E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় 

২০২১ মার্চ ০৩ ১৪:৪৩:২৮
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় 

শিতাংশু গুহ


স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর ২০২১-এ দাঁড়িয়ে সুদূর নিউইয়র্ক থেকে স্বদেশভূমির দিকে তাকালে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে অপরিচিত মনে হয়। সত্তরের দশকের শেষপাদে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আমরা যখন কর্মজীবনে ঢুকি, তখন আমাদের বন্ধু-বান্ধব যে যেদিকে পারছিলেন বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছিলেন। সুযোগ এসেছিলো, দেশ ছাড়িনি। মনে হয়েছিলো, ঘরের ছেলে ঘরেই থাকি। শেষপর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয়েছে। এখন মনে হয়, ‘সেই তো মল খসালি; তবে কেন লোক হাসালি’? অর্থাৎ দেশ তো ছাড়তেই হলো, আগে কেন ছাড়লাম না? যেদেশ ছাড়তে চাইনি, যে দেশকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাতে চেয়েছি, আজকের বাংলাদেশ, সেই দেশ নয়? সব মানুষের দেশ বাংলাদেশ ছিলো কাম্য, ধারণা ছিলো, আশা ছিলো, দেশ হবে সবার- ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। তা আর হলো কই? ধর্মান্ধ শক্তি বাংলাদেশে ধর্মের ঢোল এতজোরে বাজাচ্ছে যে, প্রগতিশীল শক্তির ক্ষীণকণ্ঠ প্রতিদিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। তাই ভাবি,  যে দেশ ছেড়ে এসেছি, সে-দেশে কি আর ফিরে যেতে পারবো?

উত্তর সোজা, না, ফেরা সম্ভব নয়, ইচ্ছে থাকলেও নয়! কেউ কি অন্ধকূপে ঝাঁপ দেয়? কথায় আছে, ‘নিশ্চিত ছেড়ে যে অনিশ্চিতে ধায় একুল-ওকূল সে দু’কুল হারায়’? সেবার (১৯৯২-৯৩) দাঙ্গার পর দেশে গেলে আত্মীয়-স্বজন, বা হিন্দুদের প্রায় সবাইকে ‘বলির পাঠা’র’ মত কম্পমান মনে হয়েছে। আমার সুহৃদ রুহুল বললো, ‘ক’দিন আগে এলে অবস্থাটা বুঝতে-’? সবার মনে দেখেছি দেশ ছাড়ার প্রবণতা। জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচানোর এই আর্তি বড় করুন। আমেরিকা থাকি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, এ দেশে ধর্মের নামে কেউ আমার সন্তানের বুকে ছুরি ধরবেনা। এ হীনমন্যতা থেকে আমার বাবাও রক্ষা পায়নি। শেষ বয়সে তাই তাকে ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পড়তে হয়েছে, অনিচ্ছাসত্বেও পিতৃপুরুষের ভিটা ছাড়তে হয়েছে। একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করেছিলাম, একটি খাট বাবা কিছুতেই বিক্রী করেননি। যেদিন ওটা তার চোখের সামনে লুট হয়ে যায় সেদিন তারমুখে প্রশান্তির হাসি দেখেছিলাম। এখনো ভাবি, বাবার ঐ হাসি’র অর্থ হয়তো, লুট হলেও বিক্রি তো করতে হয়নি?

ছোট্ট এ পারিবারিক ঘটনাটি বলার কারণ হচ্ছে, যারা হাঁসিমুখে বুক চেতিয়ে বলতে পছন্দ করেন যে, হিন্দুরা স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করছে, তাদের বোঝাতে যে, না, ঘটনা তা নয়, হিন্দুরা দেশত্যাগ করছে, আপনাদের অত্যাচারে অথবা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনাদের নীরব ভূমিকার কারণে। হিন্দুরা যেতে বাধ্য হচ্ছে, ওদের যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। সেবার দেশে গেলে (১৯৯৩) আমার এক আত্মীয়া বলেন, তোমার জিনিসপত্রগুলো তুমি নিয়ে যাও; নইলে কবে লুট হয়ে যাবে কে-জানে? কথাটা সত্য। সম্পদ, জীবন, কন্যা, লুট হবার আশঙ্কার মধ্যেই হিন্দুরা গ্রামেগঞ্জে বসবাস করেন। হায় স্বদেশভূমি! হায় স্বাধীনতা! তোমাকেই কি আমরা চেয়েছিলাম? না, এ স্বাধীনতা আমরা চাইনি। পাকিস্তান ভেঙ্গে আর একটি ‘মিনি পাকিস্তান’ সৃষ্টির জন্যে তো স্বাধীনতা আসেনি! বাংলাদেশে হিন্দুরা ‘ভূমিপুত্র’, শুধুমাত্র ধর্মের কারণে মুক্তিযুদ্ধে তাদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়, ধর্ষিতা ও নিহতের বেশিরভাগ হিন্দু, এক কোটি হিন্দু ভারতে আশ্রয় নেয়, এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ‘হিন্দুরা আজ নিজদেশে পরবাসী’।

