E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মমতাময়ী মা কেন কাঁদবেন ?

২০২২ অক্টোবর ২০ ১৫:০৮:০৪
মমতাময়ী মা কেন কাঁদবেন ?

চৌধুরী আবদুল হান্নান


কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মা কেন কাঁদবেন ? খবরটি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের। রুহুল আমিন চাইতেন প্রথম সন্তান ছেলে হোক কিন্ত স্ত্রীর কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে কন্যা। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার আপরাধে আফরোজা আক্তারের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। শেষ পর্যন্ত তা থামলো তালাকের মাধ্যমে। এলাকার গণ্যমান্যদের নিয়ে সালিশ বৈঠক হলেও মন গলেনি রুহুল আমিনের। সালিশে তিনি সাফ জানিয়ে দেন — কন্যা সন্তানের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে চান না তিনি। স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে এখন বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন আফরোজা। পরের খবরটি বগুড়ার শেরপুরের।

স্ত্রী রাবেয়া খাতুন দ্বিতীয়বার কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ লেগেই থাকত, এক পর্যায়ে গভীর রাতে মায়ের পাশ থেকে ১৪ মাস বয়সী ঘুমন্ত শিশু কন্যা হুমায়রাকে তুলে নিয়ে পুকুরেফেলে হত্যা করে পাষন্ড পিতা জাকির হোসেন।

এ ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন খবর নয়, দেশের সামগ্রিক চিত্র এবং এ সকল ঘটনা অন্ধকার যুগেআরবে কন্যা সন্তান জন্মের পর জীবন্ত কবর দেওয়ার বর্বর সেই আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

অনেক সময় একাধিক কন্যা সন্তান জন্মের জন্য নারীকে দায়ী করা হয় এবং মর্মান্তিকভাবে সুখের সংসারে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর আগমন ঘটে। অথচ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে অর্থাৎ সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সেক্ষেত্রে মায়ের কোনো ভূমিকা নেই, ১০ মাস গর্ভে ধারণ করা ছাড়া।

বায়োলজিক্যালি প্রমানিত এবং মিমাংসিত সত্য যে, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় কেবল পিতার ক্রোমোজম দ্বারা। অথচ কন্যা সন্তানের “জন্ম দায়” যুগ যুগ ধরে এককভাবে বহন করে চলেছে নারী আর অকারণে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে এবং সেকারণে অনেকের ক্ষেত্রেই শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে যেতে হয় বাবার বাড়িতে।

সন্তান জন্মের সময় মায়ের মৃত্যু-ঝুকি থাকে, এমন ভাবনা থেকেই প্রসূতিকে তাঁর পছন্দের খাবার দেওয়া হয়। বলতে গেলে, সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আতুর ঘরে প্রবেশ করেন প্রসবিনী মা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত উন্নতির যুগেও অনেক সময় মায়ের প্রসবকালীন জটিলতায় চিকিৎসককে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় কাকে বাঁচাবেন ? মাকে নাকি সন্তানকে ? কারণ দু’জনকে বাঁচানো যাবে না।

মায়ের শরীর থেকে খাদ্য নিয়ে গর্ভের ভ্রূণ ধীরে ধীরে বড় হয়ে মানব শিশুর পূর্ণতা নিয়ে ভূমিষ্ট হয় এবং নাড়ি কেটে সন্তানকে মায়ের শরীর থেকে আলাদা করা হয়। ঘর আলো করে আসা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মা তাঁর সকল কষ্ট ভুলে যায় আর আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ।

কিন্ত কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সম্ভাব্য বিভীষিকার আশংকায় যদি তাকে কাঁদতে হয়, এর চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা আর কী হতে পারে ?

গর্ভে সন্তান ধারনের জন্য তাঁর শরীরে যে ধকল গেছে, স্বাস্থ্যহানী হয়েছে তা পূর্ণ করা যখন জরুরি তখনতাকে মোকাবিলা করতে হয় নিরন্তর মনোকষ্ট। তাঁর এখন বিশ্রাম ও ভালো খাদ্যের প্রয়োজন , স্বজনদের সহমর্মিতা প্রয়োজন কিন্ত তাঁর জন্য বরাদ্ধ রয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

রসুল (স.) সেই যুগে ঘোষণা করেছিলেন, “যার প্রথম সন্তান মেয়ে সে জান্নাতি, যার পর পর দু’টি সন্তান মেয়ে সেও জান্নাতি।”

ধর্মীয় অনুভূতিমূলক রসুল (স.) এর এমন অসাধারণ ঘোষণা মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক, সন্দেহ নেই ।

পিতৃতান্ত্রিক আমাদের এ সমাজে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের মূল কারণটি না জানার অজ্ঞতার জন্য কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় অকারণে নারীকে দায়ী করা হয় এবং নারীর দুর্দশা লাঘব হয় না।

আজকের কন্যা শিশু আগামী দিনের নারীকূলের শিরোমণি মা, মানব জাতির জন্য সৃষ্টিকর্তার অনন্য উপহার। মা হচ্ছেন সন্তানের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং অকৃতিম মমত্ববোধ ও ভালোবাসার এক অনন্ত উৎস।

মায়ের দুধ কেবল শিশুর বেঁচে থাকার খাদ্যই নয়, সারা জীবনের জন্য রোগ প্রতিরোধ শক্তির জোগানদাতা। কর্মজীবী মা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেও তাঁর বিশ্রাম নেই — সন্তান, সংসার সামলাতে হয়। নারী ঘরে না ফেরা পর্যন্ত সংসারটা যেন থেমে থাকে। নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া একটি জাতির অগ্রগতিপূর্ণতা পায় না। অনেক সময় আলাপচারিতায় কেউ প্রশ্ন করেন, ভাই আপনার ছেলে মেয়ে কয়টি ? উত্তরে বলি — আমার দু’টি মেয়ে। আবার তাৎক্ষণিক প্রশ্ন — কেন, আপনার কোনো ছেলে নেই ? এমন মানসিকতা দূর করতে হবে, কন্যা বা পুত্র, কোনো বৈষম্য না করে ভাবতে চাই — ওরা আমার সন্তান।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test