E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নীলা ও বিধাতার শক্তির অপব্যয়

২০২০ অক্টোবর ০২ ১৩:২৬:০২
নীলা ও বিধাতার শক্তির অপব্যয়

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন


নীলা বাংলাদেশের এক সাধারণ মেয়ে। কিন্তু বিয়োগান্ত ঘটনার বিরহবিধুর আখ্যানের করুণতম একটি চরিত্র। কে তার নাম নীলা রেখেছিল, তা আমি জানি না। তবে নীলা যে এক দুর্বৃত্ত ও একতরফা দানব প্রেমিকের ছুরির আঘাতে ব্যথায় ব্যথায় নীল হয়ে যাবে, কেউ কি তা জানত? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে যার শিরোনাম ‘সাধারণ মেয়ে’।

সাধারণ ওই মেয়ে কবির কাছে আকুতি জানিয়ে বলেছে, ‘একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি। /বড় দুঃখ তার। ’ কবিতার শেষ দুই লাইনে এসে কবিগুরু বলেছেন, ‘হায়রে সাধারণ মেয়ে! হায়রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!’ আমাদের নীলার ক্ষেত্রেও বিধাতার শক্তির অপব্যয় হয়ে গেল! এ অপব্যয়ের জন্য সরাসরি বিধাতাকে দায়ী করা মূঢ়তা। কেননা, বিধাতার আরেক অনাসৃষ্টি মিজান নীলাকে ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে।

পরিবার ও পুলিশের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ঘটনার প্রারম্ভ, বিস্তার ও সমাপ্তিটি এ রকম- বছর দেড়েক ধরে নীলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল ব্যাংক কলোনির আবদুর রহমানের ছেলে কলেজছাত্র মিজানুর রহমান (২০)। ১৪ বছর বয়সের কিশোরী নীলা রায় মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বালিরটেক গ্রামের নারায়ণ রায়ের মেয়ে। সে ছিল স্থানীয় অ্যাসেড স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী এবং পরিবারের সঙ্গে সাভার কাজিমুকপাড়ায় থাকত।

নীলা গত ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। তার ভাই অলক রায় তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। বাসা থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর মিজান রিকশার গতি রোধ করে। তার হাতে ছিল দুটি বড় ছুরি। এরপর অস্ত্রের মুখে নীলাকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পালপাড়ায় নিয়ে যায়। সাভার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের উল্টো দিকের একটি গলির ভিতরে নিয়ে নীলার গলায়, পেটে, মুখে ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করে মিজান পালিয়ে যায়।

নীলার চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে থানা রোডের প্রাইম হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হলে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে। পুলিশ জানায়, মিজান স্থানীয় একটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এর আগে একবার টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি।

নীলার বড় ভাই অলক রায় জানায়, ওইদিন রিকশা নিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর পেছন থেকে এসে মিজান গতি রোধ করে এবং তার বোনের সঙ্গে কথা আছে বলে রিকশা থেকে নামতে বলে। সে বাধা দিলে মিজান তাকে হত্যার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে মিজান তার বোনকে জোর করে রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। মিনিট বিশেক পরে সে জানতে পারে, মিজান তার বোনকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়েছে।

অলক জানায়, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে মিজান তার বোনকে উত্ত্যক্ত করত। ফেসবুকে তার বন্ধু হয়ে চ্যাট করতে বলত। এসবের প্রতিবাদ করলেই মিজান তাদের পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দিত। আর তারা মিজানকে দুর্ধর্ষ ও ক্ষমতাধর মনে করে ভয়ে সব চেপে যেত। পুলিশের কাছে অভিযোগ করে আরও বিপদে পড়তে পারে- এমন ভেবে তারা বিষয়টি পুলিশকে জানায়নি। এ ব্যাপারে মিজানের মা-বাবাকে বলার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো মিজানের মা নীলাকে মিজানের সঙ্গে কথা বলতে ও ফেসবুকে চ্যাট করার পরামর্শ দিতেন। গণমাধ্যমের সূত্রে খবরটি জানার পর বেশ কষ্ট পেয়েছি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, কষ্টটি বোবাকষ্ট, ভোঁতা কষ্ট, নিষ্ফল কষ্ট। প্রতিনিয়ত এ ধরনের মর্মান্তিক ও হৃদয়হীন ঘটনা দেখতে দেখতে কষ্টগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে; আমাদের সংবেদনশীলতা সংবেদন হারাচ্ছে; সহমর্মিতা পরিণত হচ্ছে নিষ্ফল আক্রোশে। কন্যাশিশুর লজ্জাজনক নিগ্রহ, কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করা, শিক্ষালয়ে ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা এখন প্রতিদিনের ঘটনা। শিক্ষিত ও ভদ্র ঘরের কোনো মেয়ে আর এখন একা একা বাসে, সিএনজিতে, এমনকি উবারে উঠতেও সাহস করে না। এমন এক সভ্য দেশ আমরা গড়ে তুলেছি! আমাদের নীতিনির্ধারকদের লজ্জিত হওয়া উচিত। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখে এবং এর ৯০ শতাংশের কোনো প্রতিকার না হওয়ায় প্রায়ই মনে হয়, আমাদের নীতিনির্ধারক ও পদাধিকারীদের বোধ হয় সভ্যতা -ভব্যতা, লজ্জা-শরম- সবকিছু লুপ্ত হয়ে গেছে!

