E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুতরাং, কবরী চলেই গেলেন! 

২০২১ এপ্রিল ১৭ ১৩:০৭:১৭
সুতরাং, কবরী চলেই গেলেন! 

শিতাংশু গুহ


বরেণ্য নায়িকা কবরী চলে গেলেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। কবরীর সিনেমায় আগমন ১৯৬৪-সালে। তখনো আমার সিনেমা দেখা শুরু হয়নি, তবে কবরীর প্রায় সবগুলো ছবি সম্ভবত: দেখেছি। এরমধ্যে ‘সুতরাং’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বা ‘সারেং বউ-‘-র কথা মনে আছে। কবরীর মৃত্যু’র ঘন্টা দু’য়েক-র মধ্যে ফেইসবুকে পোস্টিং দেই, “অভিনেত্রী কবরী চলে গেলেন’। স্বভাবত:ই প্রচুর কমেন্ট পড়তে থাকে। কবরীকে সবাই চিনে মিষ্টি নায়িকা হিসাবে, অভিনেত্রী হিসাবেই তাঁর খ্যাতি। চট্টগ্রামের মেয়ে মিনা পাল, পরে মীনা চৌধুরী-কে নায়িকা কবরী হিসাবে গড়ে তুলতে সম্ভবত: সুভাষ দত্ত’র অবদান সবচেয়ে বেশি। কবরীকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিলোনা, তবু লিখছি, কারণ আমার পোষ্টের ওপর বেশকিছু মন্তব্য এসেছে, যা পাঠকের জানা দরকার। 

বন্ধন দেবনাথ নামে একজন লিখেছেন, ‘কনভার্টেট’। তাঁকে লিখলাম, আমি জানি, মৃত্যু’র পর এসব কথা না তোলাই ভালো। রাজীব দাস বাবু লিখলেন, আমরা জানিনা, জানতে চাই, লিখুন’। আমেরিকার ভার্জিনিয়ার সাংবাদিক হারুন চৌধুরী লিখেছেন, ‘দেবনাথের সাথে একমত হতে পারলাম না, সাংস্কৃতিক জগতে আবার জাত-পাত-ধর্ম কি? এ তিনটি মন্তব্য আমায় উৎসাহ জুগিয়েছে লিখতে, বিশেষত: বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে ‘ধর্ম’ কতটা মুখ্য তা জানা দরকার। উল্লেখ্য যে, ভারত-পাকিস্তান সিনে-জগৎ একই সময়ের হলেও ধর্মের কারণে পাকিস্তানে ‘সিনেমা শিল্প’ ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশে একই কারণে বিনোদন শিল্প প্রতিদিন জৌলুস হারাচ্ছে। সেদিকে যাওয়ার আগে আমার পোষ্টে কবরীকে নিয়ে আরো দু’টি মন্তব্য দেখে আসি।

ক্যাপ্টেন (অব:) শচীন কর্মকার কবরীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধকালে কলকাতার পার্কস্ট্রীটে আমার স্বল্পকালীন অবস্থানের সময়ে কবরী চৌধুরীর সাথে আমার দেখা ও কথা হয়। আমরা পাকিস্তান সমর্থক একজন কলকাতার মুসলমানের বাড়ীতে থাকতাম, বাড়ীর মালিক জানান তাঁর বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকের বাড়ীতে কবরী চৌধুরী থাকেন। গ্রীষ্মের ভরদুপুরে প্রচন্ড গরমে একদিন কবরীর সাথে দেখা হয়, তিনি সাদা শাড়ি পরিহিতা ছিলেন এবং মাথায় ছিলো ছাতা। আমরা বিনয়ের সাথে কথাবার্তা বলি। এরপর আমি ৯নং সেক্টরে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাই। আরো পরে নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে আবার দেখা, তখন তিনি এমপি। তাঁর প্রথম স্বামী চিত্ত চৌধুরীর সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো, তিনি ব্যাংককে মারা যান, ক’বছর আগে তাঁর একপুত্র ‘অঞ্জন’ মারা যান”।

