E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিক্ষার সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা 

২০২১ মে ০৫ ১৫:৪৩:৩৪
শিক্ষার সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা 

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের বিতর্ক যুদ্ধ বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এমনকি এ বিষয়টি নিয়ে আদালত পর্যন্ত যাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি আমরা হয়তো ভুলে গেছি বা যাচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দ্বারা যে প্রশ্নের তৈরি হয়েছে তা কেন ঘটলো বা তার সমাধান কি ? এটা কি কোন নিছক ক্ষণস্থায়ী বিষয় ? এসবের কারন অনুসন্ধানে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন রয়েছে।

তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব বিষয় নীতিহীন শিক্ষার বর্হিপ্রকাশ। যারা তর্কে জড়িয়েছেন তারা অবশ্যই দেশের নামীদামী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করেছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেসব ভাষায় এক জন আরেক জনকে হেনস্তা করেছে তা কোন শোভনীয় কাজ হয়নি। ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। ভুল বোঝাবুঝিটা সুন্দরভাবে সমাধান করা যেত। ইত্যে সময়ে আমার মনে হয় বা দেখে আসছি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে বেশিরভাগ মানুষই আইন ভাঙ্গতে পছন্দ করেন বা করে থাকে। এটা অনেকেই ক্রেডিট মনে করে থাকেন। এবং সবাই ক্ষমতার ব্যবহার দেখাতে চায় এবং ক্ষমতাসীন হতে চায়। কিন্তু কেন ? এর দুটো দিক থাকতে পারে। একটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে সামাজিক শিক্ষাটা অর্জিত না হওয়া এবং অন্যটি হলো রাষ্ট্র আইন ভাঙ্গা ব্যক্তিদের সাহায্য করা ও ক্ষমতার ছায়াতলে রাখা।

অপরাধী ব্যক্তিরা যখন অধিক ক্ষমতা ভোগ করে এবং রাষ্ট্র তার পিছনে দাঁড়ায় তখন এসব মন মানসিকতার জন্ম নেয় মানুষের মাঝে স্বাভাবিকভাবে। সম্প্রতি যে ঘটনাটি মানুষের চোখে এসেছে তা থেকে মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ এ থেকে তেমন একটা হতবাক হয়নি। কারন এসব ব্যবহারের সাথে আমরা প্রতিনিয়ন সম্পৃক্ত হচ্ছি। এখন তিন রাস্তা একসাথে হওয়াতে বিষয়টা বড় হয়েছে এবং মানুষের অন্তরের খোড়াক হয়েছে। তবে এ বিষয় গুলি যে রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অপরাধকারীদের অপরাধের সাজা এক হলেও অপরাধী ক্ষেত্র বিশেষে অপরাধটা মানুষের অন্তরে রেখাপাত করে।

সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে আমরা যে ব্যবহার পেয়ে থাকি তর্কে জড়ানো ব্যক্তিদের কাছ থেকে নিঃসন্দেহে আমরা সে রকম প্রত্যাশা করি না। আমি আগেই বলেছি তর্কে জড়ানো ব্যক্তিরা অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষিত। মনে প্রশ্ন রয়ে যায় এ সর্বোচ্চ শিক্ষা আমাদের কি উপহার দিচ্ছে ? আমরা কি কেবলই টাকার রোজগারের জন্য এ শিক্ষা অর্জন করছি ? তাহলে শিক্ষার সামাজিক দায়বদ্ধতা কোথায় হারিয়ে গেল ? সভ্যতা দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সে শিক্ষায় সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকবে না এটা হতে পারে না। প্রত্যেকটা অভিভাবক তার সন্তানকে প্রতিনিয়তই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যেকটা পেশার ক্ষেত্রে মানবিক বিষয়গুলি আসলেও সে গুলি রয়ে যাচ্ছে পর্দার পিছনে। ঘটে যাওয়া বিষয়টির সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চলে এসেছে অনাকাঙ্খিত ভাবে। লক্ষ করলে দেখা যায় তিনটি পক্ষই রাষ্ট্রের ক্ষমতার উঁচু স্তরে রয়েছে তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কেন ভাঙ্গানো প্রয়োজন। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিয়ে তারা কি নিজেকে আরো শক্তিশালী করে তোলতে চাইছে ? তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অথেই যারা মুক্তিযোদ্ধে গিয়েছিলেন তারা কি এমটা চেয়েছিলেন ? আমার মনে হয় না। এই ঝগড়া শিক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

