E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একটি নিউজ এবং একজন সুজাতা চৌধুরী 

২০২০ এপ্রিল ১৪ ১৩:৩৭:০৬
একটি নিউজ এবং একজন সুজাতা চৌধুরী 

শিতাংশু গুহ


প্রথম আলো ডট কম নিউইয়র্কের বাংলাদেশীদের করোনা পরিস্থিতির ওপর একটি হৃদয়স্পর্শী রিপোর্ট করেছে রোববার ১২ এপ্রিল। ‘যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আরও ১০ বাংলাদেশির মৃত্যু’ শীর্ষক এই রিপোর্টটি যৌথভাবে করেছেন ইব্রাহিম চৌধুরী  এবং শাহ আহম্দ। রিপোর্টের একটি অংশে তাঁরা একটি মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, যা পুরো নিউইয়র্কে আলোচনার বিষয় হয়ে গেছে। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি এই পরিবারটিকে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসতে চাচ্ছেন। আরো ক’টি মিডিয়া, এই রিপোর্টের ভিত্তিতে একই রিপোর্ট করেছেন। ফেইসবুক ছেঁয়ে গেছে এই নিউজে। কিন্তু কোথায় সেই পরিবার? প্রথম আলোর সেই রিপোর্টের অংশটুকু এখানে হুবহু দেয়া হলো:  

“ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে স্বামী রতন চৌধুরী ও স্ত্রী সুজাতা চৌধুরী সন্তানসহ এসেছিলেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। স্বামী-স্ত্রী কাজ করেন, দুই সন্তান স্কুলে যায়। করোনার বিপদসংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী ছুটি নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন। সন্তানরাও বাড়িতে। সুজাতা চৌধুরী নিজের অজান্তেই ভাইরাস বাড়ি এলেন কর্মস্থল থেকে। স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দুই সন্তানও আক্রান্ত হলো ভাইরাসে। হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ায় বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। ডাক্তারের নির্দেশনায় তিন বেডরুমের বাড়িতে স্বামী-সন্তানদের আলাদা রুমগুলো ছেড়ে দিয়ে সুজাতা নিজে জায়গা করে নিলেন ড্রইং রুমে। মধ্যরাতে রুমে রুমে গিয়ে চেক করেন, কে কেমন আছে।

১১ এপ্রিল ভোরে স্বামীর রুমে ওষুধ দেওয়ার জন্য ঢুকে কোনো সাড়া পেলেন না স্ত্রী। যা বোঝার বুঝে নিলেন তিনি। বাইরে থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানদের ডেকে তুললেন। সন্তানদের বললেন সবকিছু। সুজাতা নিজেই ৯১১ নম্বরে কল করলেন। উত্তর পেলেন তাদের আসতে দেরি হবে। সারা দিন তিনজন অসুস্থ মানুষ বসে রইলেন তাঁদের অতি প্রিয়জনের মৃতদেহ নিয়ে। বিকেল চারটায় তিনজন স্যোসাল ওয়ার্কার এলেন। সঙ্গে এল না মর্গের গাড়ি বা কোনো সরঞ্জাম। তাঁরা জানালেন, তাঁদের অসহায়ত্বের কথা। সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। মর্গ বা অস্থায়ী ট্রেলারের মর্গে আছে জায়গার অভাব। কিছু মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়ার পর মর্গ কিছুটা খালি হলে তাঁরা নিয়ে যাবে মৃতদেহ।

প্লাস্টিকের ডাবল বডি ব্যাগে রতন চৌধুরীর দেহ ভরা হলো। স্ট্রেচারে বেঁধে স্প্রে করে রুমেই রেখে বন্ধ দরজায় 'নো এন্ট্রি' সাইন ঝুলিয়ে চলে গেলেন তিনি স্যোসাল ওয়ার্কার। এক রুমে প্রিয় স্বামীর মৃতদেহ, আর অন্য রুমে একই রোগে আক্রান্ত তিনজন মানুষ বসে আছেন”।

