E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিবলী নোমানের খোলা চিঠি

২০১৪ সেপ্টেম্বর ০৮ ২০:২৩:২৩
শিবলী নোমানের খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আমার পরিবারটাকে বাঁচান
প্রিয় সহকর্মীরা, আমার পাশে একটু দাঁড়ান
প্রিয় জনতা, একটু এগিয়ে আসুন।

সম্ভবত ২০০১ সালের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় ৭ সাংবাদিকের ছাত্রত্ব বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রক্টোর। তার মধ্যে আমিও ছিলাম। মোটেই ভয় পাইনি, বুক চিতিয়ে লিখিত জবাব দিয়ে এসেছিলাম সবাই মিলে।

২০০২ সাল থেকে জঙ্গিদের নিয়ে প্রতিবেদন লিখতে থাকলাম। আমি তখন আজকের কাগজে। অনেকেই হেসেছেন। বলেছেন, এখানে আবার জঙ্গি এলো কোত্থেকে। ২০০৪ সালের পর থেকে তো বাংলাভাইয়ের সেই দুঃসহ সময়টা কাটিয়েছি জান হাতে নিয়ে মাঠেই। আমার অন্য সহকর্মীদের পিছু পিছু ছুটেছি খবরের সন্ধানে। অনেক বাধা, অনেক কিছু। তবু মোটেই ভয় পাই নি।

নাটোরে গামাহত্যার পর দুলুর বাহিনী শাহপাড়া জ্বালিয়ে দিলো। ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে নিউজ কাভার করে ফিরতে গিয়ে ধরা পড়লাম বাসুদেবপুরে, যুবদলের হাতে। আটকে রাখলো আমাকে আর ফটোসাংবাদিক জুলু ভাইকে। বুক একটুও ঢিপঢিপ করে নি।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর বনপাড়া খ্রিস্টানপল্লি যখন জ্বালিয়ে দিলো সরকারি দলের পাণ্ডারা, সেই মান্দার পালপাড়া উজার করলো, ছুটে গিয়েছিলাম আমিও সহকর্মী বড়ভাইদের সঙ্গে। রাস্তা বাদ দিয়ে ক্ষেতের পথে মোটরসাইকেলে করে যেতে হয়েছে সশস্ত্র ক্যাডারদের এড়িয়ে। তবু শক্তি হারাই নি।
পরের বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মোড়ে মোড়ে লাঠি হাতে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন যখন ভোটার ঠেকাতে ব্যস্ত, তখনও তা কাভার করতে গিয়েছি। তাড়া খেয়েছি। এতোটুকু টলি নি।
২০০৬ সালে সাহেববাজারে অস্ত্র উঁচিয়ে ছাত্রদলের এক কর্মীর গুলি ছোঁড়ার ছবি ও প্রতিবেদন ছাপার কিছুদিনের মধ্যেই তাদের চাঁদাবাজির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আক্রান্ত হয়েছি নিজের অফিসেই। সাহস হারাই নি সেদিনও।

এক এগারোর সরকারের আমলে আগস্ট ছাত্র বিক্ষোভের পর যখন শিক্ষকদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছিলো, তখন একের পর এক স্টোরি করেছি। প্রতিদিনই নানা বাধা এসেছে। কিছুই মানি নি।
কারণ, বাবা-মা’র অমতে যেদিন সাংবাদিক হয়ে ওঠার জন্য গণমাধ্যমে পেশা খুঁজে নিয়েছিলাম, সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যা কিছুই হোক, সাহস হারাবো না। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই আমি ভয় পাচ্ছি। তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করছে আমায়। আমি অসহায় বোধ করছি। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার ছোটবোন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। রাজশাহীতে আমার বাসাতেই থাকে। ফেসবুকে একটি পেজে আমার বাসায় তোলা একটি ছবি থেকে ওর মাথাটুকু নিয়ে একটি নগ্ন নারীর শরীরের সঙ্গে ফটোশপে জুড়ে দিয়ে প্রোফাইল ছবি বানানো হয়েছে। হঠাৎ করেই এই পেজটি থেকে সমানে সবার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হচ্ছে। পেজের সব তথ্য আমার বোনের তথ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এমনকি তার নামটিও ব্যবহার করা হয়েছে। আমি এখনো জানি না, কে বা কারা, কী উদ্দেশ্যে এমন ঘৃণ্য কাজটি করলো।

