রম উজার করে মুজিব নগর সরকার প্রদত্ত পদটির উপযুক্ততা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। 

উত্তাল ৭১, ঢাকার প্রতিটি আন্দোলন মিছিলের ঢেউ এসে আছরে পড়ছে শহরে গ্রামে গঞ্জে। ৬৯ এর গণ আন্দোলন সত্তরে নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন, মার্চের লাগাতার মিছিল স্লোগান সর্বত্রই শাহ মোঃ আবু জাফর, কবিরুল আলম মাও, নাছিরউদ্দিন মূসা, আরও অনেকের সাথে অগ্রভাগে ত্রিবেদী স্যারকে দেখেছি উর্দ্ধ বাহু যুদ্ধংদেহী মূর্তিতে। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ঈশান স্কুলে আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি যখন রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র। ১০ জানুয়ারি ৭১, ফরিদপুর সার্কিট হাউজে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর শক্ত অবস্থান। বালুর বস্তা দিয়ে তারা সুরক্ষা প্রাচির বানিয়ে বন্দুক তাক করে ঘাপটি মেরে আছে। ফরিদপুরের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, আন্দোলন মুখর ছাত্র-জনতার সিদ্ধান্ত, কিছুতেই সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেওয়া যাবে না।

রাজেন্দ্র কলেজ থেকে রাজপথ প্রকম্পিত করে যাত্রা শুরু হলো, সার্কিট হাউজের দিকে। মৃত্যু পণ ছাত্র-জনতা গগণ বিদারী স্লোগান দিয়ে এগিয়ে চললো লক্ষ্যের দিকে। নিকট বর্তী হতেই সার্কিট হাউজ খান সেনাদের গানগুলি সক্রিয় হয়ে উঠলো। সমস্ত ছাত্র-জনতাকে নিশানা করে তাদেরকে গান পয়েন্ট করলো হায়নারা। মিছিল বে-পরোয়া হয়ে উঠলো। মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে ছাত্র নেতা শাহ জাফর মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আগুয়ান হলো। অমনি মারমুখি পাক সেনারা প্রচন্ড আক্রোশে তাকে কিল ঘুষিসহ নির্মম অত্যাচারে ভু-লুণ্ঠিত করলো। তদাবস্থায় এগিয়ে এলো রবি ত্রিবেদী, অদম্য মনোবল আর দেশ-মাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করার আজলা ভরা দেশ প্রেমে সে লুণ্ঠিত পতাকা হাতে তুলে অগ্রগামি হলো। তারও নিস্তার নেই, বিপুল উৎসাহে পাকিরা বর্বরোচিত আঘাতে তাকেও ধরাশায়ী করলো। শাহ জাফর আর্তচিৎকারে সবাইকে বললো ‘ওকে ধরো, নইলে ওকে একে বারে মেরে ফেলবে’। তারপর ভিমরুলের মত ছাত্র-জনতার একান্ত প্রচেষ্টায় রবি ত্রিবেদী সে যাত্রায় রক্ষা পান। অত্যান্ত দ্রুততায় নিরাপদ অবস্থানে সেদিন চলে যাবার প্রাক্কালে তিনি কাটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে রক্তাক্ত হন।

সবার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেও ত্রিবেদী স্যারের একটি স্বকীয়তা কেন জানি ভিন্নতার মাপকাঠিতে আমার মনোসংযোগ করতো। ৫́-৭˝ লম্বা, বুক চিতিয়ে হাঁটা উন্নত নাসা, আয়ত দুটি প্রজ্ঞাময় চোখ, চওড়া কপাল, লম্বাটে ভরাট মুখ এ সবই কোথায় জানি সবার সাথে তাকে একটা পার্থক্য রেখা টেনে দিত। বঙ্গবন্ধুর খুব স্নেহ ভাজন ছিলেন রবি ত্রিবেদী আর একে এম ওবায়দুর রহমান। স্বাধীনতা লাভের পর স্ব-স্নেহে তিনি বলেছিলেন; রবি, তুই লেখা লেখি আর সাহিত্য চর্চা করবি। ওবায়দুর, তুই রাজনীতি করবি।
৭৫ এ জাতীর কলংক অধ্যায়ের পরে ত্রিবেদী স্যার তখন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের প্রেস সচিব। আমি স্যারের সঙ্গে গাড়ীতে যাচ্ছি প্রেসিডেন্ট ভবনে। আমাকে তালগাছ সদৃশ্য- সম্ভবত পাম গাছ, দেখিয়ে বললেন- জানো পি.কে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাকে এই গাছের সাথে বাঁধা হয়েছিল মৃত্যুদন্ড কার্যকরের জন্য। ভাগ্য প্রসন্ন এই দৃশ্য ওবায়দুর ভাইয়ের দৃষ্টি গোচর হয়, তিনি ক্যাপ্টেনকে আদেশ দিয়েছিলেন আমাকে মুক্ত করে দিতে। তাই সে যাত্রা রক্ষা পেলাম।

