E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় 

২০২২ অক্টোবর ০৭ ১৬:৩০:৩০
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় 

মোঃ গোলাম রব্বানী


শিক্ষার মূলভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা, আর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। শিক্ষা সম্পর্কে একটি সম্মক ধারনা হচ্ছে শিক্ষা মানুষের চিন্তার উৎকর্ষ সাধন ও অন্তর্নিহিত শক্তি গুলোকে বিকশিত করে। আধুনিককালে শিক্ষার ব্যবহারিক মূল্যকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ মানুষের জ্ঞানগত পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার দক্ষতা তৈরিতে শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য।

একজন শিশু কীভাবে কথা বলবে, কীভাবে অন্যের সঙ্গে মতবিনিময় করবে, ভাববে ও চিন্তা করবে তা, শেখার প্রক্রিয়াকে আমরা সামাজিকরন বলি। অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তির চিন্তা কাঠামো, জীবনবোধ ও দক্ষতা তৈরি হয় তার নাম সামাজিকরন। সামাজিকরনের একটি উল্লেখযোগ্য বাহন হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু একজন ব্যক্তির চিন্তা কাঠামো তৈরি করে দেয় না, বরং তার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারন করে দেয়। শুধু পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক, পরীক্ষা পদ্ধতি কিংবা শিক্ষার নিয়মকানুন দিয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হয় না। শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় আলাদা পরিবেশ, অবকাঠামো ও পারিপার্শ্বিকতা। গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার জন্য শিক্ষার্থীকে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হয়।

গ্রামীন প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করা অনেকটা কষ্টসাধ্য। তবে একথা সত্য যে, সমাজের চেহারা আজ বেশ পাল্টে গেছে। সাধারন মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে। রুচিতে রুপান্তর এসেছে। পরিবর্তন হচ্ছে দৃষ্টি ভঙ্গিতে। পরিবর্তিত এ প্রেক্ষাপটে ২০৩০ সালের মধ্যে মান সম্মত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে তরুন জনগোষ্ঠীকে দক্ষ সম্পদে বদলে ফেলার নতুন চ্যালেঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বকে সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এছাড়া মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকার শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। আগে যেখানে এসএসসি পাশ করা নারী শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ দেয়া হতো এখন সেখানে স্নাতক পাশ বাধ্যতামূলক। নিয়োগ পরীক্ষা গুলো হচ্ছে যথেষ্ঠ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যদিও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন চক্র অসাধু উপায়ে সফল হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। স্বচ্ছতার কারনে আজ মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। আর এর সুফল পাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

আজ একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় সমাজের এলিট শ্রেণির অভিভাবকেরা শহরের অভিজাত বাংলা বা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলই তাদের প্রথম পছন্দ মনে করেন। তাদের সন্তানকে ঐসব এলিট বিদ্যাপীঠে লেখাপড়া করিয়ে তারা খানিকটা গর্ববোধ করেন। অপর দিকে ছিন্নমূল, অসহায় শিশুদের ঠাঁই হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যা অনেকটা উদ্বেগের কারন।

এছাড়াও অসুস্থ প্রতিযোগিতা গুলো সর্বত্রই আমাদের মাঝে শিক্ষা সেবায় প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। শিশুকে শুধু মেধা তালিকায় প্রথম নয়, দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়ার দীক্ষা দিতে হবে। প্রতিযোগিতা যেন সুস্থতার গন্ডি ছাপিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুর প্রতি কোনো কিছু না চাপিয়ে দিয়ে বরং যে যেটা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেদিকেই তাকে যেতে দেওয়া উচিত।

গতানুগতিক শিক্ষার বদলে যাতে শিক্ষার্থী জীবনমূখী ও কর্মমূখী দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হয় সে লক্ষ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষানীতির পথরেখায় দেশের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জলাবায়ু, ভূ-রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং সর্বোপরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাশাসিত নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে অভিযোজিত হয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগপোযোগী করে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এছাড়া ক্লাসরুম, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষা খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার মান কিছুটা হলেও উন্নত করা যাবে।