আমার বাবা, সরকারি চাকরির শেষ পর্যায়ে এসেছেন। মানুষ হিসেবে সারাজীবন তিনি নিজে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাননি। আমাকে আজীবন শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো ঝামেলায় না জড়ানোর। আজ আমার বাবা প্রায় শয্যাশায়ী। মা-ও তাই। আমার বোনটা বারবার বলছে ‘বেঁচে থেকে কী লাভ?’ জানি না, ওর পরিণতিটাই বা কী হয়।

এমন পরিস্থিতিতে গুছিয়ে লেখা সম্ভব নয়। পারছিও না। হঠাৎ করেই যেনো আমার পুরো পৃথিবী মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে। এমন অনেক ঘটনার খবর দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তুলে আনতে হয়েছে এই আমাকেই। আর আজ আমিই তেমন একটি ঘটনার শিকার। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। তবে যেভাবে আমি প্রতিবেদক হিসেবে মানুষগুলোকে সাহস জোগাতাম, এগিয়ে আসতে বলতাম, সেভাবেই আমি নিজেও এগিয়ে এলাম। কারণ, আমি জানি, দুর্বত্তায়ন রুখতে হলে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। আমার পরিবার কোনোভাবেই বিষয়টি প্রকাশ হতে দিতে চায় না। কিন্তু আমি গোপন রাখতে চাই না। আজ যদি আমি গোপন রাখি, কাল আরো কারো সঙ্গে এই কুলাঙ্গারের দল একই কাজ করবে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর আমার আস্থা আছে। আস্থা আছে জনতার শক্তির ওপর। কাজেই দুবৃত্তদের বিরুদ্ধে আমি লড়তেই চাই। বিটিআরসির ইমেইলে আমি লিখিত অভিযোগ করেছি। আগামীকাল থানায় একটি মামলা বা জিডি যেটাই হোক করবো। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকে আমি আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। উনি ধরেন নি। ফোন ব্যাক করারও সময় পান নি। তা, না পাক। ব্যস্ত মানুষ তিনি এখন। তবে আমি এর শেষ না দেখে ছাড়বো না।

দীর্ঘ এই লেখাটির আরেকটি উদ্দেশ্য আছে। ফেসবুক পেজটিতে আমার ও আমার স্ত্রীর নাম পরিচয় ব্যবহার করার বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। স্রেফ সন্দেহ, হয়তো আমার পেশাগত কাজে ক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ ফেসবুকের এই ঘটনাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত বেশ কিছুদিন ধরে কিছু ঘটনা সেলুলয়েডের মতো আমার সামনে ভেসে উঠছে। আমার বাসার ল্যান্ডফোনে রহস্যজনক ফোন কল আসতো। কখনো ফোন ধরে কথা বলতো, কখনো বলতো না। আমার স্ত্রীকে আজেবাজে কথা বলতো। এরপর শুরু হলো আমার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন দেয়া। আমি তখন সমকালে। সেই সময় একদিন তো মুক্তিযুদ্ধ উৎসব আয়োজন করতে চাওয়ায় আমার গলা কেটে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়েছিলো। আরো সব ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোকে আমি এতোদিন বিচ্ছিন্ন ভেবেছি। কিন্তু আজ ফেসবুক পেজের এই ঘটনার পর আমার সন্দেহ, কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিকল্পিত উপায়ে আমার পারিবারিক জীবন ধ্বংসের মাধ্যমে আমার পেশাগত জীবনটিও নষ্ট করতে চায়। আমার চোখের সামনে আমার বোন আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালিয়েছে। আমরা সামলেছি। আমার বাবা-মা বাকরুদ্ধ। বারবার প্রশ্ন করছে, কেন? আমরা কাদের ক্ষতি করেছি যে এমন শাস্তি? আমার ৯ বছরের ছেলেটা তার মুক্তিযোদ্ধা নানাকে হারিয়েছে। কদিন আগেই তার নানীকেও হারিয়েছে। এখন দাদা-দাদীকে এমন অবস্থায় দেখে ও স্থির থাকতে পারছে না। আমার স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিতে হয়েছে।

