E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘নাটোরের বনলতা সেন’ এবং আমাদের ‘মহসীন আলী’     

২০২০ নভেম্বর ১৭ ১৩:৩২:৫২
‘নাটোরের বনলতা সেন’ এবং আমাদের ‘মহসীন আলী’     

শিতাংশু গুহ


ক’দিন আগে ড: নুরুন নবী কল দেন্, মিস করি। পরে আমি কল ব্যাক করি, তিনি ধরেন। জানতে চাইলেন, ডঃ মহসীন আলী’র খবর জানি কিনা? বললাম, না, তেমন যোগযোগ নেই, তবে তিনি এখন বেশিরভাগ আমেরিকা থাকেন তা জানি, ফোন নাম্বার আছে। ড: নবী জানালেন, তিনি মহসীন আলীকে কল দিয়েছেন, কিন্তু কেউ ধরেনি। জিজ্ঞেস করলাম, মহসীন ভাই’র কি হয়েছে? কোন খারাপ কিছু? ড: নবী বললেন, ডাক্তার মাসুদ জানিয়েছে, মহসীন আলী বেশ অসুস্থ, লিভার সিরোসিস হয়েছে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। 

নবীভাই’র ফোন রেখে কল দিলাম মহসীন আলীকে, তিনি ধরলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কি শুনলাম! মহসিন আলী জানালেন, লিভার সিরোসিস হয়েছে, এর কোন চিকিৎসা নেই, জীবন আরো নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলো! অনেকক্ষন কথা হলো, অনেক প্রসঙ্গ এলো, বাংলাদেশে দীর্ঘ অবস্থান, আওয়ামী লীগের জন্যে জীবন দিয়েও কিছু না পাওয়ার বেদনা টের পেলাম। বললাম, আপনার মত ত্যাগী ও ভালো মানুষের কদর আওয়ামী লীগ করতে শেখেনি, তাই হাজার ভালো কাজ করেও আওয়ামী লীগ অনেকটা জনসমর্থনহীন এবং ভুঁইফোররাই এখন দাপটে আছেন!

আওয়ামী লীগ ২০০৯-এ ক্ষমতাসীন এলে ডঃ মহসিন আলী নিউইয়র্কে তাঁর জমজমাট ব্যবসা ছেঁড়ে দেশে চলে যান, লক্ষ্য দেশসেবা, এমপি বা মন্ত্রী হওয়া। তখন একদিন ভাবি আমায় বলেছিলেন, দাদা, আপনার ভাই এবার মন্ত্রী হয়েই ছাড়বে। বললাম, ভালোই তো, হওয়া উচিত। আমরা মন্ত্রীর বাসায় যাবো। না, মহসীন আলী মন্ত্রী, এমপি কিছুই হ’ননি, এজীবনে আর হবেন বলে মনে হয়না? লিভার সিরোসিস নিয়ে আর যাই হোক, পলিটিক্স করা সম্ভব নয়! মোহসীন আলী অনেকদিন দেশে ছিলেন, জনসেবা করেছেন, এলাকায় জনপ্রিয় হয়েছেন, মানুষ তাঁকে পছন্দ করে, তাতে কি?

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু মহসিন আলীকে একটি উচ্চ পদ দিয়েছিলেন, কোন একটি সংস্থার ডিরেক্টর। পদটি সম্ভবত: অর্থমন্ত্রী নিয়ন্ত্রণে ছিলো, আবুল মাল আবদুল মুহিতকে তিনি ডেকে বলেও দিয়েছিলেন। ডঃ মহসিন আলী অর্থমন্ত্রী মুহিতের সাথে ক’বার দেখাও করেছেন। ক’দিন তিনি মোহসীন আলীকে ঘুরিয়েছেন, এরপর সেই পদে তাঁর পছন্দের একজনকে বসিয়ে দেন। মোহসীন আলী বাদ! মহসীন আলীর দোষ, তিনি ‘তেল’ দেয়াটা ভালো করে শেখেননি। তেলের জমানায় তেল ছাড়া সবকিছু বিকল, মহসীন আলী আবার তা প্রমান করেছেন!