কিন্তু এবার.................? ত্রিবেদী স্যার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক অনেক বই লিখেছেন। তারমধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য দিনপঞ্জী ভিত্তিক ৭১ এর ১০ মাস, ৮৭৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত এই পুস্তকটি কি গভীর অভিনিবেশ দিয়ে তিনি রচনা করেছেন এর তুলনা হয় না। আরেকটি Murder Mayhem and Politics In Bangladeshএটি ৮৬৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত এক আন্তর্জাতিক মানের দীপ্ত রচনা, তিনি সাধারনের বোধযোগ্য করে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা রচনা করেছেন। মানবাধিকার সংস্থাসহ বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। অদ্ভুত এক স্মৃতিধর পুরুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী। কবে সেই ১৯৭২ সনে বলেছিলাম জগৎ বন্ধু সুন্দরের আঙ্গিনায় বেদীর সামনে আত্ম অনুশোচনায় ৭১ এ এক পাকিস্তানি মিলিটারী ক্যাপ্টেনের আত্মহত্যার কথা, তা তিনি তার ইংরেজী প্রকাশনা পুস্তকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি রচনার এক মুখবন্ধে শেষ আর্তি নিবেদন করেছেন, ‘কামনা করি, আমার দেহ যেন এই দেশের মাটির শেষ স্পর্শে ধন্য হয়’।

মূলতঃ এঁদের পূর্ব পুরুষেরা ভারতের উত্তর প্রদেশের নাগরিক ছিল। স্যারের জন্ম পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদে। পূর্ব পুরুষের উপাধি ছিল তেওয়ারী। এর মধ্যে স্বনাম ধন্য ছিলেন নারায়ন দত্ত তেওয়ারী। তারপর কালক্রমে তিনটি বেদের জ্ঞানলব্ধতায় উপাধি প্রাপ্ত হয়, ত্রিবেদী। অনেকবার স্যারের ঢাকা ২৫ জয়চন্দ্র ঘোষ লেনের বাসায় গিয়েছি। তিনি আমার জীবন যন্ত্রনার কষ্ট সব জানতেন। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই মাথায় হাত রেখে বলতেন ‘রাত যত গভীর কাল হোক, ভোর একদিন হবেই। তুমি লেখালেখি চালিয়ে যাও, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।’ এযেন ঠিক খনার বচনের মত।

বারংবার ছুটে যেতাম যখন অনুভবে ‘মন পাখিতোর ভাবনা কিরে গুরুর কাছে খবর নেনা’ ভাবতাম। তারপর এই লভিনু সঙ্গতব সুন্দর হে, সুন্দর অভিলাসে স্যারের সান্নিধ্য সুখ অনুভব করতাম। আমি ঈশ্বর দেখিনি, অজ্ঞেয় ঈশ্বর কি তাও জানি না, তাকে পাবার আগ্রহ বা সাধনা আমার নেই। তবে দুজনের মাঝে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্বের ছায়াপাত দেখেছি (১) ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙ্গালির মুক্তির ঈশ্বর, এক মঞ্চে এক বক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। (২) শিক্ষা গুরু রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীকে। এমনিতেই রবী নামে আমার ভীষন এলার্জি। তালমা ত্রিবেদী নিকেতনে গিয়ে তার শবদেহের কোথাও স্যারের জ্ঞান প্রজ্ঞা শৌর্যের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। সবটুকু দিয়ে নির্যাসটুকু নিয়ে চলেগেছেন তিনি সাধনচিত ধামে। আর এক রবী ঠাকুর তার কিরণ প্রকাশে শিল্প সাহিত্যের সবটুকু ঠাঁই আলোয় ভরিয়ে দিয়ে গেছেন অতি কৃপনের মতো। আমাদের দীপ নেভা গৃহকোনে মোমের আলোটুকু জ্বালাবার জোটি নেই। সেই যে, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী আমারই সোনার ধানে গিয়েছে সে ভরি। এমন তরো তার সদম্ভ ঘোষনা !

