E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস 

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

২০২২ সেপ্টেম্বর ২৬ ১৫:৪৭:১২
পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আগামীকাল মঙ্গলবার বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২২।  বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পর্যটন দিবস  পালিত হবে। ১৯৭০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পর্যটন শাখার বার্ষিক সম্মেলনের নাম, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। তখন থেকে এর নাম ‘বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’ (ইউএনডব্লিউটিও) করার বিষয়ে সদস্যরা একমত হয়। নতুন নামে ১৯৭৪ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এর লক্ষ্য পর্যটনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটনের অবদান সম্পর্কে অবহিত করা। আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডা. এম এম মাজেদ তাঁর কলামে লেখেন- করোনার আগ্রাসনে গেল ২ বছর বিশ্বজুড়ে সব কিছুই থমকে গিয়েছিলো। ঘর থেকে বের হওয়াই যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে বিদেশ ভ্রমণ তো দূরের কথা! বিশ্বজুড়ে তাই বড় বড় পর্যটন স্পটগুলো বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় একটি দেশ। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বের অনেক দেশেই বিরল। পর্যটন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষকে কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করেছে। প্রতি ১০ জনের ১ জন কোন না কোন ভাবে পর্যটন খাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রশ্ন আসতে পারে - পর্যটন খাতে আসতে হলে আপনাকে কি খুব বেশি প্রশিক্ষিত ও উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসতে হবে? আপনাকে এই জটিল ভাবনা থেকে বের হয়ে প্রারম্ভিকভাবে নিজেকে তৈরি করাটা জরুরী বলে মনে করি। তবে হ্যাঁ, উন্নত প্রশিক্ষণ ও উন্নত প্রযুক্তি আপনার চলার পথকে সহজ করে দেবে। আপনার মূল্যমান বেড়ে যাবে। এমন কি আপনি যদি উচ্চ শিক্ষিত নাও হন তাহলে সহজে স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাল চাকরী পেয়ে যেতে পারেন।

পৃথিবীর অন্যান্য ক্যারিয়ারের মত পর্যটনে ক্যারিয়ার সমূহ আপনাকে আকৃষ্ট করবে যেমন ট্র্যাভেল এজেন্ট, হোটেল ম্যানেজার, ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, এক্সিকিউটিভ শেফ, পিআর ম্যানেজার ইত্যাদি। আপনার জেনে ভাল লাগবে যে মালদ্বীপ, ভুটান, সেশেলস, কম্বডিয়ার মত ছোট দেশগুলির প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পর্যটন খাত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। পর্যটন খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। বাংলাদেশ পৃথিবীরে বৃহত্তম বদ্বীপ। ভ্রমণ ও পর্যটনে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনন্য দেশ। পৃথিবীতে আপনি এমন কোন দেশ খুঁজে পাবেন কিনা যার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি-এতটা প্রাচুর্যময় যা মানুষকে ভ্রমণে আকৃষ্ট করে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ যদি আপনার ভাল লাগে তাহলে আপনি সহজে ভ্রমণ করতে পারেন।

নৌ পর্যটন : বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা করুণ হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই এমন নদীবিধৌত ভূখণ্ড নেই। তাই আরামদায়ক ও পরিবেশ-প্রকৃতিবান্ধব পর্যটন হিসেবে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবা দরকার। রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, খুলনা, বাগেরহাট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে নৌ পর্যটন জনপ্রিয়তা পেতে পারে। আমরা জানি, শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো সুগম করা এবং পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টির লক্ষ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করার জন্য খাল কেটে নদী এবং সাগরের পানি শহরের ভেতর আনা হয়েছে। এসব কারণে ভারতের কেরালা, জম্মু কাশ্মির কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসে নৌ পর্যটন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে অগ্রসর হলে নৌ ট্যুরিজম আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে।

