E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আর নয় শব্দ সন্ত্রাস

২০২২ আগস্ট ২৯ ১৪:৫২:১৬
আর নয় শব্দ সন্ত্রাস

জিয়া হাবীব আহসান


পরিবেশ দূষণ আর শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের আগামী প্রজন্ম এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে দ্রুত এগুচ্ছে। একটা সুন্দর সুস্থ পরিবেশ জাতিকে উপহার দিতে না পারলে আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে দায়ী থেকে যাবো। হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া স্বত্বেও তা আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে নগরে, শহরে, বন্দরে, অলি-গলি, হাইওয়েতে হাইড্রোলিক হর্ণ দাবডিয়ে বেড়াচ্ছে । অথচ আধুনিক বিশ্বে হর্ণ ব্যবহার উঠে গেছে, হর্ণ ব্যবহার করলে সবাই মনে করে সে কোন বিপদে পড়েছে। আর আমাদের দেশে হর্ণ ব্যবহারের পরেও কেউ সরে না, একজন‚ সুজন বড়ুয়া “ মানবিক আহ্ববান নিয়ে হাইড্রোলিক হর্ণ ও শব্দ দূষণ বন্ধে স্ব-পরিবারে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজ পথে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছে, তাকে সমর্থন জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ এবং পরিবেশ ও মানবাধিকার আন্দোলন- পমা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে এ আন্দোলন। একজন মানুষের স্বাভাবিক শব্দ গ্রহণের মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল।

বিবিসি তথ্যানুসন্ধান থেকে জানা যায় শহরের রাস্তায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবলের নিচে নামে না অনেক সময় আরো বেড়ে যায়। বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না।বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল।হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। রাত এগারোটার পর থেকে আমাদের বিভিন্ন এলাকায় বিল্ডিংয়ে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান, পার্টি, ব্যান্ড সঙ্গীত প্রতিদিন হচ্ছে। ১০০ dB লেভেলে হিন্দি গান বাজছে।

অন্যদিকে নতুন ফ্ল্যাট উঠছে কোন সময় নির্ধারণ না করে, রাতের পর রাত কাজ চলতে থাকে। রাতে ছাদ ঢালাই এবং পিলার তৈরির জন্য মসল্লা তৈরি হচ্ছে ‚গরগরকরকর“ আওয়াজ হচ্ছে। এটাও ১০০ ডিবি র কম না।কর্মজীবি মানুষগণ সারাদিন কাজ শেষে ঘুমোতে গেলে সেটাও এই আওয়াজের জন্য সম্ভব হয়না।রোগী থাকলে সঠিকভাবে বিশ্রাম করতে পারে না।শহরে গড়ে শব্দ দূষণের পরিমাণ ৯০ ডিবি এর কাছাকাছি। এর বেশিটাই আসে গাড়ির হর্ন থেকে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অকারণে মাথা ধরা, হার্টের অসুখের কারণ। আর শব্দদূষণ ১০০ মানে আপনার শিশুর কানে সমস্যার সৃষ্টি করবে। আমাদের বন্ধু দেশ জাপানের কথা জানা যাক।জাপানের অধিকাংশ হাইওয়েগুলো তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে। আজ থেকে ৬৬ বছর আগে। হাইওয়ে মানে কোন ট্রাফিক সিগন্যাল থাকবে না। সাঁইসাঁই করে সুপার স্পিডে গাড়ি চলবে। বিপাকে পড়লেন রাস্তার দু’পাশের অধিবাসীরা। সরকারের কাছে নালিশ দিয়ে বসলেন‚ আওয়াজের জ্বালায় ঘুমাতে পারিনা। রাস্তা সরান। “রাস্তা সরানো চাট্টিখানি কথা নয়। সরকার বুদ্ধিজীবীদের ডাকলেন। পরামর্শ চাইলেন। উদ্দেশ্য হলো‚ কত আওয়াজে কত জ্বালা “ তা পরিমাপ করা।বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে বুদ্ধি দিলেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সের ২০০ জন অধিবাসীদের ওপর সমীক্ষা চালালেন। শব্দহীন রুমের ভেতর দিনে রাতে বিভিন্ন সময়ে ওনাদেরকে‚ খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো “ টাইপের কবিতা শুনিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হল। তারপর ৩০ ডেসিবেল থেকে ১০০ ডেসিবেল পর্যন্ত আর্টিফিসিয়েল গাড়ির শব্দ বাজিয়ে দেয়া হল। কার কত ডেসিবেলে ঘুম ভাঙল তা রেকর্ড করা হলো। সরকার এই ফলাফলের ভিত্তিতে নতুন রাস্তা আওয়াজ আইন জারি করলেন।কোন বাড়িতে যদি দুপুরে ৭৫ ডেসিবেল আর রাতে ৬৫ ডেসিবেল-এর বেশি আওয়াজ পাওয়া যায়, তাহলে তারা ভর্তুকির জন্য আবেদন করতে পারবেন। এর নাম ‚ঘুম ভাঙ্গা ভর্তুকি”। সরকারের নির্দেশে আওয়াজ মাপা শুরু হলো। নাগরিকদেরকেও বলা হল, যদি গাড়ির শব্দজনিত কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে যেন নিম্নলিখিত নাম্বারে ফোন দেয়। ০১২০-১০৬-৪৯৭।

