E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তুমি রবে বাঙ্গালীর হৃদয়ে

২০২০ সেপ্টেম্বর ০৮ ০০:২৬:৪০
তুমি রবে বাঙ্গালীর হৃদয়ে

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


জীবনে বহু রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান লড়াই করে জিতলেও মৃত্যুর সাথে দীর্ঘদিন লড়াই করে হেরে গেলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জি। ভারত বর্ষের প্রথম বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি বাঙ্গালীর দুঃসময়ের পরীক্ষিত অকৃত্রিম বন্ধু প্রনব মুখার্জির প্রয়ানে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। দিল্লির আর্মি রিসার্স অ্যান্ড রেফারেল হাসপাতালে কোমায় থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না তিনি ছিলেন বাঙ্গালীর বিভিন্ন দুর্যোগে পাশে থাকার মতো একজন মানুষ।

১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জন্ম নেয়া প্রনব মুখার্জি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে (২০১২-১৭) পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এমন কি তিনি অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণূ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। জ্ঞান, মেধা আর প্রজ্ঞায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিক শিক্ষক হিসেবে। তিনি ইতিহাস রাজনীতি ও আইন শাস্ত্রে পড়ালেখা করে সামাল দিয়েছেন ভারতের মতো বৃহৎ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি। রচনা করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৮টি বই। ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের প্রায় পাঁচ দশক বিভিন্ন দপ্তরের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন উত্থান পতনের মাঝেও তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। দায়িত্ব পালন করেছেন নিজের প্রজ্ঞায়। দেশকে আজন্ম ভালোবেসে গিয়েছেন সকল প্রকার লোভ লালশার উর্দ্ধে উঠে এমনকি কোন কিছু অন্যায় আবদারের নিকট করেননি মাথা নত। তিনি কংগ্রেসের রাজনীতি করলেও তিনি ছিলেন সমগ্র ভারতবাসীর নিকট প্রিয় পাত্র। ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেও তিনি ছিলেন এদেশের মানুষের আত্মার আত্মীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতীয় সংসদে এদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জোড়ালো ভূমিকা পালন করেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করে বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করেন। তারই সুস্পষ্ট নজির পাওয়া যায় ‘দ্য ড্রামাট্রিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ আত্মজীবনীমূলক বইয়ে।

বইয়ে তিনি লিখেছেন- ‘ বাংলাদেশের মানুষ যখন মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন আমি ৩৬ বছরের এক তরুণ সংসদ সদস্য। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে ভারতের সমর্থন দানের জন্য ১৯৭১ সালের ১৫ জুন ভারতের রাজ্যসভায় আমি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অভিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। যখন পার্লামেন্টের সদস্যরা আমার কাছে জানতে চান কীভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সমাধান হবে ? উত্তরে আমি জানাই, আমি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছি, যার অর্থ বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।”

এদশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ছিল মিত্রতা যার কারনেই শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর তার দুই তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহেনাকে ভারতে থাকার সময় বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেছেন বলে জানা যায়। ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অফ ল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরষ্কার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করা হয়। গত বছর ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরতেœ ভূষিত করা হয় তাকে। এছাড়াও আইভরি কোষ্ট ও সাইপ্রাস থেকে সর্বোচ্চ সম্মাননা পেয়েছেন।

এদেশ এবং এদেশর মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতা তা তার এ উক্তিটিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আরো উপলদ্ধি হবে। তিনি বলেন আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা এবং আমি এর ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মভূত করেছি। আমার স্ত্রীর জন্ম নড়াইলে এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। আমি বড় হয়েছি আপনাদের মতো একই সাহিত্যিক ও কবিদের লেখা পড়ে, সেসব গান শুনে যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ ভালোবাসেন, ঘুরে বেরিয়েছি একই নদীর তীরে, যা একই রকম গানের জন্ম দেয়, যা আমাদের মনকে একই রকমভাবে ভাবিত করে তোলে। যখন ছোট ছিলাম, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে একদিন আমার দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি এখানে আসতে পারবো।

প্রনব মুখার্জির মুখের এই অসাধারণ কথা গুলো থেকেই বুঝা যায় তিনি আমাদের কত আপনজন ছিলেন। কিভাবে ভালোবেসে ছিলেন এদেশকে এবং এদেশের মানুষকে। তিনি ছিলেন বাঙ্গালী এবং তার স্ত্রী বাংলাদেশের সন্তান ছিলেন বলেই হয়তো এদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। প্রকৃতিগত দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য ভারত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে তাই দুদেশের পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাসের জায়গাটা সবসময়ই থাকা উচিত সমান্তরাল। এই ক্ষেত্রে কূটনৈতিক দিকটি সফলতার সাথেই সমান্তরাল রাখার ক্ষেত্রে এই মহারথীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। তাই তার বিদায়ে বাংলাদেশের জন্য অপূরনীয় ক্ষতি এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন ধাক্কা লেগেছে ঠিক তেমনি বাংলাদেশও হারিয়েছে একজন আপনজনকে।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test