অপর এক মন্তব্যে সুমন দত্ত লিখেছেন, ‘কবরী হিন্দু ছিলেন, পরে মুসলমান হয়েছেন। তাঁর প্রথম ঘরের সন্তানেরা কানাডা থাকেন। বাংলাদেশে অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছেন এবং এঁরা বেশিরভাগ বিবাহসূত্রে ধর্ম পরিবর্তন করেছেন’। এ প্রসঙ্গে তিনি বেশ ক’টি নাম দিয়েছেন। তাঁর মতে কবরী নাকি এক সাক্ষাৎকারে শেষ ইচ্ছে হিসাবে তাঁর দুই পরিবার নিয়ে একসাথে থাকতে চেয়েছেন। দৈনিক প্রথম আলো জানায়, কবরীর আসল নাম মীনা পাল, বাবা কৃষ্ণদাস পাল ও মা প্রভা পাল। প্রথম বিয়ে চিত্ত চৌধুরীকে, বিচ্ছেদ। ১৯৭৮ সালে বিয়ে করেন সফিউদ্দিন সারোয়ারকে। ২০০৮সালে আবার বিচ্ছেদ। কবরী ৫সন্তানের মা। ‘সিনেমার মিষ্টি মেয়ে কবরী মারা গেছেন’ শীর্ষক এ সংবাদের সূত্র হিসাবে পত্রিকাটি কবরী’র পুত্র ‘শাকের চিশতী’র নাম উল্লেখ করেছে।

২০১৯-এ বইমেলায় প্রকাশিত আমার বই ‘জীবনী নয়, একটি বই প্রকাশের লক্ষ্য’ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে কবরী সম্পর্কে যেটুকু তথ্য আছে তা তুলে ধরছি: “হিন্দু নায়িকা মিনা পাল ওরফে কবরী। চটগ্রামের চিত্ত চৌধুরীর স্ত্রী মীনা পাল হলেন কবরী চৌধুরী। তারপর কবরী সরোয়ার। শেষে এমপি হতে গিয়ে দ্বিতীয় স্বামী পরিত্যাগ এবং হয়ে গেলেন সারাহ বেগম কবরী। ভিন্ন ভিন্ন স্বামীর ঘরে কবরীর সন্তানরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের”। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে বিয়ের নামে ধর্মান্তকরণ একটি ব্যাপক প্রচলিত ব্যবস্থা। বিনোদন ক্ষেত্রে এটি একশ’ ভাগ। অ-মুসলমান কেউ বিনোদন ক্ষেত্রে যেই একটু ওপরে উঠছেন, তিনিই ধরাশায়ী হচ্ছেন? কুমার বিশ্বজিৎ থেকে শুরু করে অপু বিশ্বাস পর্যন্ত, সর্বত্র একই চিত্র। মিডিয়ায় এসেছে, অপু বলছেন, ‘সাকিব তাকে জোর করে ধর্মান্তরিত করেছেন’। অপু বিশ্বাস ইসলাম ধর্মকে ভালবেসে ধর্মান্তরিত হননি, হয়েছেন শাকিবকে পাওয়ার জন্যে। অপুর ক্ষেত্রে এটাও সত্য যে, শিল্পে টিকে থাকতে বা গ্ল্যামার ধরে রাখতে তাকে কোন না কোন মুসলমান পুরুষের হাত ধরতে হতো? আর হাত ধরা মানে ধর্ম বিসর্জন দেয়া। ঢাকার ম্যুভি ইন্ডাষ্ট্রিতে হিন্দু মেয়ের সাথে মুসলিম ছেলের প্রেম এখনো উপাদেয়? উল্টোটা কিন্তু নেই?

পূর্ণিমা সেনগুপ্ত-র কথা অনেকের মনে থাকার কথা। তিনি বাংলাদেশের প্রথম হিন্দু নায়িকা, ধর্মান্তরিত হন, সেই শুরু। পূর্ণিমা সেনগুপ্ত থেকে হালের অপু বিশ্বাস-র ধর্মান্তর মোটামুটিভাবে একই প্যাটার্নের। লোভ, মোহ আছে, থাকবে, কিন্তু ধর্মান্তর? অনজু ঘোষ-র উত্থানকালে আমি ঢাকা থাকতাম। বিয়ে করলেন এক মুসলিম পরিচালককে, মুসলমান হলেন। ছাড়াছাড়ি হলো, আবার হিন্দুধর্মে ফিরে এলেন। মোল্লারা হুঙ্কার ছাড়লেন, 'একবার মুসলমান হলে আর ইসলাম ত্যাগ করা যায়না’? অরুণা বিশ্বাস বা মঞ্জুশ্রী একই পথে গেলেন। জহির রায়হান দামী ফিল্ম নির্মাতা। তিনি ধর্মান্তরিত করলেন হেনা ভট্টাচার্যকে। হেনা হলেন সুমিতা রায়হান। সুমিতা সিনেমার নাম, হেনা হলেন নিলুফার বেগম। সুমিতা দেবীর প্রথম স্বামীর নাম ছিল অতুল লাহিড়ী। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কম্যুনিস্ট। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কম্যুনিস্টদের ওপর কঠিন নির্যাতন নেমে আসলে তিনি দেশত্যাগ করেন। সুমিতা দেবী তার সাথে যাননি, কারণ ততক্ষনে তার নায়িকা হবার স্বপ্ন মনে বাসা বেঁধেছিলো।