আর আমি? না, একদমই ভেঙে পড়ি নি। কষ্ট পাচ্ছি, যখন কেউ বলছে, এর চেয়ে বাইরে চলে যাওয়া ভালো ছিলো। কেন বাইরে যাবো আমি? এ রাষ্ট্র আমার। গুটিকয় শয়তানের বাচ্চার জন্য কতো প্রজন্ম অভিমান করে দেশ ছেড়ে থাকবে? তাহলে এই রাষ্ট্রটাকে গড়ে তুলতে কাজ করবে কারা? চোখের জলে কী-বোর্ড ভিজে যাচ্ছে, অপমানে গা জ্বলছে, তা হোক। কিন্তু আমি আমার মাতৃভূমি আর তার বুকে আগলে রাখা মানুষগুলোর ওপর আস্থা রাখি। অনেকেই আমাকে ঢাকায় চলে যেতে বলেছে। যাই নি। বলেছি, সবাই যদি ঢাকায় যায়, তাহলে বাইরের কী হবে? আমি রাজশাহীকে বেছে নিয়েছি কাজের জায়গা হিসেবে। চেষ্টা করেছি একটি প্রজন্ম সবাই মিলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পরতে। আমি এমনই থাকবো। এই রাষ্ট্র আমার। হতে পারে, অনেক আকাঙ্ক্ষা এখনো পূরণ হয় নি। কিন্তু তাতে কী? সংগ্রামটা তো জারি রাখা চাই। এই সংগ্রাম রিলে রেস। মারা যাওয়ার আগে যতোদূর এগিয়ে যাবো, ততোদূর থেকে স্টিকটা আমাদের সন্তানদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবো। আমরা হয়তো দেখবো না, কিন্তু একদিন আমার রাষ্ট্র আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষায় বিনির্মিত হবে। আর সেই রাষ্ট্রে, সেই অপরূপ সুন্দর সোনার বাংলায় ফেসবুকে যারা আমার বোনের মুখের সঙ্গে নগ্ন ছবি জুড়ে দিয়ে আমাদের নগ্ন করতে চেয়েছে তাদের ঠাঁই যেনো না হয়, সে জন্যই এই লেখাটি লিখতে বসা। আমি লড়তে চাই। আমি সবাইকে আমাদের পাশে চাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি সাংবাদিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৪ বছরে ৪ বার আপনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার খুব মনে আছে, আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আপনি বিদেশিদের সঙ্গে একটা বৈঠক সারতে আধাঘণ্টা পরে এলেন। এসেই রসিকতা করে বললেন, ‘এতো দেরি করে? সেই কখন থেকে বসে আছি!’ আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। মানুষ হিসেবে আপনার ভেতরের যে মানবিক চেহারাটি দেখেছি, সেটার সঙ্গে আমি অন্যকিছুকে মেলাতে চাই না। কারণ মনে আছে, আমি যখন রাজশাহীর প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছিলাম, তখন আপনি আমাকে বলেছিলেন, আপা বলবে। প্রিয় আপা, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে আপনার দলের কোনো অসৎ মানুষের অপকর্ম তুলে এনেছি। যদি আবার ঘটে আগামীতে, আবার আনবো। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই আমি সব সময়। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত লড়াই থেকে কেউ কি আমাদের ফেরাতে পেরেছে? পারে নি, পারবেও না। আমি জানি, আমাদের সেই সোনার বাংলা গড়ার রিলে রেসের ট্র্যাকে আপনিও আছেন। তাই আমার পরিবারটাকে বাঁচানোর কথা বলে আসলে আমি চাই, আমরা আজ যাদের হাতে আক্রান্ত, যারা ফেসবুকে আমাদের নগ্ন করতে চায়, তাদের একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। তাদের খুঁজে বের করা হোক। দেশের আনাচে কানাচে প্রতিদিন এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। কেউ সাহস করে মুখ ফুটে বলে না। এগিয়ে আসে না। নারীদের নাকি বিয়ে হয় না এসব প্রকাশ পেলে। আর সেই সাহসে অপশক্তি এটাকেই বড় অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে। এই অস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে হবে, আপা। আজ আমার বোনের সঙ্গে, আসলে আমার পুরো পরিবারটার সঙ্গে যা ঘটছে, তা যেনো ভবিষ্যতে আর কারো ক্ষেত্রে না ঘটে।

আমি জানি, সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা আমার সব সহকর্মীকে আমি এই দুঃসময়ে পাশে পাবো। সব গণমাধ্যমকর্মীর ভরসার হাত থাকবে আমার কাঁধে, আমি জানি। আর বাংলাদেশের মানুষ যে আস্থার প্রতিদান দিতে জানে, তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। আমি মানুষেই আস্থা রাখি। তারাই আমায় ডাক দিয়ে যায়। জয় হোক বাংলার মানুষের।

শিবলী নোমান।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test