মহসীন আলীর সাথে কথা বলার পর আমি আবার ডঃ নুরুন নবীকে কল দেই, জানাই যে, মহসিন ভাই আপনার ফোন দেখেছেন, কিন্তু ডাক্তার কাছে থাকায় ফোন ধরতে পারেননি। এরপর আমি ফেইসবুকে একটি পোস্টিং দেই, তাতে লিখি, আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডঃ মহসিন আলী হাসপাতালে, সবাই তাঁরজন্যে আশীর্ব্বাদ/দোয়া করবেন’। অসংখ্য ‘লাইক’ ও ‘কমেন্ট’ দেখে বুঝলাম, মানুষ সত্যিই মহসীন আলীকে ভালোবাসে। লিভার সিরোসিসের কথা কিন্তু আমি লিখিনি, বন্ধুদের দু:খ দিতে চাইনি। মোহসীন আলী নিজেই তাঁর রোগের কথা সবাইকে জানিয়েছেন।

দেখলাম, মহসিন আলী ফেইসবুকে একটি পোস্টিং দিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বোঝা যায়, তিনি সবার উদ্বেগ ও ভালবাসায় আপ্লুত। সবাইকে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, তাঁর লিভার সিরোসিস হয়েছে, সাথে ডিওডেনাল আলসার ও খুবই নিন্ম হিমোগ্লবিন কাউন্ট। তাকে দু’বার রক্ত দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানিয়েছেন, হাসপাতাল তাকে ছেড়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু তাকে ডাক্তারের সার্বক্ষণিক পর্যবেশনে থাকতে হবে। মহসিন আলী সম্ভ্রান্ত, উচ্চশিক্ষিত, লিভার সিরোসিস সম্পর্কে সবকিছু জানেন, তবে তিনি ভেঙ্গে পড়েননি, যা আশার কথা।

তাই হয়তো লিখেছেন, এ রোগের চিকিৎসা নেই, কিন্তু লিভারের বর্তমান অবস্থায় মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। তিনি সেই চেষ্টাই করবেন বলে আমাদের আশ্বস্থ করেছেন। অন্যথায় লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, যা জটিল, ব্যয়সাধ্য ও প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ। মহসিন আলীকে তাই হয়তো বাকি জীবনটা ঝুঁকি নিয়েই কাটাতে হবে? তিনি সবার দোয়া চেয়েছেন। পরিশেষে তিনি বলেছেন, আমি বিচ্ছুরাজা, মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১-এ মারা যেতে পারতাম, আল্লাহ’র ইচ্ছায় মরিনি, তিনি চাইলে আরো কিছুদিন এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকবো। মোহসীন সাহেব, আপনি কোথায় যাবেন, আমাদের আমাদের ছেড়ে?

আমরা চাই, আপনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন। আমাদের সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে! নিউইয়র্কে যে ক’জন ভালো মানুষের সাথে আমার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো, মহসীন আলী তাঁদের অন্যতম। তিনি ডেকোরেটেড মুক্তিযোদ্ধা, বিচ্ছুবাহিনীর কমান্ডার। বিবিসি মুক্তিযুদ্ধকালে ধারণকৃত তাঁর ভিডিওটি স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রামাণ্য দলিল। নাটোরের গুরুদাসপুরে তিনি স্কুল, কলেজ এবং আরো অনেক কিছু প্রতিষ্ঠা করেছেন। এতকাল আমরা শুনেছি, ‘নাটোরের বনলতা সেন’; সেইসাথে এবার যুক্ত হোক, নাটোরের মহসীন আলী’র নাম।