বাংলাদেশে প্রায় সবাই কথায় কথায় ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ টানেন। অনেকদিন আগে পশ্চিমবাংলার সাবেক এক প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় একটি সুন্দর যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। এক বিদেশী রেডিও’র সাথে ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: “ভারত থেকে সাম্প্রদায়িকতা এখনো দূর করা যায়নি এটা ঠিক। তবে তা সত্বেও দেশভাগের সময় ভারতে যত মুসলমান ছিলেন, বর্তমানে তাদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে দেশভাগের সময় প্রায় ৩৩% অ-মুসলমান ছিলেন, এখন সেইসংখ্যা কমে ১%-এ দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের চিত্রও প্রায় অভিন্ন, সেখানে প্রতিদিন সংখ্যালঘু কমছে। এই চিত্র থেকে সাম্প্রদায়িকতা কোথায় বেশি তা স্পষ্ট হতে পারে”। বাংলাদেশ আমার দেশ। আজকের বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরপুর। কিছু লোক এখনো নির্লজ্জের মত বলে বেড়ান বাংলাদেশের মানুষ ধর্মান্ধ নয়, বরং অ-সাম্প্রদায়িক? কথাটা মিথ্যা। অবশ্য, সংখ্যালঘুর সম্পত্তি দখল, নারী অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ, নির্যাতন, মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা ধ্বংস, মুর্ক্তি ভাঙ্গা, ব্যবসা-বাণিজ্য লুটপাট যদি সাম্প্রদায়িকতা নাহয় তাহলে ভিন্নকথা! যারা মনে করেন, সংখ্যাগুরুর মাথা, মাথা আর সংখ্যালঘুর মাথা লাঠি মারার জায়গা, তাদের কাছে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাঝে মাঝে মনে হয়, রাহুই যদি চন্দ্রকে গ্রাস করবে, তাহলে কি দরকার ছিলো এই স্বাধীনতার?

স্বাধীনতার সুফল সংখ্যালঘুর ঘরে পৌঁছেনি। একটি ধর্মগোষ্ঠী স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। অতীতের মত সংখ্যালঘুরা আজো অত্যাচারীর আমানত। ১৯৭৫ থেকে আমাদের পেছন ফিরে তাকানো শুরু, নাকি ১৯৭২ থেকে? হিন্দুরা আবার ধাক্কা খেয়ে ভাবতে শুরু করে, এদেশ কি আমাদের? তখনো ক্ষীণ আশা ছিলো, হয়তো প্রগতিশীলরা ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ২০২১-এ দাঁড়িয়ে বলা যায়, কিচ্ছু হবার নয়, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ; ‘ইসলাম’ সামনে দাঁড়ালে সবাই মুসলমান। এজন্যেই হয়তো কথায় কথায় শুনতে হয়, ‘৯০% মুসলমানের দেশ’, ‘দেশ চলবে মদিনা সনদের আলোকে’ ইত্যাদি। মুসলিম বিশ্বে অনেক রাজা-বাদশা আছেন, গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা, মানুষের সম-মর্যাদা নাই। বাংলাদেশে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রাণী, ধর্মীয় বৈষম্য সর্বত্র, দেশে বিচার নাই, নির্বাচনী ব্যবস্থা নাই, নেই সু-শাসন, বা মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রযন্ত্রে ধর্ম ঢুকলে ওসব থাকেনা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে ইসলাম ঢুকেছে, কাজেই গণতন্ত্র, নির্বাচন, সু-শাসন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। সংখ্যালঘুর বিদায় তো ঘটছেই এবং ঘটতেই থাকবে, যদিনা ----?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test