E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মহাপরিচালক এবং সুরক্ষা সামগ্রী!

২০২০ এপ্রিল ২৪ ২২:৫৫:০০
স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মহাপরিচালক এবং সুরক্ষা সামগ্রী!

রহিম আব্দুর রহিম


৮০ বছর বয়স্ক নজিমুদ্দিন । ভিক্ষা করে সংসার চালায়। ভিক্ষা করে জমিয়েছিল ১০ হাজার টাকা। উদ্দেশ্য থাকার জন্য একটি ঘর। করোনা ভাইরাস সংক্রমন রোধে ঘরবন্দি মানুষদের খাদ্য সহায়তার জন্য এই নজিমুদ্দিন তাঁর জমানো ১০ হাজার টাকা, উপজেলা প্রশাসনের করোনা তহবিলে জমা দেন। শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গান্ধীগাঁও গ্রামের নজিমুদ্দিনের ভিক্ষার ঝুলি থেকে যে মানবতা, শিক্ষা, দৃষ্টান্ত প্রস্ফুটিত হয়েছে; তাতে করে ত্রাণের চালচোর, ডালচোর, তেলচোরদের ওপর কোন ক্ষোভ সাধারণের আর সম্ভবত নেই। বরং গর্বের সাথে সবাই বলতে পারেন, ত্রাণচোরের আড়ালে ‘ভিক্ষুক দাতা’ও বাংলাদেশে রয়েছেন! মজুদদার, মুনাফাখোর, ত্রাণচোরদের অট্টালিকার চেয়ে ভিক্ষুকের ঝুলি অনেক পবিত্র।

ত্রাণচোরদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান কঠোর অবস্থানে, অন্যদিকে নবাগত আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ স্পষ্ট হুশিয়ারি দিয়েছেন, ত্রাণ নিয়ে কোন প্রকার নয়-ছয় মেনে নেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রশাসকদের আইন প্রয়োগে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন অনিবার্য। পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে, মূল কথায় যাচ্ছি। নিশার পান্ডে (নিশারুল হক) নামক এক এডমিন তাঁর ফেইসবুক আইডিতে উল্লেখ করেছেন,‘বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ এঁর প্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার লক্ষীচাপ ইউনিয়নের কঁচুয়া গ্রামে। তাঁর বাবা ওসমান গনি। যিনি, ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তৎকালীন নীলফামারী মহকুমার এসডিও আব্দুল মুহিত চৌধুরী, ২৪ মে ১৯৭১ এর স্বাক্ষরিত শান্তি কমিটির তালিকাটি সংশ্লিষ্ট এডমিন যুক্ত করেছেন।

যে তালিকার ৩৫ নম্বর সিরিয়ালে উল্লেখ রয়েছে-নাম: ওসমান গনি, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, লক্ষীচাপ গ্রাম,কঁচুয়া; পোস্ট: রামগঞ্জ, পদবী সদস্য, থানা ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটি-জলঢাকা, তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ জামাত-বিএনপি পন্থী চিকিৎসক সংগঠন ড্যাব এর জীবন সদস্য।’ স্টেটাসকারী এডমিনের এই পোস্টে অন্য একজন মন্তব্য করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,‘ওসমান গনির ছোটপুত্র অর্থাৎ ডাক্তার আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। অপরদিকে বর্তমান স্বাস্থ্য মন্ত্রী’র সমালোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম উল্লেখ করেছেন,‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাবা ছিলেন কর্নেল (অব) মালেক, যিনি স্বৈরাচার সরকারের আমলে ঢাকার মেয়র ছিলেন; যিনি ওই সময় ঢাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা; সে আমার ম্যাসেঞ্জারে দু’ তিন বাক্যের একটি প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন,‘আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়তো ইংরেজী মাধ্যমে পড়া-শোনা করেছেন, যার ফলে ভালো করে বাংলাও বলতে পারেন না, প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, ভালভাবে যিনি বাংলা বলতে পারেন, এই মুহুর্তে তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করুন।’ নঈম নিজামের লেখার সারসংক্ষেপের একাংশ হল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংগঠনিকভাবে অযোগ্য এবং অহঙ্কারী। এগুলো না-হয়, সমালোচকদের কথা। আসল কথায় আরও ঝামেলা। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসাপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডাক্তার মঈন উদ্দিন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ এপ্রিল মারা গেছেন।