হাওরাঞ্চলের পর্যটন : হাওরের সৌন্দর্যে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত পর্যটকরা বিমোহিত হয়েছেন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। আশার খবর হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। শীতে কুয়াশাচ্ছন্ন হাওরে থাকে অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ। বর্ষায় হাওরের ছোট ছোট দ্বীপের মতো বাড়িঘর। আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও হাওরের রয়েছে অনন্য অবদান। হাসন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে হাওরাঞ্চলের সঙ্গীতভান্ডার। হাওরাঞ্চলের হিজল-তমাল বন আকৃষ্ট করে সৌন্দর্যপিপাসুদের। দেশের সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে গঠিত হাওরাঞ্চলে শীত-বর্ষায় হাওরের স্বতন্ত্র রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় পর্যটকদের।

এ কারণে বিশাল এই হাওর বাংলাকে কেন্দ্র করে আমাদের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগমে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের এ হাওরগুলো দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, কিশোরগঞ্জ, নিকলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, তাহেরপুর, মধ্যনগর, ভোলাগঞ্জ, টেকেরহাট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালগঞ্জ- এসব জায়গায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। হাওর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা খুবই জরুরি। হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ, ডুবু সড়কসহ হাওরের অমসৃণ রাস্তায় চলাচলের উপযোগী মোটরসাইকেলের মতো তিন চাকার বিশেষ বাইক তৈরি করা প্রয়োজন- যাতে চালকসহ তিন-চারজন যাত্রী বহন করা যায়।

স্পোর্টস ট্যুরিজম : বাংলাদেশের স্পোর্টস ট্যুরিজম বিষয়ে এফবিসিসিআই স্ট্যান্ডিং কমিটি অন স্পোর্টস ট্যুরিজম আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয়, বাংলাদেশের স্পোর্টসকে যদি সত্যিকার অর্থে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হবে। এশিয়ান জার্নাল অন স্পোর্টস অ্যান্ড ইকোনমির একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ক্রীড়া পর্যটনে এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলো হলো- ভারত ১১ শতাংশ, চীন ১০ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৯ শতাংশ, কোরিয়া ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৫ শতাংশ ও নেপাল ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ অংশীদারত্ব ২ ভাগেরও নিচে। আমাদের গ্রামীণ খেলা নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, বলী খেলাগুলো যদি বিশ্বে প্রচার করা যায়, তাহলে বাংলাদেশকে Truely Sports Loving Country হিসেবে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।

ইসলামিক পর্যটন : ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের তাবরিজ শহরকে ২০১৮ সালের জন্য ইসলামিক পর্যটন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা জানি, পর্যটন শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে সৌদি সরকার পবিত্র ওমরাকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘ইসলামিক ট্যুরিজমে’র উদ্যোগ নিয়েছে। সৌদি সরকারের এমন উদ্যোগের সঙ্গে অনেকটাই একমত বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। বাংলাদেশে ধর্মীয় ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক শারমিন সুলতানা। তার গবেষণায় বলা হয়েছে, মসজিদ, মন্দির ও গির্জা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। একইভাবে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমাও হয়। এটিও সুশৃঙ্খলভাবে করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প

পর্যটনের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সম্মেলনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য একটি আন্তর্জাতিক খসড়া প্রস্তাব অনুমোদিত হয়, যা এজেন্ডা-২১ নামে পরিচিত। সুন্দর ও দূষণমুক্ত জলবায়ু পর্যটন শিল্পের অন্যতম উপাদান। কেননা পর্যটকদের ভ্রমণস্থান, গমন ও গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই পর্যটন শিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায়ও পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। আমাদেরও মনে রাখা দরকার, সিডরের কারণে সুন্দরবনের বিধ্বস্ত অবস্থা বাংলাদেশের পর্যটন অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য চাই সুন্দর, দূষণমুক্ত, গুণগত মানসম্পন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ।

