E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বিএনপি সম্প্রীতি বিনষ্টকারী : জামায়াত-হেফাজত?

২০২১ নভেম্বর ২৬ ১৫:২০:৩১
বিএনপি সম্প্রীতি বিনষ্টকারী : জামায়াত-হেফাজত?

রণেশ মৈত্র


একটি রেকর্ড শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। এখন আর কেউ শুনে না-শুনতেও চায় না। সবার মতেই রেকর্ডটি ভাঙ্গা। তাই ভাঙ্গারেকর্ড যতই বাজানো হকো যত জোরেই বাজানো হকো, সরকারি-বেরকারি যত উচ্চাসন থেকেই বাজানো হোক-তা শুনতে শুনতে বক্তারা বা তাদের অন্ধ অনুসারীরা ছাড়া আর কোন শ্রোতা নেই-সারা দেশেই নেই-একেবারেই নেই।

রাজনীতির ঐতিহ্যবাহী অঙ্গনটি কি এতে সমৃদ্ধ হচ্ছে? জনপ্রিয় হচ্ছে? মানুষ এগুলো গুনার পরে কি তাথৈ তাথৈ নৃত্য করছে? সঠিক একটি কথা শুনলাম বলে তৃপ্তি বোধ করছে?

না। কাউকে কোন ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্যে লেখাটি লিখতে বসি নি। এবার সদ্য সমাপ্ত দুর্গাপূজার দিনগুলিতে যে হিংস্রতা, নৃশংসতা, বর্বরতা দেখলাম-তার কোন তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই “বিএনপি-বিরোধী প্রচার বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন সরকারি নেতা (নাম ও পদবী বলতে সাহস পেলাম না-যদিও তা করার পরিপূর্ণ ও সাংবিধানিক অধিকার আমার এবং সকলেরই রয়েছে এদেশের নাগরিক হিসেবে।

অষ্টমীর দিন কুমিল্লা থেকে দুর্গা প্রতিমা মিথ্যা, অবিশ্বাস্য অভিযোগে প্রতিমা, মন্দির ভাঙচুরে যে দুর্ধর্ষ অভিযান শুরু হয়ে অন্তত: পক্ষে বিজয়ার দিন পর্য্যন্ত সারা দেশে অব্যাহত ছিল (এবং সম্ভবত: এখনও তার সমাপ্তি ঘটেনি) তাতে সরকারিভাবে দু:খ প্রকাশ না করে, দায়িত্ব গ্রহণ না করে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় না থেকে মৃত প্রায় অবস্থায় থাকা বি.এন.পিকে বেমালুম দায়ী করে বিবৃতি বক্তৃতা ঝাড়ছেন। কোন যৌক্তিক কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে না করলেও বলে বসেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্যেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করছে এবং এ জাতীয় বক্তব্য প্রচারের শেষ নেই।

বিএনপিও ধোয়া তুলসী পাতা নয়। সরকার যাই করুক তা ভালই হোক বা মন্দই হোক-তার বিরোধিতা ক্লান্তিহীনভাবে করে চলেছে। সরকারি মহল যে কোন বক্তব্যই দিক বিএনপি নেতারা তৎক্ষণাৎ তার বিরোধিতা করে এবং তাকে মিথ্যা বলে দাবী করে বিবৃতি দিতে বা সংবাদ সম্মেলন করতে আদৌ কোন বিলম্ব করেন না। উভয় দলের সুরই এমন যে, “যত দোষ-নন্দ ঘোষ”। তাই কারও বক্তব্যের প্রতিই মানুষের সমর্থন নেই। ঘোষণা করা না হলেও সরকার দলীয় সাধারণ সম্পাদককে বিএনপি বিয়ক মন্ত্রী বলে মনে হয়।