প্রত্যেকটি পেশার ক্ষেত্রেই সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি যদিও গুরুত্ব সহকারেই নেওয়া উচিৎ কিন্তু হচ্ছে না। কারন কি সেটা সবারই অজানা তবে ভুক্তভোগী সবাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অর্থ কামানোর নেশায় সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি নিচে চলে যাচ্ছে। অনেকই মাধ্যমিকে পড়ার সময় ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের বিনামূল্যে সেবা করার বাসনা রচনায় লিখেছে কিন্তু ডাক্তারি শেষ করার পর বিসিএস দেওয়ার সময় সামনে চলে আসছে প্রশাসন কিংবা পুলিশ । কেউ কেউ আবার বিদেশ পাড়ি দেওয়ার জন্য ভিন্ন পথও অবলম্বন করছে বা পাড়ি দিচ্ছে। বুয়েট থেকে সদ্য পাস করা ছাত্রটি পুলিশ হবার স্বপ্নও দেখছে। যদিও এসব হবার ক্ষেত্রে নিয়মের কোন বাঁধা নেই বা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এসব হওয়ার পিছনের উত্তরটা রাষ্ট্রের জানা জরুরি এসব বিবাদ মেটানো এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি শক্ত করার জন্য।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অতুলনীয়। এটার সাথে অন্য কোন বিষয়কে এক করা কোনভাবেই কাম্য নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এদের অবদানকে এসব বিষয়ের সাথে মিলালে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান খর্ব হয় এটা আমাদের মাথায় রাখা জরুরি। রাষ্ট্রের অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো অপরিহার্য এবং সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না । আবার মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেটাকে ধরে রাখবে সেটাও এদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। না হলে সম্মানকারীরা অনেক সময় মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে এটা ভুলে গেলে চলবে না। তর্কের ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে যে দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছে সে দিক থেকেই ফলাফল পেয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্লেষণের ফলাফলটা ভালো আসেনি। যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত। প্রত্যেকের কর্মক্ষেত্র আলাদা। প্রত্যেকেই নিজেদের কর্ম করে থাকে। কারো কর্ম বড় ছোটর প্রশ্ন নয়। আলাদা কর্মের ফলাফল আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। এই বিষয়টি অনেকের মনে সন্দেহ হয়েছে যে নিছক রাগের মাথায় এই ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। তবে বিষয়টি এ বিশ্লেষণ পাওয়ার যোগ্য নয় বলেই মনে হয়। কারন আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রায় প্রত্যেকটি শিশু এ মনোভাব নিয়েই তার জীবনকে সামনের দিকে নিয়ে এগিয়ে চলছে বর্তমান সময়ে। মনের দিক দিয়ে বড় না হয়ে বেশি বেতন, ক্ষমতা বা বড় চাকুরির দিকে ঝুঁকছে। যার ফলে সবার মধ্যে বাসনা জন্ম নিয়েছে অর্থে বিত্তে বড় হতে হবে। এটাই হচ্ছে বর্তমান শিক্ষা বা চাকুরির বাজারের অবস্থা। কিছু যে ব্যতিক্রম নয় তা কিন্তু না। তবে তা খুব নগণ্য। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা আমাদের সন্তানদের সত্যিকার অর্থে বড় হওয়ার শিক্ষাটা দিতে পারছি না।

বর্তমান করোনা কালে জাতির যখন মুমূর্ষ অবস্থা সেখানে রাষ্ট্রের বড় তিনটি বিভাগের মধ্যে এরকম বড় থাকার লড়াই জাতিকে ভাবিয়ে তোলছে। এ ঘটনা যতই ধাপাচাপা দেওয়া হউক না কেন অন্তরের বিভাজন দূর করা অনেক জটিল যদি না গোঁড়ায় সে ভাবটা জাগিয়ে না তোলা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টা সামনে এনে জাতির কাছে বিষয়টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনজনই যেহেতু তাদের বাবাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করেছেন সেখানে বিষয়টা অনেকটাই হাস্যরসে পরিণত হয়েছে। সাধারণ জনগণের মাঝে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি রেখাপাতের জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা এ রকম কিছু আশা করতে পারি না বা উচিৎ নয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আলাদা তাদের নিয়ে ক্ষমতা দেখানোর মতো কিছু নেই। কারন ক্ষমতা দেখালে অনেক সময়ই সম্মানের জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। যারা বেশি ক্ষমতা দেখান বা দেখানে চান তারা সাধারণ মানুষের কাছে সম্মানিত থাকেন না বরং সাধারণ মানুষের হাস্যরসে পরিণত হন। সবচেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষা ও চাকুরি ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন না হলে মানুষ ক্ষমতা ও অর্থের দিকেই ধাবিত হবে। ভবিষৎত প্রজন্ম বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাবে। ফলে এরকম ঘটনা বা এর চেয়ে বড় ঘটনা প্রায় সময়ই ঘটবে এবং ফলাফলও ভালো হবে না।

রাজনীতি হবে রাজনীতির জায়গায়। বর্তমানে রাজনীতি যেভাবে সকল স্তরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেটা কোন ভালো লক্ষণ হতে পারে না। শিক্ষায় মানবিক দিক বেশি গুরুত্ব দিয়ে সৃজনশীল সমাজ বির্নিমাণ করতে হবে। এবং ভবিষৎতের জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যেতে হবে বর্তমান প্রজন্মকে। না হলে তার দায়ভার আমাদেরকেই বহন করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের সবাইকে একটা বিষয়ে একমত হতে হবে যে ভবিষৎত প্রজন্মকে বড় না করে মানুষ করতে হবে। তাহলে মানুষের মাঝে জন্ম নিবে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এসব বিষয় আর সামনে আসবে না। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় সবচেয়ে বেশি কারন রাষ্ট্র শিক্ষা কাঠামোকে এভাবে গড়ে তোলতে পারছে না। আর আলোচ্য অংশের আরেকটি বিষয় মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি। ছোটখাট বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি সামনে চলে আসলে তা জাতির জন্য অবশ্যই লজ্জার। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test