অনিন্দ্য সুন্দরম বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মতো ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের আছে মনোরম পাহাড়, আছে নদী, আছে দিগন্ত বিস্তৃত ভাটি-বাংলার হাওর, সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ তো আছেই। আছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, ময়নামতি বিহার, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের চা বাগান আর আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনধারা। এ ছাড়া আছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, মাধবকুণ্ডের ঝরনা, ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প, রেশম শিল্প, খাদি শিল্প, জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান, বাংলার বিচিত্র পেশা, ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ভাস্কর্য ও স্থাপনা, চিরসুন্দর গ্রামীণ জনপদ, হাটবাজার, মেলা-কৃষ্টি-কালচার, কৃষক-কৃষাণির সংগ্রামী জীবন, বাংলা নববর্ষের উৎসব- এ সবকিছুই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওর পরিযায়ী পাখির জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্থান। এই জলাশয়টিকে জাতিসংঘের রামসার কর্তৃপক্ষ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ২০০০ সালে স্বীকৃতি দিয়েছে।

হাকালুকি হাওর এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আরো আছে— তিন পার্বত্য জেলা, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, সোনাদিয়া, পতেঙ্গা, মৌলভীবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ অনেক স্থান, পাহাড়পুর বিহার, শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, রানী ভবানীর কীর্তি, বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গির্জা। আরো আছে ময়নামতি, রামসাগর, সোনারগাঁ, নাটোর, রাজবাড়ি, দীঘাপাতিয়া জমিদার বাড়ি, তাজহাট জমিদার বাড়ি, কক্সবাজারের বৌদ্ধমন্দির, ঢাকার লালবাগ দুর্গ, আহসান মঞ্জিল, গৌড় লক্ষণাবতী শহর, বাগেরহাটের অযোধ্যা মঠ ইত্যাদি। এসব স্থান ভ্রমণপিপাসু বিশ্ববাসীর কাছে আকর্ষণীয় এবং তাদের অবকাশ কাটানোর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে।

সমুদ্র সৈকতের কক্সবাজারকে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করে বিদেশি পর্যটক আনাসহ অনুকূল সুবিধা সৃষ্টি করতে পারলেই সমুদ্রসৈকত দুনিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম কক্সবাজার থেকে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা সম্ভব। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন, সিলেটের দীর্ঘতম চা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই হ্রদ, সিলেটের জাফলং, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত; নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও শেরপুরের প্রত্নসম্পদ। নওগাঁর পালযুগের গৌরব পাহাড়পুর, কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধবিহার, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি আর খাগড়াছড়ির গাছপালা, পাহাড়-জঙ্গল, ঝরনা আর মেঘের ভেলা, রাঙামাটির কাসালং, সাজেক, বাঘাইছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, লংগদু, নানিয়ারচর, রাজস্থলী, চন্দ্রঘোনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় শ্যামল বাংলার রূপলাবণ্য, নদীর দেশ চাঁদপুর, বরিশাল, পিরোজপুর আর ঝালকাঠিতে দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি আছে নদী ভ্রমণের অপূর্ব সুযোগ।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চমক আনতে পারে পর্যটন শিল্প

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বহাল রাখতে পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীতে বর্তমানে ১৪০ কোটিরও বেশি পর্যটক রয়েছে। এই সংখ্যা আসন্ন বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০২৫ সাল নাগাদ, ২০০ কোটি হবে। এর আগে কোভিড মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায়। তবে ধীরে ধীরে এই সংখ্যা আবারও বাড়ছে।

গবেষণা বলছে, এই বিপুল পর্যটকের ৭৫ শতাংশ পর্যটক ভ্রমণের জন্য বেছে নেবে এশিয়া। আর সেখানেই বাংলাদেশের পর্যটন খাতকেনিজের সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে। এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবারের বাজেট। বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতে আছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এর ভেতর সরাসরি জড়িত আছেন ১৫ লাখ আর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে প্রায় ২৩ লাখ। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করছে। এই সংখ্যাটি সন্তোষজনক হলেও এর মাত্র ২ শতাংশ বিদেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট ১৬ লাখ ৪০ হাজার পর্যটক আসে। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ২৮ শতাংশ অনাবাসী বাংলাদেশি। বাকি ২ লাখ ৯১ হাজার জন বিদেশি পর্যটক। করোনা মহামারিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আরও কমেছে।আর হতাশার বিষয় হলো, ইনক্লুসিভ ডেভলপমেন্ট ইনডেক্সের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে কাজে লাগিয়ে প্রবৃদ্ধির এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখানে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সাল জুড়ে আমাদের দেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ২৯৫, যার অধিকাংশ ভারতীয়।