এই হৃদয় বিদারক ঘটনার পর যেকোন মানুষ ভারাক্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। এটি পড়ে অনেকে রাতে রাতে ঘুমাতে পারেননি। অনেকে অস্থিরতায় ভুগেছেন। রবিবার দুপুরে ভক্তসংঘ মন্দিরের সুশীল সাহা কল দিলেন। তারপর হিন্দু কোয়ালিশনের দীনেশ মজুমদার এবং কথা হলো হরিমন্দিরের সুশীল সিনহা’র সাথে। এঁরা তিনজন নিউইয়র্কের হিন্দু কমিনিটির খবর রাখেন। তাঁরা কেউ রতন-সুজাতা চৌধুরীকে চেনেন না? নিউজ অনুসারে তিনি এষ্টোরিয়ার বাসিন্দা। খোঁজ শুরু হলো, এষ্টোরিয়া কে থাকেন? সুকান্ত দাস টুটুল। ওকে কল দিলাম, জানালেন, তিনি চেনন না? বললাম, খোঁজ নেন এবং জানান। কয়েক ঘন্টা পরে জানালেন, বেশ কয়েক জনের সাথে কথা হয়েছে, কেউ জানেন না। এরমধ্যে খবর পেলাম ওরা ৩০ এভিনিউতে থাকেন এবং সুজাতা চৌধুরী সেখানকার একটি ডানকিন ডোনাডে কাজ করতেন। কল দিলাম বেশ ক’টি ডানকিন ডোনাডের মালিক চন্দন সেনগুপ্তকে। চন্দন জানালেন, তাঁর কোন দোকান ওখানে নেই, এবং হয়তো শুক্লার দোকানে হতে পারে। তিনি সুনন্দ মজুমদার নামে শুক্লার একজন ম্যানেজারের নম্বর দিলেন, কথা বললাম। কাজ হলোনা।

এরমধ্যে বাপ্পা সোম নামে একজন ফেইসবুকে জানালেন, তিনি দীর্ঘদিন এষ্টোরিয়া থাকেন, রতন বা সুজাতা চৌধুরী নামে কাউকে কখনো তিনি জানেন না? ব্রঙ্কসের পল্ল্ব সরকার জানালেন, নিউজটি সত্য নয়? একটি গ্রূপে এ নিয়ে আলোচনায় দেখলাম, তারা এনিয়ে উৎকণ্ঠা ও শোকাভিভূত। তাদের বললাম, খবরটি’র সত্যতা এখনো মেলেনি। একজন জানালেন, খবরটি সত্য, স্বাস্থ্য বিভাগ কনফার্ম করেছে। তাকে কল দিলাম, আমাদের মাধবী চক্রবর্তী। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কোথায় শুনেছেন? বললেন, তার স্বামী রণেশ চক্রবর্তী ‘ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ’ এ কাজ করেন। তার দুই সহকর্মী শাহিদা ইসলাম ও তৃপ্তি চক্রবতী তাঁকে কনফার্ম করেছেন। তৃপ্তি চক্রবর্তীর ফোন নাম্বার পেলাম, কল দিলাম। খুশি হলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি মাধবীদের কনফার্ম করেছেন? তিনি বললেন, প্রথম আলোতে খবরটা পড়ে খুব খারাপ লেগেছে, তাই ওদের সাথে শেয়ার করেছি। এছাড়া আর কিছু জানিনা। এরমধ্যে পূজা সমিতির শিবব্রত চৌধুরী বাবুলকে কল দিলাম, তিনি নাকি অনেক খবর রাখেন। বাবুল জানালেন, তিনিও প্রথম আলো থেকে জেনেছেন, ইব্রাহিম চৌধুরী’র সাথে তিনি ফেইসবুকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন।

