E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ ও অতীতের ঈদ-পূজার অভিজ্ঞতা

২০২১ নভেম্বর ১০ ২৩:১৪:৩০
আজ ও অতীতের ঈদ-পূজার অভিজ্ঞতা

রণেশ মৈত্র


দুর্গোৎসব, ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা, লক্ষ্মী-সরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবাদি ঠিক ঠিক কবে দেখছি-আজ ৮৯ বছর বয়সে পদার্পণ করে কবে থেকে এই উৎসবাদি দেখে আসছি তা ঠিক মত স্মরণে আনতে পারছি না। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাল্যকাল থেকেই, যখন গ্রামে বাস করতাম, তখন থেকেই দেখার শুরু এবং আজও তা দিব্যি অব্যাহত আছে। তবে বিগত দুটি বছর করোনার মহামারীতে আমি বা আমরা পারিবারিকভাবে প্রতিমা দর্শনে বের হতে না পারলেও, দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি যথাসম্ভব মেনে হাজার হাজার পূজার আয়োজন করেছেন মূর্তি তুলে ঠিক আগের মতই অন্তত: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার সর্বত্র। তবে আমরা ভাবছি, যেহেতু দেশটাতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু পূর্বাপেক্ষা যথেষ্ট কমেছে এবং কমার প্রক্রিয়া অব্যহত রয়েছে তাই পরিবারের কেউ কেউ হয়তো বা আমাকে বাদ রেখেই তার সবই কাঁচা এবং সরু। যানবাহন বলতে বুঝাতো গরুর গাড়ী ও মহিষের গাড়ী। গ্রামে তখনও ঘোড়ার গাড়ী চলাচল করতে দেখি নি। এসব সত্বেও গ্রামের পর গ্রামকে উৎসব মুখরিত হয়ে থাকতে দেখেছি, বিশেষ করে দুর্গোৎসব, বিজয়া লক্ষ্মীপূজা ও দুটি ঈদের দিনে। গ্রামে তখন বৌদ্ধ ও খৃষ্টানরা তেমন একটা বসবাস না করার ফলেই বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও বড় দিনের উৎসবের আমেজ আদৌ অনুভব করার সুযোগ পাই।

প্রতিমা নেই অথবা সংখ্যায় অত্যন্ত কম হওয়া সত্বেও বেশী উৎসব মুখরিত গ্রামঞ্চল কীভাবে হতো? দেখেছি দূর দেশ থেকে যেমন কলকাতা, বোম্বাই (হালে মুম্বাই) মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পূজা উপলক্ষ্যে শত শত আত্মীয়স্বজন আসতেন উৎসবটি সকলে মিলে একত্রে করতে। গাড়ী ঘোড়া যা চলতো তা তো পাবনা শহর পর্য্যপ্ত। অত:পর দীর্ঘ ১৫ মাইল রাস্তা গরুর বা মহিষের গাড়ী চড়ে আসতেন। এতে সময় লাগতো অনেক। কিন্তু অসুবিধা হতো না। তখন সরকারি অফিস আদালত, ইংরেজ আমল হওয়া সত্বেও সাত দিন, ব্যবসায়ীরাও বন্ধ রাখতে সাত থেকে দশ দিন আর স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তো বন্ধ থাকতো ‘শারদীয় ছুটি’ নামে দীর্ঘ একমাস।

দূর থেকে ঐ আত্মীয় পরিজনেরা আসার সময় শিশু বালক বালিকাদের জন্য যেমন, তেমনই বড়দের জন্যে আনতেন দামী ধুতি শাড়ী, হাফ প্যান্ট তাঁরাই ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য দৃষ্টি নন্দন দামী দামী পোষাক। সে কী আনন্দ। শুধুই কি বাইরে থেকে যাঁরা আসতেন তাঁরাই নতুন কাপড়-চোপড় দিতেন? না, দিতেন বাবা-মা ও অনেক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ গ্রামবাসীরাও।

কাছে বা দূরে যেখানেই হোক, অন্তত: একদিন নতুন কাপড়-চোপর পড়ে প্রতিমা দর্শনে যেতাম সকলে মিলে। ঢাকের বাজনা, তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, আরতি প্রভৃতি এক আকর্ষনীয় আবহ রচনা করতো। তরুণ-তরুণীদের মেলামেশা, বয়স্কদের একে অপরের সাথে বৎসরান্দে দেখা ও আলাপ কী-ই না আনন্দ সঞ্চার করতো।

