E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অপ্রাপ্তিতে ভরপুর নয় স্বাধীনতার ৫০ বছর 

২০২১ এপ্রিল ১৯ ১৩:১৪:৫৮
অপ্রাপ্তিতে ভরপুর নয় স্বাধীনতার ৫০ বছর 

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার 


দীর্ঘ আন্দোলনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা পেয়ে আজ বিশ্বের দরবারে স্বাধীন বাংলাদেশটি তার পতাকা তোলে ধরতে পেরেছে। এক সময়ের তলা বিহীন ঝুঁড়ি আজ বিশ্বের রোল মডেল। আন্তর্জাতিক অনুদান নির্ভরতা ২% এ নেমে এসেছে। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা ।

সারা পৃথিবীর মানুষ চেয়ে দেখছে বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের কর্মকান্ড। স্বাধীনতার ৫০ বছর আর বঙ্গন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী পালন হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। এই হিসেবে আজ এটা অনেক বড় পাওয়া। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) তিনটি সূচক যাচাই করে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সূচকগুলো হচ্ছে ১. মাথাপিছু আয় ২. মানবসম্পদ সূচক ( স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাতৃমুত্য ও শিক্ষার হার, স্কুলে ভর্তিরহার এবং মাধ্যমিক স্তরে ভর্তিতে লিঙ্গসমতার হারের সম্বনয়ে তৈরি করা ) ৩. অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক ( যেটি অর্থনীতিতে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতের অবদান, আন্তর্জাতিক বাজারের দূরত্ব, পণ্যদ্রব্য রপ্তানির ঘনত্ব, পণ্য ও সেবা রপ্তানির অস্থিতিশীলতা, নিচু উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যার হার, শুষ্কভূমিতে বসবাসকারী জনসংখ্যার হার, কৃষি উৎপাদনে অস্থিতিশীলতা এবং দুর্যোগের শিকার এমন জনসংখ্যার হারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়) বিশ্লেষণ করলে দেশের সামগ্রিক চিত্রটি চলে আসে।

উন্নয়নশীল দেশ বলতে সেসব দেশকে বুঝায় যেসব দেশে কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে উন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। যারা বিভিন্ন সময় এদেশকে ভিন্ন চোখে দেখেছে আজ তারা অবাক চেয়ে রয়ে এদেশের উন্নয়নের রুপ দেখে। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যা করে এদেশের অর্থনৈতিক গতিকে রুখে দেওয়ার জন্য এদেশের বিরোধী অপশক্তিরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ছিলো। কিন্তু এসব অপশক্তিকে রুখে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে এবং এ অর্জন জাতি হিসেবে অনেক আনন্দের।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটি হয় প্রায় ৭শ ৭৬ কোটি টাকার যে বাজেট বর্তমানে দাঁিড়য়েছে প্রায় ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এ যেন স্বপ্নকে হার মানিয়েছে। চলতি এ করোনাকালেও এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো রয়েছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। বর্তমানে এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। অর্থনৈতিক খাত গুলোকে যদি আমরা আলাদাভাবে দেখি তাহলে হলফ করে বলা যায় উন্নতির মানচিত্র সামনের দিকে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে।

কৃষি ভিত্তিক বাংলাদেশের কৃষিতে উন্নতিটা আরো চমকপ্রদ। জিডিপিতে যার অবদান ১৩.৬ শতাংশ। বিশেষ করে ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। স্বাধীনতাকালীন সময়ে ৭ কোটি মানুষ থাকার সময়ও তিন বেলা খেতে পারেনি অথচ ১৭ কোটি মানুষের দেশে আজ খাদ্য উদ্বৃত্ব হচ্ছে। অথচ আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ব্যাপক ভাবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এতটা এগিয়ে না গেলেও একেবারেই দুর্বল অবস্থানে নেই। গ্রামে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য। চলতি করোনা কালেও দেশের স্বাস্থ্য সেবা খাত ভালো ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুহার ৫.৪ শতাংশ হার কমেছে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তৎপরতার কারণে বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে এখন ১.৩৭% দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতের এসব সফলতার কারণে প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি আর্ন্তজাতিক পুরষ্কার লাভ করেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। এব্যবস্থায় বিশেষ করে সড়ক পথে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। নৌপথ কমে আসায় নৌ ব্যবস্থা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। আকাশ পথে যতটুকু উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তা অনেকটাই মলিন আর রেল ব্যবস্থায় অনেকটাই বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে।