সিলেটের খাদিজাকে মাটিতে ফেলে বদরুল নির্মমভাবে কুপিয়েছিল; সোহাগী জাহান তনুকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে শারীরিক মর্যাদা নষ্ট করার পর হত্যা করা হয়েছিল; নুসরাতকে চারদিক থেকে চেপে ধরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল; মজনু রাতের নির্জনে একলা নারীকে পেয়ে তার রিরংসা চরিতার্থ করে ফেলে গিয়েছিল খিলক্ষেতের কাছের নির্জন এলাকায়। তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু কী লাভ? প্রতিদিন ঘটনা ঘটছে। কোনো কিশোরী দিনের পর দিন বখাটে কর্তৃক উত্ত্যক্ত হওয়ার পর প্রতিকার না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। শত শত নারী শিকার হচ্ছে পুরুষের ধর্ষকাম ও লালসার। তিন থেকে আট-নয় বছরের কন্যাশিশুও রেহাই পাচ্ছে না। তিন মাসে তিন-নয় বছরের কন্যাশিশু ধর্ষিত হয়েছে দুই শর অধিক। ‘মডারেট’ মুসলমানের দেশ এখন পরিণত হয়েছে গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার অভয়ারণ্যে!

কত আর বলা যায়? কত আর লেখা যায়? কিছু দিন পর পরই আমরা দেখছি যে, কোনো যুবতীকে খাদিজার মতো মাটিতে ফেলে রামদা দিয়ে কোপানো হচ্ছে; কোনো কিশোরীর পরিণতি হচ্ছে নীলার মতো বিয়োগান্ত; হিজাব পরা কোনো নারীকে তনুর মতো ধর্ষণ করে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে; অথবা কোনো বোরকা পরা নারীকে নুসরাতের মতো কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনাগুলোর কোনো লাগাম নেই, কোনো প্রতিকার নেই। ধর্ষণ মামলায় কনভিকশন রেট থ্রি পারসেন্ট! কি ভয়াবহ তথ্য! ১০০ জন ধর্ষকের মধ্যে শাস্তি পাচ্ছে মাত্র তিনজন! নারীরা রাজ্য ও বিরোধী দল শাসন করে লাভ কী তার নিরাপত্তাই যদি না থাকে। বখাটে ও ধর্ষকদের শাস্তি দেওয়া না গেলে আইন-আদালত ও পুলিশ রেখে লাভ কী? কন্যাশিশু ও কিশোরীদের যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায় তাহলে বর্বর সমাজ ও একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের সমাজের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

শত শত বছর ধরে নারীর নিয়তি ও গন্তব্যকে ব্যাখ্যা করা হতো একটি বাক্য দিয়ে- ‘কন্যা তুমি কার? শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের। ’ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোয় নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছে এই সেদিন, অর্থাৎ ১০০ বছর বা তার কিছু আগে। সৌদি আরবের নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছে বছর পাঁচেক আগে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। আধুনিক ইতিহাসের শুরু যে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে, সেই ফরাসি বিপ্লবের বিখ্যাত ঘোষণা ‘দ্য ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন, ১৭৮৯’-এও ‘ওম্যান’ বা নারীদের কথা নেই।

তা সত্ত্বেও গত ১০০ বছরে নারীদের অধিকার যতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং নারী ক্ষমতায়ন যে জোর কদমে এগিয়েছে তা মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব নারী-পুরুষের সমান অধিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এর পরে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী ক্ষমতায়ন এবং নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ করার জন্য অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি বা আইন হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র নারী-পুরুষের সমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নারীরা আজ শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত ও রাজ্য পরিচালনায় সমানতালে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে।

কিন্তু সব ইতিবাচক অর্জন ছাপিয়ে যেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রশ্ন, সেটি হচ্ছে- নারীর শারীরিক মর্যাদা যদি প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হয়; মানবিক মর্যাদা, সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে যদি তারা বাঁচতে না পারেন; তাহলে কী করে দাবি করব যে আমরা সভ্য জাতি? আমাদের নৈতিক বোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধান-ঘোষিত সমতার বাণী কি তখন অর্থহীন হয়ে যাবে না? এক একজন নীলা, তনু ও নুসরাতের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আমাদের কি বোবা যন্ত্রণায় আবৃত্তি করতে হবে- ‘হায়রে সাধারণ মেয়ে! হায়রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!’

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test