বর্তমানে দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও পর্যটকদের মনের ভয় এখনো দূর হয়নি। নিরাপত্তাজনিত ভয়ে পর্যটকদের অনেকেই আসছেন না। নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সঠিকভাবে তুলে ধরাতেও গাফিলতি আছে বলে মনে করেন পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমাদের পর্যটন শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের পর্যটনে বিভিন্ন উপখাতের ব্যবসায় জড়িত পর্যটন অংশীজনদের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।আর বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে জানিয়ে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশে আন্তর্জাতিক মানের উড়োজাহাজ পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের মধ্যে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালের নির্মাণকাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে।

পরিশেষে বলতে চাই, ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের ক্ষুদ্র একটি দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আকার-আকৃতিতে ক্ষুদ্র হলে কী হবে, বাংলাদেশের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য। আর আছে এ দেশের অপার সৌন্দর্য। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এ দেশের সৌন্দর্যে তাই যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর জগদ্বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা নৌকাযোগে সোনারগাঁ থেকে সিলেট যাওয়ার পথে নদীর দুই কূলের অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিলেন। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের হলেও বিদ্যমান পর্যটন আকর্ষণে যে বিচিত্রতা, সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে।আর বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু এ বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা।

পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবপক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে। আর বাংলাদেশের পর্যটনের টেকসই বিকাশ এবং উন্নয়নে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ পর্যটনের বিকাশে গতি আনতে পারে। সেইসাথে দেশের পর্যটন শিল্পের প্রচার ও উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর, হোটেল ও এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে।

লেখক :প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় একটি দেশ। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বের অনেক দেশেই বিরল। পর্যটন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষকে কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করেছে। প্রতি ১০ জনের ১ জন কোন না কোন ভাবে পর্যটন খাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রশ্ন আসতে পারে - পর্যটন খাতে আসতে হলে আপনাকে কি খুব বেশি প্রশিক্ষিত ও উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসতে হবে? আপনাকে এই জটিল ভাবনা থেকে বের হয়ে প্রারম্ভিকভাবে নিজেকে তৈরি করাটা জরুরী বলে মনে করি। তবে হ্যাঁ, উন্নত প্রশিক্ষণ ও উন্নত প্রযুক্তি আপনার চলার পথকে সহজ করে দেবে। আপনার মূল্যমান বেড়ে যাবে। এমন কি আপনি যদি উচ্চ শিক্ষিত নাও হন তাহলে সহজে স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাল চাকরী পেয়ে যেতে পারেন। পৃথিবীর অন্যান্য ক্যারিয়ারের মত পর্যটনে ক্যারিয়ার সমূহ আপনাকে আকৃষ্ট করবে যেমন ট্র্যাভেল এজেন্ট, হোটেল ম্যানেজার, ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, এক্সিকিউটিভ শেফ, পিআর ম্যানেজার ইত্যাদি। আপনার জেনে ভাল লাগবে যে মালদ্বীপ, ভুটান, সেশেলস, কম্বডিয়ার মত ছোট দেশগুলির প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পর্যটন খাত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। পর্যটন খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। বাংলাদেশ পৃথিবীরে বৃহত্তম বদ্বীপ। ভ্রমণ ও পর্যটনে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনন্য দেশ। পৃথিবীতে আপনি এমন কোন দেশ খুঁজে পাবেন কিনা যার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি-এতটা প্রাচুর্যময় যা মানুষকে ভ্রমণে আকৃষ্ট করে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ যদি আপনার ভাল লাগে তাহলে আপনি সহজে ভ্রমণ করতে পারেন।

পাঠকের মতামত:

২৮ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test