E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভাবমূর্তি সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

২০২২ এপ্রিল ১৬ ১৪:৪৯:২০
ভাবমূর্তি সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

চৌধুরী আবদুল হান্নান


সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এসকেসুর) ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহআলম সম্পর্কে বিপুল পরিমান অর্থ লোপাট মামলার পলাতক আসামি পি কে হালদারকে অর্থআত্মসাতের ঘটনায় তাদের যোগসাজশ রয়েছে বয়েছে বলে পত্রিকায় অনবরত খবর হচ্ছে ।

বিষয়টি তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে, তাই এ বিষয়ে কথা বলার সময় আসেনি ।তবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জাতীয়পত্রিকায় বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় জনমনে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারনা তৈরিহয়েছে, তা সহজে দূর হওয়ার নয়। তবে প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের জন্য যেমন শীর্ষ নির্বাহী প্রশংসিত হন তেমনি ব্যর্থতার দায়ও তাকেই নিতে হয়।

অপরদিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতানিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের । এর প্রধান কারণ বাহির থেকে অযাচিত চাপ (রাজনৈতিক, মন্ত্রণালয়, প্রাইভেটব্যাংক মালিক সমিতি, ক্ষমতাবান ঋণখেলাপি ইত্যাদি ) ।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্হাটির ভিতর থেকে ঘুনপোকার আক্রমণ আর বাহির থেকে প্রভাবশালী মহলেরঅনাকাঙ্খিত চাপের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমানে স্বাধীনভাবে কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে দৈন্যদশাদৃশ্যমান ।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভথেকে ২০১৬ সালে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের আর একটিঅক্ষমতার নজির ।

একটি পুরানো খবর কিন্ত বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক ।বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্হাপককে ৫৪ লাখটাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত হওয়া সত্ত্বেও চাকুরিচ্যুৎ করা হয়নি, শাস্তি হিসেবে দুটি বার্ষিকবেতন বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছিল । (দৈনিক সমকালে “গুরু পাপে, লগু দন্ড“ শিরোনামে ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ খবর প্রকাশিত)

নিয়ন্ত্রক সংস্হা হিসেবে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম কাজ । সেই সংস্থারই একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনা প্রকাশের পর ব্যাংক পাড়ায়ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়েছিল ।অর্থ আত্মসাতের বা নৈতিক স্খলনের এমন “ অবাক বিচার “ বাংলাদেশ ব্যাংকে ইতিপূর্বে কেউ দেখেনি । আত্মসাতকৃত অর্থের পরিমান বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছেনৈতিকতা । সততা, বিশ্বাস মানদন্ডে যারা উত্তীর্ণ নয় , তারা ব্যাংকের জন্য বিপজ্জনক । প্রতারণামূলককাজে জড়িত একজন মহাব্যবস্হাপক, একজন অবিশ্বাসী কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা কীভাবেবাড়াবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায় ।

বাবু এস কে সুর সহকারী পরিচালক পদ থেকে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত তিন দশকের বেশি সময় কেন্দ্রীয়ব্যাংকে বিভিন্ন পদ মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করে পেশাদারিত্বে উৎকর্ষতা অর্জন করেছেন । নিয়মিত চাকুরিকাল শেষে তিনি ২০১৮ সালের প্রথম দিকে “ব্যাংকিং রিফর্ম অ্যাডভাইজার“ হিসেবে পুনঃনিয়োগপান ।

সব কিছু ঠিক আছে, অনেক কিছু ঠিক নেই । শত প্রশ্নের জন্ম দেয় যখন হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতকারী অর্থ পাচারকারী পি কে হালদারেরকুপ্রস্তাবে কেউ কেউ রাজি হন ।

এস কে সুরের পুন:নিয়োগ পাওয়ারই কথা, প্রতিষ্ঠান প্রধান অনেক ক্ষেত্রেই পুরাতন অভিজ্ঞ কর্মকর্তারসাথে কাজ করতে পছন্দ করেন । তাতে সুবিধা অনেক, কাজে বেগ পেতে হয় না, চাওয়া মাত্র তথ্যাদিপাওয়া যায়, প্রতিটি বিষয় তার নখদর্পণে থাকে এবং নিশ্চিন্তে ভরসাও করা যায় । আর যদি কর্মকর্তাটিহন সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ, চৌকস এবং সীমাহীন অনুগত, তা হলে তো কথাই নেই ।

দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মুখামুখী হওয়া, সরকারের ব্যাংকার হিসেবে রাষ্ট্রের ব্যালেন্স অব পেমেন্টমনিটর করা, দেশের বাইরে বিভিন্ন সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিত্ব করাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণকাজ যিনি দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারেন, কারও কোনো বেগ পেতে হয় না, গভর্নরের কাছে তাঁরকদর একটু বেশিই থাকবে ।

তবে সর্বনাশটা তখনই ঘটার আশংকা থাকে যখন কোনো শীর্ষ নির্বাহী এমন ব্যক্তিদের অন্ধবিশ্বাস করাশুরু করেন । অবশ্য সাবেক ডেপুটি সিতাংশু কুমার শুর চৌধুরীর ক্ষেত্রে এমনিটি হয়েছে বলে শুনাযায়নি ।

আমরা স্বাধীনচেতা, নির্ভীক মানুষ চাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যিনি নীতি বিধি-বিধানেরক্ষেত্রে কোনো আপোস করবেন না । আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলতেন — বংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ হবে অর্থমন্ত্রণালয় যাই বলুক তানা শুনে ব্যাংকিং নিয়মাচার মেনে কাজ করা ।

একজন স্বাধীনচেতা ব্যাংকারের কথা বলি — মো . লুৎফর রহমান সরকার (এল আর সরকার) সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা কালে (১৯৮৩- ৮৫) হু ম এরশাদ সরকারেরশিক্ষামন্ত্রীর অনৈতিক নির্দেশ আমলে না নেওয়ার জন্য শুধু চাকুরিচ্যুতি নয়, তাঁকে জেলেও যেতেহয়েছিল ।

অবশ্য পরবর্তী সময়ে হাসিনা সরকার তাঁকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ( ১৯৯৬-৯৮ ) নিয়োগ দিয়ে তাঁরসম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ।

যারা বিবেক বিসর্জন দিয়ে লোভনীয় পদ আঁকড়ে রাখতে প্রভাবশালীদের অনৈতিক আদেশ-নির্দেশ অবলীলায় মেনে নিয়ে ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা করেন না, তারা মেরুদন্ডহীন, পরগাছা, তাদের শিক্ষামূল্যহীন ।

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং দুরবস্হার ক্রমাগত অবনতি রোধে ব্যাংকিং খাতেরঅভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিরকোনো বিকল্প নেই ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test