E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধাদের বিড়ম্বিত জীবন

২০২০ আগস্ট ২১ ১৫:০৬:০৫
মুক্তিযোদ্ধাদের বিড়ম্বিত জীবন

আবীর আহাদ


আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ঘরে ফিরে গিয়েছিলাম । আমরাও মানুষ । আমাদেরও শান্তিপূর্ণ জীবন নিয়ে এদেশে বসবাসের অধিকার ছিলো । কিন্তু আমরা আমাদের সেই অধিকার পাইনি । আমরা আমাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত । যেহেতু আমরা দেশের নির্মাতা, সেহেতু আমরা আমাদের সম্মান ও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কারো কাছে হাত পাততে পারিনি । আমরা সরলভাবে বিশ্বাস করেছি যে, আমরা রাষ্ট্রের । রাষ্ট্রই আমাদের জাতীয় মর্যাদার আলোকে আমাদের মোটামুটি উন্নত আর্থসামাজিক জীবন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেবে ।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রের ওপর এমন একটি অন্ধ আস্থা রেখে আমরা দেশের দৃশ্যপট থেকে যার যার দিগন্তে ফিরে গিয়েছিলাম । তারপর জীবন থেকে বহুটি বছর কেটে গেছে । কেটে গেছে স্নেহময় প্রভাত, বৈরাজ্ঞময় দুপুর, স্বপ্নময় রাত্রি ! আর আজ জীবনের পড়ন্ত বেলায় আমরা অনুভব করছি কী বিশুষ্ক শূন্যতায় আমরা অবগাহন করছি । আমাদের সবাই এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে । আমাদের অনেক সাথী প্রতিদিন করোনাসহ অন্যান্য জটিল রোগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন । অধিকাংশের এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই । রোগেশোকে অনেকেই বিছানায় পড়ে ছটফট করছে । চিকিত্সার অভাবে হা-পিত্যেশ করছে । এমনতর অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়ে তারা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে ! মূলত: তাদের অবদানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকার ফলে তাদের জীবনে এমনতর বিপর্যয় নেমে এসেছে । তার ওপর রয়েছে গোঁজামিল সংজ্ঞায় অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার ঘৃণ্য কার্যকলাপ । আর সে-কারণে আমি আজ কয়েক বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধাদেরসাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবি জানিয়ে আসছি । আমার বিশাল সান্ত্বনা এই যে, আমার উত্থাপিত দাবিদ্বয় আজ একটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে ।

মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতিসহ তাদের ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে বঙ্গবন্ধু প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০% কোটা প্রদান করেছিলেন । বঙ্গবন্ধুর নির্মম তিরোধানে পর থেকে অদ্যাবধি সেই কোটার বাস্তবায়ন তো ঘটেইনি, উপরন্তু সেই কোটাটি আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যে আচরণটি করেছেন তা বলার মতো নয় । অভাব ক্ষুধা দারিদ্র্য বঞ্চনা ইত্যাদি অসংগতির কারণে দেশনির্মাতা মুক্তিযোদ্ধারা যেমন স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরের জীবনে উঠে দাঁড়াতে পারেনি, তেমনি তাদের উত্তরাধিকারদের জীবনেও এমনতর অভিশাপ নেমে এসেছে । মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা চরমতম বেকারত্বের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন । এটা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পরশ্রীকাতর ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি নানান চক্রান্তের জাল বিছিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজের বুকে দাবিয়ে রেখে আসার ধারাবাহিকতায় তাদের সন্তানদের প্রতিও অনুরূপ আচরণ করে চলেছে । বিশেষ করে আওয়ামী লীগের হাতে যখন এ অবস্থার উদ্ভব ঘটে তখন দু:খ ও পরিতাপের পরিসীমা থাকে না । দেশের স্বাধীনতা আনায়নকারী গর্বিত সন্তান হিশেবে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ আর্থসামাজিক জীবন ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে তারা চরম বিড়ম্বিত জীবনযাপন করে চলেছেন ।

অথচ আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত পবিত্র দেশের মাটিতে কোথাকার কোন দরবেশ লোটাস সম্রাট খান কাজী বদি তারেক মামুন ফালু বাচ্চু মিঠু ভূঁইয়া জিকে শামিম, পাপিয়া, সাবরিনা, পাপলু, শাহেদসহ যে দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ডনরা অবাধে লুটপাটযজ্ঞ চালিয়ে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে----কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের রক্তের সাথে, চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তাদের মূলত: এই দেশে থাকারই অধিকার নেই ; অথচ বিভিন্ন সময় দুর্নীতি ও লুটপাটের সমর্থক সরকার তাদের জাতিদ্রোহ অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়নি । উপরন্তু তাদের যোগসাজশে সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গী হয়েছে । দিনে দিনে সে-দুর্নীতি ও লুটপাট সাগরচুরি রূপ ধারণ করে আসছে ।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা সৎ থেকে দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না । আসলে তিনিও যথোপযুক্ত লোকদের যথযথ স্থানে বসাতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং হচ্ছেন । সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনো বহু সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ রয়েছে । তাদেরকে খুঁজে এনে দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে তাদের নিয়ে তিনি এক সর্বাত্মক দুর্নীতি ও লুটপাটবিরোধী অভিযান পরিচালনা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে পারেন । কিন্তু দু:খজনক সত্য এই যে, এতো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও শেখ হাসিনা মানুষ চিনতে পারছেন না ! কাদের দলের কোন পদে নিতে হবে, কাদের এমপি উপদেষ্টা ও মন্ত্রী করতে হবে, কাকে কোন মন্ত্রণালয়ের সচিব করতে হবে ইত্যাদি কার্যক্রমে তিনি নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন বলেই তিনি যে জনকল্যাণের কাজ চান তা তিনি তাদের কাছ থেকে পাচ্ছেন না । যে লুটেরা ও মাফিয়াদের করাল গ্রাসে পড়ে দেশের অর্থনীতিসহ গোটা দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সাধারণ মানুষ যাদের বিরুদ্ধে চরম বিরক্ত তাদেরকে দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে কেনো ও কী কারণে যে বসিয়ে রেখেছেন তা সত্যিই বোধগম্য নয় ।

দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও মাফিয়াদের অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে । তাদেরকে আর কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেয়া যাবে না । মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে লুটেরা-মাফিয়া চক্রের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা এবং সংকীর্ণমনা ও স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদেরও ক্ষমা করা যায় না । এরা তাদের ব্যক্তি ও চক্রের স্বার্থে দেশকে ধ্বংসের শেষ সীমানায় নিয়ে এসেছে । তাদের কারো ক্ষমা নেই ।

দেশের সচেতন সৎ ত্যাগী ও জাগ্রত বিবেকবান সাহসী মানুষদেরকে আজ একজোট হয়ে ঐসব স্বার্থবাদী সংকীর্ণমনা সাম্প্রদায়িক অপরাজনৈতিক শক্তি এবং উদগ্র লুটেরা-মাফিয়াচক্রকে চিরতরে উৎখাত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে । এটাই সতেরো কোটি মানুষের দাবি । মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি । মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের দাবি । বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপর্ণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, তেমনি স্বাধীন দেশটি পরিচালিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে-----মুক্তিযোদ্ধা-জনতার সমন্বিত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test