জাপানে ফোন নাম্বার মনে রাখানোর জন্য একটা কৌশল ব্যবহার করেন। ০১২০ হল একটা প্রে-ফিক্স। এটা থাকা মানে এই ফোন ফ্রি। যে কল করলো তার বিল উঠবে না। যাকে কল করা হলো বিল দেবে সে। ১০৬-৪৯৭ এর জাপানি উচ্চারণ হচ্ছে (দো-রো য়কু নারে)। এর মানে হচ্ছে ‚ রাস্তা তুই ভাল হয়ে যা। “লোকজন এই নাম্বারে ফোন করলেন, ভর্তুকির জন্য প্রস্তুতি নিলেন জাপানের হাইওয়ে অপারেটর NEXCO কোম্পানি। ৮ হাজার ৫০০ কিমি রাস্তার মালিক তারা। ভর্তুকির টাকা গুনতে মাথায় হাত দিলেন।আইন পরিবর্তন করার জন্য রাস্তার মালিক রাস্তায় নামলেন না। সরকারকে ঘুষ দিতে গেলেন না। আশ্রয় নিলেন প্রযুক্তির। বুদ্ধিজীবীদের ডাকলেন। আওয়াজ আর জ্বালা কমানোর জন্য প্রযুক্তিগত বুদ্ধি চাইলেন। দুটো প্রযুক্তি কাজে লাগানো হলো১. ইঞ্জিনের সমস্যা না থাকলে আওয়াজ তৈরি হয় টায়ার আর রাস্তার ঘর্ষণ থেকে। নতুন এলিমেন্ট দিয়ে রাস্তা কার্পেটিং করা হলো। গাড়ি কোম্পানিগুলোকেও ডেকে বসালেন, কম আওয়াজের টায়ার আর গাড়ির নয়েজ রিডাকশানের জন্য। টয়োটা প্রিউসের আওয়াজ কত জানেন? মাত্র ১১ডিবি। গাছ থেকে শুকনা পাতা পড়ার আওয়াজের সমান।২. রাস্তার দুধারে সাউন্ড প্রুফ বেড়া (ফেন্স) বসানো হল।

মিউজিক হলগুলোতে দেখবেন একরকম ছিদ্রওয়ালা দেয়াল থাকে। এগুলো নয়েজ শুষে নেয়। ব্যয়বহুল। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গা ভর্তুকির চেয়ে সস্তা।কিন্তু এতেও সবাই সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারলেন না।অন্য কাহিনি শুরু হলো। যারা গাড়ি চালান, এবার নালিশ আসলো তাদের পক্ষ থেকে। জাপানের হাইওয়ে আমেরিকার মত ফ্রি না। একটা প্রাইভেটকারের জন্য প্রতি কিমি ২৫ টাকার মত। তার মানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে আপনাকে টোল দিতে হবে ৬২৫০ টাকা।গাড়িওয়ালারা নালিশ করলেন। তারা এতো টাকা টোল দিয়ে হাইওয়েতে যাবে আর চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখবে না? একেই বলে শাঁখের করাত, উভয় সঙ্কটে পড়া।বেড়া রাখলেও দোষ না রাখলেও দোষ।রাস্তার মালিকরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি চাইলেন। অনেক সাধনার পর বেরুলো সাউন্ড প্রুফ স্বচ্ছ দেয়াল। কাঁচের মত কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি। সৌন্দর্যও দেখতে পাবেন, শব্দ দূষণও ঠেকাবে।