রাজনৈতিক অঙ্গনকে এভাবে দশকের পর দশক ধরে “যারে দেখাতে নারি তার চলন বাঁকা” এমন ধরে বক্তব্য তোতা পাখীর মত বলে বলে আজ বিষাক্ত করে ফেলা হয়েছে। নিজেও একজন প্রবীণ রাজনীতি হয়ে কি করে বলি যে মানুষ আজ আর রাজনীতি করতে চায় না-তারা রাজনীতি বিমুখ এবং হতাশাগ্রস্ত। বলতে চাই বা না চাই ঘটনা তো সত্য। কালো টাকা ও অস্ত্রধারী তরুণরা ছাড়া আজ আর তরুণেরা রাজনীতির পথে হাঁটতে চায় না। তুণীরা যাঁরা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে একা বা পুরুষ সহকর্মীর সাথে সারাটি দেশ, প্রতিটি জেলা-উপজেলা কষ্টে বেড়িয়ে আন্দেলন-সংগঠন-সম্মেলন, জনসভা করে পাশাপাশি বসে দিয়ে রাতে ট্রেনে বাসে-স্টীমারে ঘুরে বেড়িয়েছেন-তখন তো কেউ তা সে কোন ছাত্রীই হোক বা তাঁদের কোন অভিভাবক বা অভিভাবিকাই হোন-কদাপি বিন্দুমাত্র দুর্ঘটনা ঘটাতে দেখেন নি বরং নির্বিবাদে নিজ নিজ যুবতী মেয়েকে অবাধে ঐ যুগে ছাত্র সংগঠন যুব সংগঠন করতে দিয়েছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। এ গৌরব, দাবী করতেই পারে তৎকালী ছাত্র ইউনিয় ও যুব ইউনিয়ন। ইদানীং কি ঘটছে প্রত্যক্ষভাবে তা আমার সুযোগ নেই-কারণ সংগঠণগুলির কোন অস্তিত্ব আদৌ চোখে পড়ে না। তাই ঐ সংগঠনগুলির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সর্ব অনুভব করি। ইতিহাস বলে, মেয়েরা-তা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যে স্তরে ছাত্রী হোন যোগ দিতেন ছাত্র ইউনিয়নে কারণ শুধুমাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে নয় আচার-আচরণ-নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও তাঁরা ছিলেন উজ্জ্বল ও অবিতর্কিত।

সে কালের ছাত্রলীগও ছিল এ জাতীয় গৌরবের অধিকারী। আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে। তবে মেয়েরা ছাত্রলীগের চাইতে ছাত্র ইউনিয়নকে বেশী সমর্থন করতো-অনেক বেশী পছন্দ করতো।

ছাত্রলীগ-যুবলীগ আজ দৃশ্যত: বিশাল বিশাল সংগঠন। অনেক যুবক-যুবতীর সাক্ষাতই সেখানে মেলে। মূল কারণ তাদের রাজনৈতিক দল। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছাত্রলীগ-যুবীগের অনেকের হাতেই অস্ত্র ও কালোটাকা এমনকি ছাত্রলীগ যুবলীগ যুব মহিলা লীগ ও ব্যতিক্রম নয়-সামান্য কিছু ছাড়া। বহু ক্ষেত্রে সারা দেশে তাদেরকে টেণ্ডার বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য প্রভৃতি সুযোগ করে দেওয়া হয়-এই পথে তাদেরকে অবৈধ অর্থের মালিক বনে যেতে সহায়তাও করা হয়।

ছাত্রদল-যুবদল-মহিলাদল হলো বিএনপির শাখা প্রশাখা। বিএনপি প্রতিষ্ঠাত বিয়াউর রহমানের আমলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের অধিকারী বিশেষ একজন ছাত্রী (তখন তিনি বড় ধরণের ছাত্র দল নেতা বলে পরিচিত ছিলেন) প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরতেন ও নিজ হল কক্ষে অনেক ছাত্র-যুব সহ রাত কাটাতেন। আজ তেমন কোন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে নেই। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর করিতকর্মা জ্যেষ্ঠ পুত্র ঢাকায় থাকাকালে যে বিশেষ হাউসটি পরিচালনা করতেন তখন তা মানুষের মুখে ছুটতো। আজও বিএনপি পরিচালিত হয় করিৎকর্মা এ সাজাপ্রাপ্ত লন্ডন প্রবাসী জিয়া তনয়ের দ্বারা। তিনিই কার্য্যত: বিএনপির নীতি নির্ধারক দলের সভাপতি বা স্থায়ী কমিটির সদ্যরা নন।