অনেকের মতে শিক্ষার অভাব এজন্যে দায়ী। কথাটা সত্য নয়? পতৌদির নবাব মনসুর আলী খান অশিক্ষিত ছিলেন না! বাংলাদেশের জহির রায়হান ওপর তলার মানুষ। পতৌদির নবাব শর্মিলা ঠাকুরকে ধর্মান্তরিত করেছেন। শর্মিলা হয়েছেন আয়েশা সুলতানা। জহির রায়হান মুসলমান বানিয়েছেন সুমিতা দেবীকে। শর্মিলা মুসলমান হয়ে পর্দার অন্তরালে চলে যান? জহির রায়হান কিছুদিন পর সুমিতাকে ফেলে কোহিনুর আক্তার সুচন্দাকে বিয়ে করেন। সমাজের নিন্মস্তরে হয়তো শিক্ষার অভাব কিছুটা দায়ী, বাস্তবতা হচ্ছে, ধর্মান্ধতা ও জবরদস্তি এর মুখ্য কারণ। সমস্যা হলো, বাংলাদেশে বিষয়টি একপেশে। অর্থাৎ ধর্মান্তর শুধুই ওয়ান ওয়ে, ইসলামীকরণ। বলিউডে এটি ডবল ওয়ে। শাহরুখ খানের স্ত্রী হিন্দু, গৌরী। সাইফ আলী খান বিয়ে করেছেন কারিনা কাপুর-কে। সঞ্জয় দত্তের স্ত্রী দিলনেওয়াজ শেখ। ঋত্বিক রোশন-র বউ সুজানা খান। সুনীল শেঠীর স্ত্রী মুসলমান মানা শেঠি বা রাজ্ বাব্বরের স্ত্রী নাদিরা বাব্বর। কলকাতায় মৈত্রিয়ী দেবীর বাড়ীতে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিলো জয়শ্রী-আলমগীর -এর। বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে এমন একটি ঘটনা কি আছে? নেই? কেন নেই? কারণ, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র সেটি হতে দেয়না। পাকিস্তান বা মুসলিম বিশ্বে তো এই প্রশ্নই ওঠেনা?

একটি ছেলে, একটি মেয়ে সম্পর্ক হতেই পারে, কিন্তু ধর্মান্তর কেন? ধরা যাক, দুই ধর্মের দুই পাত্রপাত্রীর মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠলো। বিয়ের পালা। ধর্ম তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। সমস্যা বাঁধে পাত্র-পাত্রীর একটি পক্ষ মুসলিম হলে; সেখানে অন্যপক্ষকে মুসলমান হতে হয়। এটা জবরদস্তি। এখানে ধর্মকে ভালবেসে কেউ ধর্মান্তরিত হচ্ছেন না। আকর্ষণটা ধর্মের নয়, অন্যত্র। চাহিদা ধর্মের নয়, দেহের। প্রশ্ন উঠতে পারে, ছেলে-মেয়ে কাউকে ধর্ম ত্যাগ করতে হবে কেন? আর যদি করতে হয়, তাহলে একজনকে কেন? দু’জনকে নয় কেন? প্রায়শ: দেখা যায়, মেয়েটি ধর্ম ত্যাগ করছে। এতে মেয়েটির ভালবাসার প্রমান হলেও ছেলেটি’র ভালবাসার প্রমান হয়না। ভালবাসার জন্যে ধর্মান্তর-কে কি ভালবাসা বলা যায়? দু’জনের ভালবাসার মধ্যে যদি ধর্ম বড় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটা আর যাই হোক, ভালবাসা নয়! দু’জন যদি সত্যি একে অপরকে ভালোবাসেন তবে উভয়ে ধর্মত্যাগ করে তৃতীয় ধর্ম গ্রহণ করলে হয়তো কিছুটা যৌক্তিক হতে পারে। কিছুদিন আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, স্ত্রীকে স্বামীর ধর্ম পালন করতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বাংলাদেশে বা পাকিস্তানের আদালত কি এমন কথা বলতে পারে? সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত বলেছেন, ভিন্ন জাতি বা ভিন্ন ধর্মে বিয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। এই ধরণের কথাবার্তা আমাদের দেশে শোনা যায়না? তবে সদ্য জেএনইউ ইউনিভার্সিটির এক মুসলিম নারীনেত্রী বলেছেন যে, হিন্দু ছেলেদের মুসলিম মেয়েদের বিবাহের অধিকার থাকতে হবে। ব্যস, তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার পর ফতোয়া ঝুলছে। ভারত একসময় অন্ত:ধর্ম বিয়ে উৎসাহিত করেছিলো, হয়তো আশা ছিলো এরফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার সম্পর্ক ভালো হতে পারে। তা হয়নি।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test