পরবর্তী মজাটা দেখতাম প্রতিমা বিসর্জনের দিন। আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে ইছামতী নদী প্রবাহিত। বিজয়া দশমীর দিন ২০-২৫ টা নৌকায় প্রতিমা চড়িয়ে আগে পিছে ঢাকের বাদ্যের তালে তালে এক ধরণের নৌকা বাইচ বা প্রতিযোগিতা উৎসবের বিদায়লগ্নকে স্মরণীয় করে তুলতো। প্রতিমা বিসর্জনের পর রাত ১০ টা-১১টায় বেদনাহত চিত্তে সকলে বাড়ী ফিরতাম। দুর্গাদেবীর আগমণ যতটা আনন্দ বয়ে আনতো-ঠিক ততটাই নিরানন্দ গ্রাস করতো দেবী মূর্তি বিসর্জনের পর। বাড়ীতে ফিরে সবাইকেই দেখতাম বিষণ্ন-যেন এক গভীর শূন্যতা গ্রাস করেছে বাড়ীর ও প্রতিবেশীদের সকলকে। তা এতটাই যে অনেকে রাতে ভাত না খেয়ে এক গ্লাস দুধ বা জল চুমুক দিয়ে খেয়েই শুয়ে পড়তেন দেবীকে হারানোর বেদনায়।

আবার পরদিন প্রত্যক্ষ করতাম ভিন্ন রকমের সকাল। রেওয়াজ মত বিজয়ার পর দিন মা-বাবা ও গুরুজনদেরকে প্রণাম করতে হয়। আর প্রণাম করলেই টাকা ও মিষ্টি পাওয়া যেত। অত:পর বন্ধু-বান্ধবরা দলে বলে বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রণাম করা ও মিষ্টি খাওয়ার ধূম। আগের দিনের প্রতিমা বিসর্জনের বেদনা প্রশমনের কাজটা হয়ে যেতো। বাদ্যি বাজনা রোজই দিবারাত্র বাজতো মসজিদের আযান ও নামাজও চলতো। কেউ কাউকে আপত্তি করতো না। পরের ধাপে অতিথি-বিদায়। দিন কয়েক থাকার পর তাঁরা যখন বিদায় নিতেন তখন আর এক দফা শূন্যতা ও মন খারাপের মধ্যে পড়তে হতো।

এই যে দীর্ঘ বর্ণনা করলাম এতে অংশ গ্রহণ শুধু যে হিন্দুরাই করতেন তা নয়-বিপুল সংখ্যক মুসলিম তরুণ-তরুণীও অংশ নিতেন। কে হিন্দু কে মুসলমা সে প্রশ্ন উঠতোই না। আজ বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়-ঐযে পূজা দর্শন, প্রতিমা দর্শন, বিসর্জন এর কোন অংশই একজন পুলিশ বা আনছারকেও দেখা যেত না। ভাঙচুর জাতীয় কোন ঘটনাও ঘটতো না।
এবারে আসি লক্ষ্মীপূজায়। এটা বাড়ী বাড়ীতে হতো এখনও হয়। মূর্তি তুলে বা ঘটে বা পটে পূজা করেন মহিরারা অথবা পুরুষ পুরোহিত ডেকে। পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণ যাকে বলা হয় লক্ষী ভূজা। এটা লক্ষ্মী পূজার রাতেই শুরু হতো পরদিন দুপুরের আধা পর্য্যন্ত চলতো। এই পালা এখন আর নেই্ তবে সাধ্যমত লাডু, বড়ি, লুচি, পায়েস, ফল-মূলের আয়োজন সবাই করেন-ততে বিতরণের সাধ্য শক্তি বহুলাংশে কমে গেছে।