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে যা প্রশংসার যোগ্য। চলতি বছরে এখাতে বরাদ্ধ রয়েছে ৯৫ হাজার ৫শ ৭৪ কোটি টাকা। এখাত গুলো থেকে দিনদিন সুফল ভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বয়ষ্কভাতা, বিধবাভাতা, মাতৃত্বকালীনভাতা, শিশুদের জন্য ভাতা, প্রতিবন্ধিভাতা উল্লেখযোগ্য। মানুষের মৌলিক অধিকারের মতো অন্যতম হলো শিক্ষা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর শিক্ষা ক্ষেত্রে আরো সফলতার প্রয়োজন ছিল। তবে কাজ হয়নি একথা বলা যাবে না। কেবল মাত্র প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ এবং একাডেমিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমেই শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। দীর্ঘদিনেও শিক্ষার একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা হয়নি। বিশেষ করে বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ভালো উন্নতি সাধিত হয়েছে একথা বলা যেতে পারে। বিশেষ করে স্কুলে ভর্তির হার বেড়েছে ব্যাপকভাবে এবং অনেকাংশেই রোধ হয়েছে ঝড়ে পড়া । এখন সময় হয়েছে শিক্ষার মানোন্নয়ন। শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে না পারলে শিক্ষার এ বিনিয়োগ হবে অর্থহীন এবং মুখ থুবড়ে পড়বে শিক্ষা ব্যবস্থা। আর বিশেষ করে কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের দিকে ধাবিত হলে জাতির যে বিনিয়োগ সেগুলি অর্থহীন হবে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আমাদের মতো দেশে যে সম্প্রাসারণ হয়েছে তা অবশ্যই সফলতার দাবী রাখে।

ইতোমধ্যে প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। এক সময়ের বিদ্যুতের লোড শেডিং মানুষের জীবনযাত্রাকে বিষিয়ে তোলেছিল এখন সেখান থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশ ভালো করেছে। সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। বর্তমানে এখাতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ যুক্ত রয়েছে। এ খাতে সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দেশের তরুণ প্রজন্ম এখান থেকে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবে অনেক বেশি। তৈরি পোষাক খাতে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে অত্যন্ত সুদৃঢ়। গত অর্থ বছরে ৯শ ৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী ৩৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষ কাজ করছে এ খাতে। জিডিপিতে বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ১১দশমিক ১৭ শতাংশ। নারীর ক্ষমতায়নে তৈরি পোশাক খাত একটি ভালো ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের আরেকটি আয়ের অন্যতম খাত হলো প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অর্থ উপার্জন। বিদেশে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি অবস্থান করছে। তাদের আয় এদেশ বির্নিমাণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। গত অর্থবছরে করোনাকাল চলার সময়েও ১৮দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে রেল লাইন স্থাপন, চট্রগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন রেললাইন নির্মাণ, আখাউড়া- লাকসাম মিশ্রগেজ ডবল লাইন নির্মাণ, পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক এবং রুপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে।

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘ তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে চলছে। কিন্তু আজ তার দেশ থেকে যেখানে জাতিসংঘ অবস্থিত সেখান থেকেই ঘোষণা হবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেক। এ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে, যা এখন অনেক দেশের কাছেই রোল মডেল। স্বাধীনতার শুরু থেকে এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে কেবল মাত্র দেশেই নয় বিশ্ব দরবারেও প্রশংসা চলছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে আজ অনেক দেশই হতবাক। এধরনের একটি প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত দেশ যেভাবে তার অবস্থানকে সুসংহত করেছে তা যেকোন দেশের জন্যই দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়। মানব উন্নয়ন সূচকে গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচীর ২০২০ সালের দ্য হিউম্যান ডেভেলমেন্ট প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয় ও সম্পদের উৎস, বৈষম্য, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও আর্থিক প্রবাহ, যোগাযোগ, পরিবেশের ভারসাম্য ও জনমিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করা হয়। এসব সূচকে উন্নতি হলে দেশের উন্নয়নের চিত্রই ফুটে উঠে। বর্তমানে প্রায় ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। যা অর্থনীতির সক্ষমতার বর্হিপ্রকাশ।

তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক আক্ষেপের জায়গাও তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার অভাব, শোষক শ্রেণির দৌরাত্ম, সম্পদের অসম বন্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলোতে রাষ্ট ও সমাজ সফলতা ধেখাতে পারেনি। যার ফলে ভবিষ্যত প্রজন্ম স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং স্বাধীনতার প্রতি একটা ভিন্ন মনোভাব দেখাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে পথ দেখাতে হবে দায়িত্বশীল মানুষদেরকে। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আগামী প্রজন্ম হতাশায় নিমজ্জিত হবে তেমনি মুক্তিযোদ্ধের প্রজন্মরাও এ দায়ভার এড়াতে পারবে না। তরুণ প্রজন্মকে যদি সঠিক পথ না দেখাতে পারি তাহলে বদ আসক্তিতে হারিয়ে যাবে যুব সমাজ। তখন রাষ্ট্র ও জনগণ স্বাধীনতার সুফল পাবে না। তাই বর্তমানের উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে ধরে রেখে অর্জন না করতে পারা ভুলগুলো সংশোধন করে হীরক জয়ন্তী পালন করবে এ হচ্ছে সমাজের প্রত্যাশা।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test