২ মার্চ/১৯, শুক্রবার। স্যার শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায় তালমা ত্রিবেদী নিকেতনে। বা দিকে মুখ ফিরিযে যেন সংসার বিমুখতা আর মায়ার বন্ধন ছিন্ন করার প্রচন্ড অভিমানের অভিব্যক্তিতে। উত্তর প্রদেশের আর্যপুত্রের বংশধরেরা এই অনার্যের বঙ্গদেশে তার শেষ শয়ানের আকিঞ্চন ব্যক্ত করেছেন, মা-বাবার সমাধির পাশে। যারা স্যারকে অনাদি থেকে আদিতে অব্যক্ত লোক থেকে ব্যক্ত লোকে এই পৃথিবীতে এনেছেন, তিনি রচনা করেছেন একটি জাতির শ্রেষ্ট অর্জনের ইতিহাস। সমৃদ্ধ করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রত্নভান্ডার।

এ পৃথিবীতে কচ্ছপ, শকুন অনেক দীর্ঘায়ু নিয়ে বেঁচে থাকে কিন্তু তাদের মল মূত্র ছাড়া পৃথিবীকে আর কিছু দেবার তৌফিক নেই। পৃথিবীতে প্রতিদিন লক্ষ জন্মায়, লক্ষজন মৃত্যু বরণ করে। তার মধ্যে যারা পৃথিবীতে এসে একটা দাগ কেটে যায় তারা গাঁথা থাকে আমাদের অনুভবে। এমতরো মানুষ এই বাংলায় যতবার জন্মাবে ততো আমাদের দেশে শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত উৎকর্ষ লাভ করবে।

এখন দেশে দারুন খরা, আজলা ভরা কষ্ট নিয়ে আনন্দটুকু যারা দিয়ে যায় তাদের বড় অভাব। মানুষের বাঁচা মরা মঙ্গল ভাবার মানুষগুলি দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত সংস্থা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বাংলাদেশ, ৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচার সহায়ক বিবেচনায় স্যারের ৭১ এর ১০ মাস রচনাটি সংগ্রহ করেছে। বঙ্গবন্ধু ৭১ এর রক্ত ঋণ পরিশোধ করেগেছেন ৭৫ এ আত্মদানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অধ্যক্ষ বঙ্গবন্ধু শিলান্যাস করে গেছেন ২৬ মার্চ অনাগত রুদ্র ভবিষ্যতকে বরণ করে আর মুক্তিসেনা কারিগর রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্য রচনা করে দায়বদ্ধ স্বাধীনতাকে ঐশ্বর্য্য মন্ডিত করেছেন। জাতী সত্ত্বাকে করেছেন শ্রীবৃদ্ধি।

পুলিশ এলো। বিগিউলে অন্তিম সুর বেজে উঠে। টিএনও, পুলিশ কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা জনতা শেষ অভিবাদন জানালো ত্রিবেদী স্যারকে। এক পাশে দাঁড়িয়ে স্যারের একমাত্র মূকপ্রতিবন্ধী পুত্র রথিন্দ্রনাথ অবাক্ বিস্ময়ে তাকিয়ে পিতার নিস্প্রাণ দেহ পানে। ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বউদি (স্যারের স্ত্রী) সুব্রতা দেবী। এখনো তার সীমন্তে সিঁদুর রেখা। কপালে রক্তিম সিঁদুর বিন্দু। এরপর শুরু হবে বউদির দাম্পত্য জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যের অবতারনা। তার সিঁদুর মুছে ফেলা হবে।

তবে তাই হোক। তারপরও বউদি তাকিয়ে থাকবে লাল সবুজ পতাকায় ঢাকা স্বামীর মুখের দিকে। যে পতাকার জন্য তার জীবন সঙ্গী সমস্ত মেধা শ্রম উজার করে দিয়েছিল ৭১ এ ও পরবর্তীতে। যতদিন এই পতাকা তিনি দেখবেন, তার সীমন্তের সিঁদুর বিন্দু ততদিনে বেঁচে থাকবে আপন ভূবনের অনুভবে স্পর্ধিত অহংকারে। তিনি যে বীরজায়া।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, ই-মেইল : [email protected]

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test