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও বিশ্ব পরিচয় সকল বিষয়েই পাঠদান করতে হয়। কিন্তু কো-কারিকুলাম বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে কখনো চারু ও কারুকলা, সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে একজন শিক্ষক এক্সাপার্ট হতে পারে না। বিষয় জ্ঞান সম্পর্কে সম্মক ধারনা না থাকলে সেই শিক্ষাদান হইতে আর যাইহোক মান সম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। আর এর জন্য প্রয়োজন বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দান। তাহলেই সেই ক্লাসের গুনগত মান ঠিক থাকবে। তখনই মান সম্মত শিক্ষা দান করা একজন শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশা করা যাবে।

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজের পরিধি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন ধরনের তথ্যের জন্য প্রধান শিক্ষককে বেশির ভাগ সময় বিদ্যালয়ের বাহিরে গিয়ে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন রেজিষ্ট্রার হালফিল করতে হয়। দাপ্তরিক কাজের কারনে প্রধান শিক্ষকগণ শ্রেণি কার্যক্রমে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে না থাকলে শ্রেণি কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা হয় না। এটি চিরন্তন সত্য। এসব থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে অফিস সহকারি কাম-কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে মান সম্মত শিক্ষার যে লক্ষ্যমাত্রা সেটি নিশ্চিত করা অনেকটা সহজ হবে।

মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থাও অনেকটা দায়ী, বিশেষ করে গ্রামীন পর্যায়ের আর্থসামাজিক অবস্থা ভীষন প্রকট। গ্রামের অধিকাংশ মানুষকে দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে প্রতিনিয়ত চলতে হয়। যারা স্বচ্ছল পরিবার তারা শহরে অবস্থান করে, তারা পড়ালেখার যথেষ্ঠ সচেতন, কিন্তু গ্রামের মানুষ ততটা সচেতন নয়। গ্রামীন জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোক নিরক্ষর, শিক্ষার প্রতি তাদের সচেতনতা নেই বললেই চলে। পেটে ক্ষুধা রেখে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করা সহজ নয়। গ্রামীন শিক্ষার্থীদের দ্বারা ভালো কোনো পোশাক, খাতা, কলমসহ যে কোনো শিক্ষাপোকরণ ক্রয় করা কষ্টসাধ্য বিষয়। দারিদ্রতার কারনে গ্রামের শিশুরা একটু বয়স বাড়ার সাথে বিভিন্ন শিশুশ্রমে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে একমাত্র দারিদ্রতার কারনে তারা শিক্ষা গ্রহন করতে পারছে না। যদিও সরকার শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরন, কোনো কোনো এলাকায় বিস্কুট বিতরন করছে সেটি আসলে যথেষ্ঠ নয়।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদেরও বিভিন্ন প্রনোদনা দিতে হবে। শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও সহকারি শিক্ষকরা ১০-১৫ বছর পর পদোন্নতি পায় প্রধান শিক্ষক পদে। সেটি দেয়া হয় আবার স্ব-বেতনে। শুধু চেয়ার বদল হচ্ছে। কিন্তু আর্থিক ভাবে তারা অতিরিক্ত বেনিফিট পায় না এবং আর্থিকভাবেও তাদের গ্রেড পরিবর্তন করা হয় না। অপরদিকে প্রধান শিক্ষকদের কোনো পদোন্নতি নেই, দীর্ঘ সময় তারা একই পদে থেকে চাকুরী শেষ করে। একই পদে দীর্ঘসময় কখনোই ভালো করে মনোনিবেশ করা যায় না। পদের পরিবর্তন হওয়া দরকার। তাদেরকে নির্দিষ্ট মানদন্ডের ভিত্তিতে সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়ন করা দরকার তাহলেই শিক্ষকদের মধ্যে গতি চলে আসবে। নিশ্চিত হবে মানসম্মত শিক্ষা, কেননা মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ভূমিকা যথেষ্ঠ প্রয়োজন। শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে। এজন্য শিক্ষক সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।

সর্বোপরি, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। সব সমস্যার সমাধান হয়তো আমাদের একসাথে সম্ভব নয়, কারন সেই সক্ষমতা আমাদের নেই। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার গুনগত মান বাড়াতে হবে, সে লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, দুবলাগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পলাশবাড়ী, গাইবান্ধা।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test