মহসিন আলী একবার নিউইয়র্ক বাংলাদেশ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট তখন নুরুল ইসলাম অনু। কারা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন তা মনে নেই, তবে ফার্মাসিষ্ট আক্তার হোসেন প্রার্থী ছিলেন। তাঁর আমলে তিনি জাতীয় শোক দিবসে ‘সোসাইটির পিকনিক’ করেছিলেন। এ কারণে আমাদের সংগ্রাম ছিলো আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে। অনু-ভাই’র অনুরোধে আমরা আক্তার হোসেনের সাথে বৈঠকে বসি। তিনি প্রস্তাব করেন মোহসীন আলীকে প্রত্যাহার করতে। আমরা রাজি হইনি, বরং বলেছি, মহসীন আলী আপনার চেয়ে বেশি ভোট পাবেন। নির্বাচনে তাই হলো, দু’জনেই হেরেছেন, মহসীন আলী বেশি ভোট পেয়েছিলেন।

নব্বই দশকের মধ্যভাগে আমরা ‘জয়বাংলা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি, মোহসীন আলী সভাপতি, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক। যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের ঊষালগ্ন থেকেই মোহসীন ভাই এর অন্যতম নেতা। দীর্ঘদিন তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। বিএনপি যখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ওআইসি’র সেক্রেটারী জেনারেল প্রার্থী করে, আমরা তখন এর তীব্র প্রতিদ্ধন্ধিতা করি। সাবের হোসেন চৌধুরীর হাত দিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী, আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমায় সাকাচৌ সম্পর্কে ৬২-পাতার একটি দলিল পৌঁছে দেন।

এই দলিলটি মোহসীন আলী তাঁর এষ্টোরিয়ার অফিস থেকে ওআইসি ভুক্ত সবগুলো দেশে, মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো ইংরেজি কাগজে ফ্যাক্স করেন, এবং এতে তাঁর প্রায় দুই হাজার ডলার খরচ হয়। এতে সুফল হয়, খালেদা জিয়া মধ্যপ্রাচ্য সফরে গেলে তাঁকে সম্ভবত: ‘গালফ নিউজ’ প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলো, ‘আপনার প্রার্থীর বিরুদ্ধে তো হত্যা মামলার অভিযোগ রয়েছে’? ওই দলিলে সবই ছিলো। আমরা চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ ওআইসি’র সেক্রেটারী জেনারেল হোক, সাকাচৌ নয়, তাই আমরা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের কথা কে শোনে? সাকাচৌ হেরেছিলেন।

ওই সময় একদিন মোহসীন আলী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র সাথে একান্তে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি সবিস্তারে তাঁর কর্মকান্ড তুলে ধরেন। এরমধ্যে সাকাচৌ প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। বিরোধী দলীয় নেত্রী খুশি হ’ন। মোহসীন আলী পরে আমায় জানায়, নেত্রী প্রশংসা করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি তো অনেক ভালো কাজ করছেন, কিন্তু কার সাথে মিশে এসব কাজ করছেন? মোহসীন ভাই উত্তর দেন, ‘শিতাংশুদা’র সাথে। নেত্রী তখন বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি তাঁর সাথে থেকেই কাজ করুন’।

মোহসীন ভাই হেঁসে আমাকে বলেন, আমি এতকিছু বললাম, আর উনি আমাকে আপনার সাথে কাজ করার পরামর্শ দিলেন। মোহসীন ভাইকে বললাম, আসলে সাকাচৌ ডক্যুমেন্ট তিনি আমায় দিয়েছিলেন, সেকথা তো তাঁর চাইতে ভালো কেউ জানেনা! তাই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, আপনি ও আমি একসাথে কাজ করছি। আসলেই মোহসীন আলী, ডঃ নুরুন নবী ও আমি একটা সময় অনেক কাজ একত্রে করেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দল বা ত্যাগী কর্মীরা হারিয়ে, কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য। তবে মোহসীন আলী আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন না। কত স্মৃতি, সুযোগ পেলে আরো লিখবো। ভালো থাকুন বন্ধু মোহসীন আলী।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test