E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হুদহুদের খোঁজে....

২০১৪ অক্টোবর ১৬ ১৮:৪৮:৫১
হুদহুদের খোঁজে....

মঈনুল ইসলাম রাকীব : সম্প্রতি গণমাধ্যমে যে শব্দটি ঘন ঘন প্রচারিত হচ্ছে তা হলো-'হুদহুদ'। এটি একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম যা বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে সৃষ্টি হয়ে ১১ অক্টোবর ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যার উপর আঘাত হানে। ভারতের উক্ত উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ ১৬৫ কিলোমিটার বেগে হুদহুদ আছড়ে পড়ে যা এখন পর্যন্ত কমপক্ষে সাত জনের মৃত্যুর ও কয়েক হাজার ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ ।

যা হোক আমরা ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি বা গতি প্রকৃতি নিয়ে না ঝড়ের নাম নিয়ে এখানে আলোচনা করবো? কি থেকে আসলে হুদহুদ নাম রাখা হলো বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের সেটা জানার আগ্রহ রয়েছে আমাদের অনেকের । এখানে হুদহুদ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনা দেওয়ার চেষ্টা।

২।
“ হুদহুদ ” একটি আরবী শব্দ। এটি একটি পাখির নাম হিসেবে ব্যবহৃদ হয় । এই পাখির নাম মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সুরা “ নাহল ” এ সরাসরি 'হুদ' নামে দুইবার উল্লেখ আছে। এছাড়াও 'হুদ' নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা রয়েছে কোরআনে।


হুদহুদ ছিল নবী সুলাইমান (আ) এর দূর যোগাযোগের মাধ্যম। নবী ও সম্রাট দাউদ আ (যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা ডেভিড বা করহম উধারফ বলে) এর পুত্র সুলাইমন (করহম ঝড়ষড়সধহ) ছিলেন ফিলিস্তিনসহ এর আশেপাশের এক বিশাল ও সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের অধিপতি। তাঁর সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিল সেসময়ের সেরা, বাতাস তাঁর কথা শুনতো বলে কোরআনে আছে। সম্ভবত সেসময়ের পৃথিবীতে সুলাইমান বাতাসে ভেসে শূন্যে উড়ার কোন বাহন তৈরি করেছিলেন বলে এই বর্ণনা এসেছে। তিনি জীব জগতের সব প্রাণীর ভাষা বুঝতেন। এই সূত্রে হুদহুদ পাখির সাথে তার কথপোকথন কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।


এই পরাক্রমশালী সম্রাট ঐসময়ের অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য সাবার রানী বিলকিসের খোঁজ নিতে হুদহুদ পাখিকে পাঠিয়েছিলেন বলে কোরআনে এক দীর্ঘ কাহিনীর ইঙ্গিত আছে। হুদহুদ খবর নিয়ে আসে যে সাবায় এক নারী ক্ষমতাসীন এবং সে রাজ্যে সূর্যকে পূজা করা হয়। সুলাইমান তখন হুদহুদের কাছে লিখিত বার্তা সাবার রানী বিলকিসের কাছে পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল 'আল্লাহর নামে শুরু করছি। সূর্যকে উপসনা ছেড়ে আল্লাহর উপসনা করো এবং আমাকে (সুলাইমান) আল্লাহর বার্তাবাহক হিসেবে মানো।'


এর উত্তর নিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিলেন নবী সুলাইমান (আ) এবং তিনি হুদহুদের ফেরায় দেরি হওয়ায় বেশ বিরক্তি ও রাগও প্রকাশ করেন। সুলাইমান কোরআনে উল্লিখিত তিনজন মহান ও ন্যায়পরায়ন অধিপতির একজন। অপর দুইজন হলেন জুলকারনাইন ও দাউদ ।
“ সাবা ” প্রাচীন ইয়েমেনও এর আশেপাশের অঞ্চলের নাম এবং বর্তমান ওমান এই সাবার প্রাচীন ও গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি অংশ। ওমান ভারতে আঘাত হানা সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়টির নাম দিয়েছে “ হুদহুদ ”। উপমহাদেশের ঘূর্ণিঝড়ের নাম ওমান দিবে কেন এটাই তো প্রশ্ন,তাই না?