জাপানের যারা হাইওয়েতে চড়বেন, আবাসিক এরিয়াগুলোর পাশের হাইওয়েগুলোতে দেখবেন সাদা স্বচ্ছ একধরনের দেয়াল। প্রযুক্তির জয় এখানেই। প্রযুক্তির জন্য পলিসি নয়, পলিসি ঠিক রেখে প্রযুক্তি উদ্ভাবন। শব্দের এই দূষণ থেকে বাঁচতে হলে- ১. যেখানে সেখানে/ পিপীলিকার মত রাস্তা পারাপার নিষিদ্ধ করা হোক, ২. নির্দিষ্ট পথ বা জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পারাপার নিষেধ, ৩. নির্দিষ্ট পথ বা জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পারাপার করলে কান ধরে উঠাবসা করানো ও নগদ ফাইন করা, অনাদায়ে আরও ৫০ বার কান ধরে উঠাবসা করানো হোক, ৪. পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে, ৫. সকল হাইড্রোলিক হর্ণ অচিরেই রিমুভ করা হোক, ৬. হাইড্রোলিক হর্ণ রিমুভ করার পর সেই গাড়ীর নাম্বার অনলাইনে আপডেট থাকতে হবে, পরবর্তীতে যদি আবার সেই গাড়ীতে হাইড্রোলিক হর্ণ পাওয়া যায় তাহলে সেই গাড়ীর লাইসেন্স চিরতরে বাতিল করা হবে, ৭. আইনের লোক যেন আইন লঙ্ঘন করে শব্দ দূষণ না করে, আইনের লোক আইন ভঙ্গ করলে সাধারণ মানুষ কোনদিন আইনকে মানবে না এবং সম্মান করবে না, ৮. আইন বা অন্য কোন বাহানায় শব্দ দূষণ করা যাবে না, কারো শ্রবণশক্তি নষ্ট করার অধিকার কারোর নেই, ৯. অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুমতি সাপেক্ষে শব্দ যেন ৬০ ডেসিবলের উপরে না উঠে তা নিশ্চিত করা হোক এবং তা যেন ৫ মিনিটের উপর অতিক্রম না করে, ১০. মোটকথা ambulance এবং fire service এর গাড়ি ছাড়া অন্য কোন শব্দ দূষণ হতে পারবে না, ১১. ট্রেনের হর্ণ পরিবর্তন করতে হবে, এটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর, ১২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে সাইন টাঙ্গিয়ে কড়াকড়ি শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে, ১৩. আবাসিক এলাকায় কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে যেন কোন শব্দ দূষণের অনুমতি দেওয়া না হয়, এক ঘরের অনুষ্ঠানের জন্য; অন্য শত শত ঘরের মানুষের ঘুম নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। ১৪. অনুষ্ঠান করে শব্দ করতে চাইলে তারা নির্জন এলাকায় গিয়ে অনুষ্ঠান করুক যেখানে জনসাধারণের উচ্চ শব্দ জনিত কারণে যেন কোন সমস্যা না হয়।

সকল প্রকার শব্দ দূষণও চিরতরে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকবে না। আশূণ সকলে ঐক্যবদ্ধ হই। সুজন বড়ুয়ার মত মানবিক চেতনার মানুষগুলো শান্তিপূর্ণপ্রতিবাদের ঝড় তুললে আশা রাখি শব্দ সন্ত্রাস“ নির্মূল হবে। একটি বাসযোগ্য পৃথিবী দিতে না পারলে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে দায়ী থেকে যাবো ।

লেখক : আইনবিদ, কলামিষ্ট এবং মানবাধিকার কর্মী

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test