E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোকষ্ট

২০২০ জুন ০৩ ১৩:১০:৪৫
মুক্তিযোদ্ধাদের মনোকষ্ট

আবীর আহাদ


অতি সূক্ষ্ম ছলেকলেকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে । দেশের গর্বিত গোষ্ঠীকে মানবেতর জীবনে ঠেলে দিয়ে দেশ উন্নত হচ্ছে বলে যতোই প্রচার করা হোক না কেন----প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের দেশটাকে অনেক পিছিয়ে দেয়া হয়েছে । এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারকে ভুলুণ্ঠিত করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও রাজাকারদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে !

পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা বিরল ঘটনা যে, রাষ্ট্রীয় আয়োজনে দেশের স্বাধীনতার সূর্যসন্তানদের ঐতিহাসিক জাতীয় মর্যাদা এবং তাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে নিষ্ঠুর পন্থায় অবমূল্যায়িত করা হয়েছে । এর প্রধান প্রমাণ, আমাদের জাতীয় সংবিধানের মূলস্তম্ভ 'প্রস্তাবনা'র কোথাও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দদ্বয় সন্নিবেসিত হয়নি । অপরদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাকে এড়িয়ে বিভিন্ন সময় নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা দিয়ে, অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়া হয়েছে ! যার ফলে সর্বসাকুল্যে দেড় লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার স্থলে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ চৌত্রিশ হাজারেরও ওপরে !

সংবিধানদৃষ্টে ভবিষ্যতে একদিন হয়তো কেউ কেউ রায় দিয়ে বসবে যে, এই দেশে কোনো 'মুক্তিযুদ্ধ' হয়নি এবং 'মুক্তিযোদ্ধা' বলতে কোনো গোষ্ঠী ছিলো না ! ইতিমধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়েছে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা ছিলো ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, পাকিস্তানীদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ, গণ্ডগোলের বছর, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাদি । অথচ ঐ যুদ্ধকে আমরা জ্ঞান করেছি "জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ" নামে । সেই আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণোৎসর্গ করেছেন । তিন লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন । এককোটি সোয়া লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন । বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একটি সর্বাত্মক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে । সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা অনুল্লেখ থাকার অর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অবমাননা ।

সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা নেই কেনো-----এ-প্রশ্ন আমি একদিন করেছিলাম প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ডক্টর কামাল হোসেনকে । ডক্টর কামাল হোসেন বললেন, ''মুক্তিসংগ্রামে'র মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ নিহিত । আমরা সেদিন সংবিধান প্রণয়ন কমিটিসহ গণপরিষদ সদস্যরা বিষয়টিকে এভাবেই ভেবে নিয়েছিলাম ।" আমি তখন ডক্টর কামাল হোসেনকে বলি, যদি মুক্তিসংগ্রামই 'মুক্তিযুদ্ধ' হয় তাহলে বাংলা ভাষার অভিধানে মুক্তিসংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলোকে একটি শব্দে মণ্ডিত করা হলো না কেনো ? এমনকি ইংরেজি ভাষায়ও এগুলো পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেমন Liberation Struggle, Independent Movement ও War of Liberation বা Liberation War----না করে যেকোনো একটি শব্দে এগুলোকে লিপিবদ্ধ করা হলো না কেনো ? তখন তিনি বলেন, সেসময় তাড়াহুড়ো করে সংবিধান রচনা করতে গিয়ে ঐভাবে হয়তো আমরা চিন্তা করিনি । তবে সংবিধান কোরানের বাণী নয় যে, তা পরিবর্তন করা যাবে না । এ পর্যন্ত জাতীয় এমনকি ব্যক্তির প্রয়োজনে সংবিধানে অনেক সংশোধনী এসেছে । তোমাদের দাবিটি সঠিক । সুতরাং এগুলো সংবিধানে লিপিবদ্ধ করতে কোনো বাধা নেই------

এধরনের জাতীয় অসঙ্গতি ও ভুল নিরসনের লক্ষ্যে আমরা একাত্তরের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করে 'মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে আন্দোলন করে আসছি । আমাদের উপর্যুপরি দাবির প্রেক্ষিতে সরকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের যে অভিযান চলছে তা মন্দের ভালোই বলতে হবে । কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদ কার্যক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, উপরন্তু ঐ গোঁজামিল সংজ্ঞায় জামুকা এখনো মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করেই চলেছে । মূলত: সর্বাগ্রে দরকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি । সাংবিধানিক স্বীকৃতির মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় জাতীয় মর্যাদার সুষ্ঠু সমাধান নিহিত । এই দাবি দু'টি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দু:খ-কষ্টের মধ্যে বসবাস করতে করতে একদা চিরতরে ধরাধামের অন্তরালে হারিয়ে যেতে হবে ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test