এরমধ্যে কল দিলাম ঠিকানার ফজলুর রহমানকে। এই নিউজে তিনি মর্মাহত। বললাম, সুজাতা চৌধুরীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তিনি বললেন, ইব্রাহীম চৌধুরী দায়িত্বশীল মানুষ, তাঁর সাথে কথা বলুন। ইব্রাহিম চৌধুরীকে আমি চিনি। তিনিও আমায় চেনেন। তিনি ভালো রিপোর্টার, তার ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিলোনা। কল দিলাম মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা, প্রথম আলোর হাসান ফেরদৌস এবং তোফাজ্জ্বল লিটনকে। তাদের কাছ থেকে নাম্বার পেয়ে কল দিলাম ইব্রাহীম চৌধুরীকে। পেলাম না, হাসান ফেরদৌসের পরামর্শে টেক্সট করলাম, সাথে ভয়েস মেইল। ইব্রাহিম চৌধুরী টেক্সট করলেন, দাদা, আধাঘন্টা পরে কল দিচ্ছি। কল দিলেন, কথা হলো। সজ্জ্বন, ভদ্রলোক ইব্রাহীম চৌধুরী জানালেন, তাঁকে এই সংবাদটি দিয়েছেন, এষ্টোরিয়ার মোহাম্মদ জাভেদ উদ্দিন। বুঝলাম, তিনিও ইতিমধ্যে অনেক মেসেজ পেয়েছেন, নিউজটি সঠিক কিনা তা যাচাইয়ের। ইব্রাহিম চৌধুরী আমায় বললেন, ‘দাদা, যদি সত্যতা না পাই, তাহলে ‘ভুল সংশোধনী’ দেবো। বললাম, সেটাই যথার্থ হবে।

কল দিলাম জাভেদ উদ্দিনকে। তিনি জানালেন, তিনি ইব্রাহীম চৌধুরীকে খবরটি দিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কোথায় পেলেন, আপনি কি রতন/ সুজাতা চৌধুরীকে চেনেন? জাভেদউদ্দিন জানালেন, তার পরিচিত কিছু বয়স্ক হিন্দু বন্ধু এবং একজন রহমান ভাই তাঁকে বিস্তারিত খবরটি দিয়েছেন। রহমান ভাই এমটিএ-তে চাকুরী করেন। জাভেদউদ্দিন আরো জানালেন, রতন চৌধুরী এমটিএ-তে কাজ করতেন এবং বাড়ি নরসিংদী। কল দিলাম নরসিংদীর প্রদীপ মালাকারকে, তিনি চেনন না? এমটিএ’র বিধান পাল জানালেন, তিনি রতন চৌধুরীকে চেনেন না? রহমান সাহেবকে কল দিলাম। এমটিএ’র কর্মকর্তা আহমেদুর রহমান জানালেন, তিনি সবকিছু পেয়েছেন ফেইসবুক থেকে; তবে সিলেটের একজন ফাহিম মুনতাকিম এটি ফেইসবুকে দিয়েছেন সেখান থেকে তিনি জানতে পেরেছেন।

রহমান আরো জানালেন, রতন এমটিএ-তে কাজ করেন না, তাই তারপক্ষে খবর সংগ্রহ অসম্ভব। ফাহিম মুত্তাকিমকে কল দিয়ে জানলাম, তিনি নিজেই দুঃখ ভারাক্রান্ত, কারণ বাংলাদেশের মিডিয়ায় যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, সেটি তাঁর এবং তাঁর পরিচিত সবাই ফোন করছেন যে, তিনি জীবিত কিনা? বললাম, আপনার ফেইসবুক পোষ্ট থেকে নিউজ হয়েছে।

তিনি বললেন, ওটা পোষ্ট করা আমার ভুল হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি পরিবারটিকে চেনেন? বললেন, ওই পরিবারের ঘনিষ্ট একজন তাকে জানিয়েছেন। বললাম, ঠিক আছে, ওই ঘনিষ্ট জনের ফোন নাম্বারটি দিন? তিনি বললেন, তাঁর সাথে আলোচনা করে তারপর দিতে পারবেন। আমি তাঁর অপেক্ষায় আছি। পাঠক, সিদ্ধান্ত আপনার। এটি পোষ্ট করার আগে আমার আবার ইব্রাহীম চৌধুরীর সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁরা রিপোর্টটি নিয়ে আরো অনুসন্ধান করছেন, তবে মনে রাখতে হবে, এই সময়ে সশরীরে গিয়ে সবকিছু রিপোর্ট করা সম্ভব নয়।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test