এবারে আসি দুই ঈদের অভিজ্ঞতা বলতে। এতদিনে গ্রাম ছেড়ে স্থায়ীভাবে পাবনা শহরে চলে এসেছি। ঈদে আত্মীয় পরিজনের নানা কর্মস্থল থেকে বাড়ীতে বা পরিচিত ঘনিষ্ঠদের বাড়ীতে আসার কী ধূম। একইভাবে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সহ সবার জন্য ভাল ভাল জামা কাপড় উপহার। প্রথম ঈদকে বলা হয় ঈদ-উল-ফিতর। লোকে বলে সেমাই খাওয়া ঈদ। আসলে ঈদের আগে একমাস রোজা থেকে পরদিন সকালে স্নান করে রুটি সেমাই খেয়ে জায় নামাজ নিয়ে যার যার পছন্দের মাঠে বা মসজিদে নতুন কাপ ও টুপি পরে নামাজ। অত:পর গণ-কোলকাুলি। বাসায় ফিরে ভাল মন্দ নানা ধরণের সুস্বাদু রান্না।

আমার এক বন্ধু আনোয়ারুল হক প্রতি বছর উভয় ঈদে নিমন্ত্রণ জানাতো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেস তার সকল বন্ধু ও আত্মীয় পরিজনকে। যেতাম ও সবাই দলধরে। পোলাও-মাংস ছিল আবশ্যিক মেন্যু-রান্না করতেন বন্ধু পত্নী। কী অপূর্ব স্বাদ, আজও যেন তা জিভে লেগে আছে।

ঈদের দিন এই দফারও সকালে স্নানাদি সেরে জায় নামায নিয়ে প্রিয়াজনদের সাথে ময়দান বা মসজিদ সমূহে নামায এবং তার পর আলিঙ্গনের পালা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী সুন্দর সারি সারি মুসুল্লিরা নামাজ পড়ছেন সুশৃংখলভাবে উভয় ঈদেই এই দৃশ্যটি ছিল দেখার মত আলিঙ্গনে হিন্দু-মুসলিম কেউ বাদ যেতনা শুধুমাত্র ঈদের জামায়াত এ নয়-চলবে পরপর কয়দিন ধরে।

তখনকার দিনে কোন পুলিশও দেখা যেত না অস্ত্র বা লঠি হাতে। কারণ এতই শান্তি পূর্ণভাবে হতো অনুষ্ঠানগুলি যে পুলিশ আনসারের আদৌ প্রয়োজন হতো না-কোন দুর্ঘটনাও ঘটতো না। এই ঈদেও আনোয়ারের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ যেতাম হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে। সাথে খেতাম খাশি বা মুরগীর মাংশ গো মাংশ খাওয়ার কথা কেউ ভাবতও না।
তাই আকরিক অর্থেই এই তিনটি ধর্মীয় উৎসব আমাদের জাতীয় উৎসব।

কিন্তু কিছু কালে কালে শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে, আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির সাথে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন। আজ পূজায় প্রতিমা নির্বানকাল থেকে শুরু করে বিজয়া পর্য্যন্ত পুলিশ প্রহরাই শুধু নয়-সশস্ত্র পুলিশ চাই। চাই দুটি ঈদের জমায়েতকে ঘিরেও।

ভাবনার বিষয় এখন পূজার সংখ্যা বেড়েছে-প্রতি বছরই বাড়ছে দর্শকও বাড়ছে। গাড়ী ঘোড়ার বাড়ছে-বাড়ছে পুলিশী প্রহরাও। পূজার কিছুকাল আগে প্রমাসনের সাথে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন-প্রহরার ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিন্তু নিয়োগ করবেন। আযান ও নামাযের সময় কোন বাদ্য বাজনা বাজনো যাবে না-যা অতীতে দিব্যি বাজতো সর্বত্র।

ঈদের জামাতকে ঘিরেও ব্যাপক পুলিশী ব্যবস্থা নিতে হয় যা আগে আদৌ নিতে হতো না। ধর্মের কি হাল দাঁড়িয়েছে তা মাত্র দিন কয়েক আগে আফগানিস্তানে মসজিদে প্রায় ৫৫ জন নামাযরত মুসুল্লিদের হত্যা ও শতাধিক আহত করা এবং দশকের পর দশক পাকিস্তানের একইভাবে মসজিদ ধ্বংশে ও হাজার হাজার নামাযরত মুসুল্লিকে হত্রা করা হচ্ছে।

ইতিহাসটি জেনে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে জিজ্ঞেস করলেন-তা হলে অতীতে আমরা বা আমাদের শ্রদ্ধেয় পূর্ব সূরীরা কি কিছু কম হিন্দু বা কম মুসলমান ছিলেন? না কি তাঁরা কম ধার্মিক ছিরেন?
জবাব দিতে পারি নি এ প্রশ্নের।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test