E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম

২০২২ মে ২৪ ১৫:৪৬:৫৬
সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম

ডাঃ মোঃ মিজানুর রহমান


‘গাহি সাম্যের গান—যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা—ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু—বৌদ্ধ—মুসলিম—ক্রীশ্চান’ — বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ও অবিস্মরণীয় নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি মানবতার কবি,সাম্যের কবি, বিদ্রোহী কবি, তথাপি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত।

দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’—এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো — সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪—এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় তৃতীয় স্থানে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম।

তিনি তার লেখায় সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়ীকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তিনি সারাজীবন সমাজের গরীব শোষিত মানুষের জন্য লিখে গেছেন। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোদ্ধে লিখছেন “বিদ্রোহী ” কিংবা ভাঙ্গার গানের মত কবিতা, প্রকাশ করেন ধুমকেতুর মত সমসাময়িকী, জেলে বন্দী হয়ে লিখেন “রাজবন্দীর জবানবন্দি”। অগ্নিবীণার মত প্রবেশ এবং ধুমকেতুর মত প্রকাশ হয়েছিল নজরুলের। তিনি সারাজীবন তার লেখনীর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, শোষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রতি বিদ্রোহ প্রকাশ করে গেছেন সবসময়। নজরুল লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর এক হাতে রণ—তূর্য। ’
বিদ্রোহ প্রকাশ করতে গিয়ে কবি তার কবিতায় লিখেছেন—

“আমি চির বিদ্রোহ বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা
চির উন্নত শির।”

নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের তুঙ্গীয় নিদর্শন। তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কবি ছিলেন না। বরং মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, নারী, পরুষ, ধনী, গরীব, বড়, ছোট সকলের কবি। তিনি সবাইকে এক কাতারে এনে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার যে প্রচেষ্টা সেটা নজরুল করেছেন বারবার। লেটোর দল, মসজিদের মুয়াজ্জিন, কিংবা হোটেলের রুটি তৈরির কাজ করেছেন আনন্দের সাথে। সারাজীবন সাধারণ শোষিত নিপীড়িত মানুষকে ভালোবেসেছেন মানুষ হিসেবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে লেখেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লেখতে গিয়ে জেল খেটেছেন নির্দিধায়। পিছিয়ে পড়া সাধারণ গ্রামের শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য আকুতি করেছেন বারবার। তাদের জন্য লেখেছেন জনসাহিত্য, গণসাহিত্য। কবি কাজী নজরুল ইসলাম সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল — “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের নারীদের অধীকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন অগ্রগামী। তিনি নারীদের মর্যাদা দিয়ে লিখেছেন—

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী—
অর্ধেক তার নর।”

সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গদ্য রচনায়ও নানাভাবে তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতির কথাই বলেছেন। একটি অভিভাষণে তিনি বলেছেন, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু—মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।

কবি সাম্যের গান গেয়েছেন, ইসলামের মর্যাদা এবং ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কবিতা লেখেছেন, গান গজল লেখেছেন, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ লেখেছেন। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় কালজয়ী গান, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” নজরুলের সৃষ্টি।

নজরুল এদেশকে ভালোবেসেছেন, এদেশের সাধারণ মানুষকে ভালোবেসেছেন, এদেশের প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন। তিনি ছিলেন বাঙ্গালি জাতির মুক্তি ও এদেশের চেতনাগত সংকট উত্তরনের ও উজ্জীবনের এক সাহসী অনুপ্রেরণা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ চেষ্টার ফলশ্রম্নতিতে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা প্রতিভা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কোলকাতা থেকে ঢাকা আনা হয়। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিলিট এবং বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য যা ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।

আজ স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর যখন জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দেশীয় ও বাইরের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামের মানবতা ও রাজনৈতিক দর্শন আমাদের পথ দেখাতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন কবির গান কবিতার আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল তেমনি বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রেও তিনি হতে পারে আমাদের অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস। সাধারণ জনগণকে কিভাবে আমরা দেশের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি তা নজরুল স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করে গেছেন। অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় নজরুল সম্পর্কে বলেছেন, “এক হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি। তাঁর পরিচয় ছিল মানুষ হিসাবে।”

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। নজরুলের জীবনি— সাহিত্যে কর্ম গ্রহণ এবং বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ অচ্ছেদ্য ও অনিবার্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন সদ্য স্বাধীন দেশে কবিকে এনে সম্মানিত করে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিলের দেশের জন্য তেমনি আমাদের বর্তমান তরুন সমাজের উচিত কবির রাজনৈতিক ও মানবতার দর্শন, সাম্রাজ্যবাদ সাম্প্রদায়িকতা, অনাচার শোষণের প্রতি বিদ্রোহী মনোভাবের শিক্ষা দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে গ্রহণ করা।

লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test