ঐ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বা ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালে (১৯৯১সালে) নির্ভাচনের অব্যবহিত আগে ও পরে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তারা ঘটিয়েছিল-তাতে হাজার হাজার বাড়ী-ঘরে অগ্নি সংযোগ, লুঠপাট, নারী অপহরণ ও ধর্ষণের যে কাহিনী সাংবাদগুলিতে প্রকাশিত হয়েছিল সে ইতিহাস এমনই যে হাইকোর্টের নজরে তা আনা হলে হাইকোর্ট তার নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দেন। হইতোমধ্যে পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দীর্ঘকাল পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ১৯৯১ এর সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর তদন্তের জন্য এক সদস্য বিশিষ্ট এক বিচারত বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ঐ বিচারক জজ কোর্টের বিচারক থাকাকালে রিটায়ার করেছিলেন এবং স্বয়ং সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতা। বছরব্যাপী সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করে প্রতিটি ঘটনার অনুসন্ধান করে অভিমত দিয়েছিলেন যে অন্তত: ৩০০০ থেকে ৪০০০ ঘটনার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে সুতরাং এই ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা তোক। এই মর্মে লিখিত সুপারিশপত্র তিনি তৎকালীন মহিলা স্বাষ।ট্রমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করেন ।

পরবর্তীকালে সাংবাদিকরা জানতে চান ঐ তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে কি না জবাবে মন্ত্রী বলেছিলেন ‘অবশ্যই’। তবে বিপোর্টটি অনেক বড়-তাই সেটা পড়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না তাই মামলা দায়ের করতে কিছুটা সময় লাগবে। মাস তিনেক পরে সাংবাদিকেরা ঐ মন্ত্রীকে পুনরায় একই প্রশ্ন করলে তিনি সেবারও ঐ একই জবাব দেন।

ঐ মন্ত্রীর পরে অপর একজন ম ন্ত্রী স্বরাষ্ট্র দফতরে এলে পুনর্বর সাংবাদিকেরা তাঁকে ঐ প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলেন, অবশ্যই। কোন অপরাধীকেই খাতির করা হবে না। এবারে সরকারের নীতি হলো ‘ নো টলারেন্স’। মামলা দায়েরর প্রসঙ্গের এখানেই ইতি।

তা হলে আওয়ামী লীগ আমলে যে সাম্প্রদায়িক অপরাধীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হলো না-তার জন্যেও কি বিএনপি দায়ী?

নাসিরনগর, শাল্লা প্রভৃতি ঘটনার জন্যে কারা দায়ী? শাল্লার ঘটনা তো অনুষ্ঠিত হয় দিবাভাগে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর দিনে। এই ঐতিহাসিক দিনটির আয়োজনও সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওতে আওয়ামী লীগ কম করে নি। হিন্দুরা ৩০০/৪০০ সন্ত্রাসীর নামে মামলা করে-তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যককেই পুলিশ গ্রেফতার করে। দিন কয়েকের মধ্যে ১৬/১৭ জন অপরাধী আওয়ামী লীগারকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় আর নিরপরাধ ঝুমন দাসকে বহু চেষ্টার প রহাইকোর্ট থেকে শর্তাধীনে জামিন দেওয়া হয়। জামিনে এতকাল পরে মুক্তি পাওয়ার পরে আনন্দের পরিবর্তে তার পরিবারের সদস্যদের মুখে নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ। তারা হুমকির সম্মুখীন। এক্ষেত্রে তো সকল অপরাধীর জামিন বাতিল ও পুলিশী প্রহরা ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে অন্তত: ১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে তাদের ভরণ পোষণের সুযোগ করে দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয় নি। এটির জন্যেও কি বিএনপি দায়ী। ফেনীতে গত সোমবারেও রাতে ৩৫টি মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে। গোয়েন্দা বিপোর্ট বলে সম্বধিত ঘটনায় জামায়াত, হেফাজত ও আওয়ামী লীগ উসকানি দিয়ছে।

বিএনপি দাবী করে তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না চান নির্ধলীয় নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার ও স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত দোষারোপ করা হয় কিন্তু দাবীটা তো সর্বদলীয়।

সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যা দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে দেশব্যপী হিন্দুদের ও অসাম্প্রদায়িক মুসলিমকে আতংকিত করে তুলেছে তার বিরুদ্ধে অনেক জায়গায় গত ১৬ অক্টোবর প্রতিবাদ মিছিল করার অনুমতি না দিলেও ঢাকার বুকে নানা মসজিদ থেকে মুসুল্লিরা জুম্মার নামায অন্তে সাম্প্রদায়িক শ্লোগান সহকারে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলে একটি মন্দির আক্রমণ করতে সক্ষম হলো। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক-এর জন্যেও কি বিএনপি দায়ী? জামায়ত হেফাজত হালাল? আসল কাজটি হলো “বিএনপি বিষয়ক মন্ত্রণালয়” তুলে দেওয়া হোক-তারা অশান্তি আরও বাড়াচ্ছে।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test