২২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ ৪৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। সরকারি-বেসরকারি প্রায় অর্ধশতাধিক হাসপাতাল ও ইউনিট লকডাউন। তবে প্রধানমন্ত্রী হাসপাতাল লকডাউনের বিপক্ষে। আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের শূণ্যস্থান পূরনে অন্য কোন ডাক্তার রাজি হচ্ছেন না। পত্র-পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের তুলনামূলক টালি, বাংলাদেশে ১১.৫০%, ইতালি ৮.০৫%, যুক্তরাষ্ট্র ১১.০০%, চীন ৪.০০%। বাংলাদেশে আক্রান্ত বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলেছেন,“মোট ৪ টি কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে। প্রথমটি,‘মানহীন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও মাস্ক।’ দ্বিতীয়ত,‘অনেক হাসপাতালে সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছেনি।’ তৃতীয়ত,‘রোগীদের উপসর্গ লুকিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ।’ চতুর্থত,‘সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার পদ্ধতি এবং জীবানুমুক্ত করে খুলতে না পারার অভিজ্ঞতা।’ দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্রব্য মূল্যের দাম কয়েকধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। কাঁচাপন্য উৎপাদনকারী কৃষকদের শাক-সবজি রপ্তানি করা যাচ্ছে না বলে পাইকাররা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। একই সুযোগ গ্রহণ করেছেন, প্রাণ ও প্রাণির চিকিৎসকদের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহার্য সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে কী এক অদ্ভুদ যোগাযোগ করেছেন, যার ফলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, এন-৯৫ মোড়কে মোড়িয়ে মানহীন সাধারণ সামগ্রী সরবরাহ করে ১০ গুণ মূল্য গ্রহণ করেছে। পুকুর চুরি কাকে বলে! শুধু তাই নয়, সারাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার নার্সসহ মোট স্বাস্থ্যকর্মী ৮৫ হাজার; এই কর্মীদের জন্য কেন্দ্রীয় ওষুধাগার (সিএমএসডি) সারাদেশে ১১ লাখ পিপিই বিতরণের কথা বলেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য যদি সত্য হয়, তবে প্রতিজন ডাক্তার ১৩ টি করে পিপিই পাওয়ার কথা। সেখানে অনেক হাসপাতালেই পিপিই পৌঁছেনি কেনো? নানাবিধ জনপ্রতিক্রিয়ার কোপানলে থাকা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির পদত্যাগ চেয়ে তাঁর নিজস্ব ই-মেইল আইডিতে ২২ এপ্রিল নোটিশ পাঠিয়েছেন; মো. জে আর খান (রবিন) নামক সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবি।

নোটিশ প্রাপ্তির পর, যথা শিগগির সম্ভব তাঁকে পদত্যাগ করার অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায়, তাঁর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং অবিচক্ষণ কার্যকলাপের জন্য সৃষ্ট সব ধরণের ক্ষতির জন্য তিনি (ডিজি, স্বাস্থ্য) দায়ী থাববেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। নোটিশের অনুলিপি, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় সচিব, অর্থ মন্ত্রনালয় সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের স¦াস্থ্যসেবা বিভাগ বরাবর পাঠানো হয়েছে। নোটিশ প্রদানকারী আইনজীবি আরও উল্লেখ করেন, ‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এই ভাইরাস মোকাবিলা করাসহ দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে নানারকম সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’ উল্লেখ, বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ (ক), ১৮ (১) এবং ৩২ অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্য সেবার ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার, যা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অপরদিকে সাধারণ মানুষের সহজ হিসাব-নিকাশ, ‘স্বাধীনতা বিরোধী এবং স্বৈরাচার সরকারের প্রজন্মের কোন অশনি হাত এই মহামারীকে কেন্দ্র করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।’ পাড়া-গাঁয়ের হিসাব না হয় বাদই দিলাম।

দেশের এই অবস্থায় যিনি ডাক্তারদের বুঝবেন, সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারবেন, জীবন সুরক্ষা সামগ্রী (প্রাইভেট প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট) ক্রয়ে যিনি আন্তরিক থাকবেন, এমন কাউকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করার দাবী এখন সর্বত্রই। একই সাথে যে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাঁর বাহিনীদের সুরক্ষার আড়ালে অরক্ষিত করার সাথে জড়িয়েছেন, যিনি নিম্নমানের সামগ্রী সরবরাহের জন্য তার পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিলেন, তিনি মহাপরিচালক না থাকলে দেশের কোন ক্ষতিই হবে না।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব থাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সহ মোট ১৬ টি সংস্থার ২০ এপ্রিল প্রকাশিত, ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অনফুড ক্রাইসিস ২০২০’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্বে আধা পেট খাবার পায়, ক্ষুধা পেটে রাতে ঘুমায়, এমন মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালে পৃথিবীতে ছিল ১৩ কোটি ৫০ লাখ। যা কোভিড-১৯ এর জেরে ২০২০ (চলতি বছর) শেষ নাগাদ সংখ্যাটি বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হতে পারে।

এ ধরনের আশংকার কথা যেমন জানছি, তেমনি আশার সংবাদও জোরে-সোরে বইছে যে, আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন আবিস্কারক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ভ্যাক্সিন chAdox-1এবংchAdox-2 মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেছেন। আরও কয়েকটি দেশ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ভ্যাক্সিন আবিস্কারে সাফল্যের দারপ্রান্তে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে দু’ এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঝড় বৃষ্টি শুরু হতে পারে। প্রতিবছরের ন্যায় নদীর ভাঙ্গনে হয়তোবা দেশের হাজার লাখো পরিবার গৃহহীন হবে।

প্রায় ৫ কোটি মানুষের বাস উপকুল অঞ্চলের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার খবর পাওয়া যাবে। আমাদের মৌসুমী লালিত-পালিত দূর্যোগ-মহামারীর কাছে বৈশ্বিক অতিথি, মহামারী করোনা ভাইরাস সহসায় পালিয়ে যাবে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিজি মহোদয়ের উপর ভুক্তভোগী এবং বিশ্লেষকদের প্রচন্ড সন্দেহ দানা বেঁধেছে। কারো অনিয়ম, অবহেলা, অহংকার, দায়সারা গোছের সিদ্ধান্ত, লোভ-লালসা এবং দুর্নীতির রোষানলে পড়ে আমাদের সেবক চিকিৎসকরা অকাতরে যাতে মৃত্যুবরণ না করে তা নিশ্চিত করতেই বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং ডিজি মহোদয়ের উচিত, জাতিকে ‘গুডবাই’ জানানো। অমর ছন্দবাণী, ‘সন্দেহের রোগ বড় রোগ, কলিজায় হয় জ্বালা,সেই রোগের ওষুধ নাই, কেবল খোদাতা’লা।’

লেখক : শিক্ষক, নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test