E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমরা ধর্ষণ যুগের সাংবাদিক

২০২০ অক্টোবর ১৬ ১১:৫১:৪৭
আমরা ধর্ষণ যুগের সাংবাদিক

তপু ঘোষাল


বিশ্ব সংস্কৃতির সুন্দর-অসুন্দর গ্রহণ-বর্জনে নিয়ম মানছে না বাঙালি। প্রযুক্তির দেদার ব্যবহার সংযমের খিল খুলে নিয়েছে? বদ আকাঙ্ক্ষা লজ্জাহীন করে তুলছে আমাদের। বিকৃত চাহিদা মেটাতে পশুবৃত্তি করছি আমরা। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সম্পদে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিকই পিছিয়ে পড়ছি নৈতিকতা আর সংযমে।

দম বন্ধ হয়ে আসার মতো চোখভেজা নির্মমতার খবর এখন দেশবাসীকে প্রায়ই শুনতে হয়। একটার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি নির্মম দুঃসংবাদ সামনে হাজির হয়। অবিকল মানুষের খোলসপরা জানোয়ারগুলো সভ্যতার চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। এরা পশুতুল্যও নয়। পশু কখনো স্বগোত্রীয় মৃতদেহের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয় না।

পোষা পশুর প্রভুভক্তি আছে, বিশ্বাস করা যায়। মণিবকে ভালোবাসে। প্রয়োজনে জীবন বাজিও রাখে। অথচ খোলসপরা মানুষ আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করে নির্দ্বিধায় প্রাণসংহার করছে নারী ও কন্যাশিশুদের! এক যুগ ধরে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা যেন বাঙালির গায়ে গায়ে লেপ্টে আছে। কিছুদিন আগে নরসিংদীতে হত্যার পর মৃতদেহ ধর্ষণের ঘটনা বিবেক রুদ্ধ করে দিয়েছিল। তখন মনে মনে ধরে নিয়েছি, এই জানোয়ার ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। না হয় মৃতদেহের সঙ্গে কীভাবে কী! পাশবিক ঘটনাগুলো একের পর এক বিবেক খুবলে খাচ্ছে।

কিন্তু রাষ্ট্র ও তার প্রশাসন পাশবিকতার মাত্রা অনুযায়ী, কার্যকর কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করেই অপরাধ দমনে উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হয় রাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। অথচ সে ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছি আমরা।

দেশের গণমাধ্যমে প্রতিদিন ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার খবর এখন প্যাকেজ আকারে ছাপাতে হয়। কারণ ঘটনা দু’একটি নয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। কোথাও অপরাধী গ্রেপ্তার হচ্ছে, আবার কোথাও ক্ষমতার দম্ভে পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে অধিকাংশ ঘটনা বাঙালির সম্মান সম্ভ্রমের চাদরে চাপা পড়ে যায়। যে ঘটনা ভুক্তভোগী বা তার স্বজনের অনিচ্ছাকৃত প্রকাশ তাতেই ঘটনার হার এমন। যদি সব ঘটনা প্রকাশ পেত তাহলে এর পরিসংখ্যান কোন মাত্রায় যেত তা আমরা অনুমান করতে পারি।

অপরাধীরা ঘটনার মাত্রায় নতুন নতুন নজির স্থাপন করছে। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা উল্টে দিয়ে হত্যার পর ধর্ষণ করছে! মূল্যবোধের অবক্ষয় বা নৈতিক স্খলন একটি সমাজে কোন মাত্রায় গেলে অপরাধের ধরন এমন হতে পারে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধাও কামাতুর হিংস্রতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণ কলঙ্কের রেকর্ড করে চলেছি আমরা। কীভাবে এই অপরাধের রাশ টেনে ধরা যায় তার কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখছি না। দেশের ন্যক্কারজনক এই ধর্ষণের মহামারীই বলছে পুরুষতান্ত্রিকতায় ধর্ষণ যেন অসংযমী মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। মুখে মুখে, মেডিকেল চেকআপে, সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়, কাগজে-কলমে যেন বিরামহীনভাবে এই কুকর্মটি করে যাচ্ছি।

প্রতিদিন একেকটি ঘটনার বিবরণের সঙ্গে মর্মস্পর্শী আক্ষেপ সংবাদকর্মী হিসেবে এ দেশের হাজারো সাংবাদিকের চোখ ভিজিয়ে দেয়। অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত অথচ নিয়তি যেন সাংবাদিকদের জন্য ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশের কাজটি নিত্যকার করে দিয়েছেন। গত দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই সময়ে ধর্ষণের মতো ঘটনার ভয়াবহতা যেভাবে বেড়েছে তাতে আমরা বর্বর যুগের কাছাকাছি চলে গেছি বলে মনে হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রাচুর্য আর আধুনিকতায় মুড়িয়ে থাকলেও ভেতরটা যেন জানোয়ারের অংশ। সভ্যতাকে বিবর্ণ করা ঘটনাগুলো এখনকার মানুষকে সময়ের সঙ্গে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই আমরাই আমাদের সাক্ষ্য বহন করছি ‘ধর্ষণ যুগের সাংবাদিক’।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test