৩।
World Meteorology Organization (WMO)জেনেভা কেন্দ্রিক জাতিসংঘের একটি অঙ্গসংগঠন যেটি বিশ্বের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। ১৯৫৩ সালের পর থেকে এটি সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়ে আসছে। তবে তখনো দক্ষিণ এশিয়ার ঘূর্ণিঝড়গুলোর কোন নাম দেওয়া হতোনা তখন পর্যন্ত। একারণেই বাংলাদেশকে তছনছ করে দেওয়া ৭০ এর প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের কোন নাম নেই, ৯০ এর বা তারপরের গুলোরও নেই।


২০০৪ সাল থেকে এই উপমহাদেশের ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করতেWMO একটি সম্মেলন আহবান করে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশসহ আরো ৭টি দেশ অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ ৮ টি করো মোট ৬৪ টি নাম দেয় যা ভবিষ্যতে আঘাত করতে আসা ঘূর্ণিঝড়ের জন্য নির্ধারিত হয়। ৮টি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা,থাইল্যান্ড, ভারত,পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ওমান। ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের দায়িত্ত্ব সম্মেলনের সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের নামের ইংরেজি বর্ণক্রমানুসারে একেকটি দেশের উপর ন্যাস্ত হয় । ২০১৪ এর অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণের ভার পড়ে ওমানের ওপর এবং ওমান আরবী ভাষায় নাম দেয় 'হুদহুদ' ।

৪।
আরবের ছোট্র রাষ্ট্র ওমান কর্তৃক ঘৃর্ণিঝড়ের 'হুদহুদ' নামকরণের কারণে প্রাচীন পৃথিবীর সমাদৃত এ পাখিটি সম্পর্কে অনেকেই নতুন করে জানতে আগ্রহী হচ্ছে ।

বাংলাদেশ,পাকিস্তান ও ভারতীয় গণমাধ্যমসহ পশ্চিমা গণমাধ্যমেও হুদহুদের এখন জয়জয়কার। বিবিসি, ইন্ডিয়াটুডের মত বিখ্যাত সংবাদমাধ্যমে ব্যবহারিক শব্দ হিসেবে 'হুদহুদ' নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত গুগলের অনুসন্ধান বক্সে সাম্প্রতিক সময়ে শান্তিতে নোবেল জয়ী সিদ্ধার্থের মতই সর্বাধিকবার খোঁজা হয়েছে 'হুদহুদ' কে।
হুদহুদ পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান ঘূর্ণিঝড়ের নাম রেখেছে নীলুফার।


বাংলাদেশও রেখেছে ঘূর্ণিঝড়ের নাম। নার্গিস, আইলা প্রভৃতি বাংলাদেশের দেওয়া নাম। তবে ওমানের রাখা আরবী নাম হুদহুদ বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের তথ্যস্পৃহ জনগণের মধ্যে।


৫।
হুদহুদ পাখি মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যে বেশ পরিচিত একটি নাম। উপমহাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের নাম হওয়া এ পাখিটির ইংরেজি নাম Hoopoe এবং এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতীর পাখিগুলোর একটি। প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের সাহিত্য ও চিত্রকর্মে হুদহুদকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা ও চিত্রায়িত করা হয়েছে । আধুনিক ইরানের নাগরিকরা হুদহুদ পাখিকে এখনো পবিত্রতার বাহক মনে করে। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় হুদহুদ শুভ্রতার চিহ্ন এবং গ্রীকরা হুদহুদকে শান্তির প্রতীক ভাবতো।


বর্তমান পৃথিবীর ক্যান্সার অবৈধ ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাঈলের জাতীয় পাখি হুদহুদ । ইহুদীদের পূজনীয় সম্রাট সুলাইমানের যোগাযোগের বাহন হওয়ায় ইহুদীরা ২০০৮ সালে সর্বসম্মতভাবে হুদহুদকে জাতীয় পাখি ঘোষণা করে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো হুদহুদ পাখির ছবি সংবলিত। এছাড়া প্রাচীন আরব্য, পারস্য, রোমান, মিশরীয় ও হিব্রু সাহিত্য ও চিত্রকর্মে হুদহুদ পাখির উজ্জ্বল উপস্থিতি আছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রতিশব্দ হয়ে আমাদের কাছে পরিচিতি পেলেও প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত মানব সমাজে হুদহুদ পাখির ঐতিহাসিক উপস্থিতি সত্যিই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর !

(এমএইচ/এএস/অক্টোবর ১৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test