E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গুণগত শিক্ষা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাড়াতে হবে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা 

২০২৩ ফেব্রুয়ারি ১৫ ১৮:৫১:০০
গুণগত শিক্ষা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাড়াতে হবে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা 

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


একটি দেশের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে একটি লাভজনক বিনিয়োগ। শিক্ষায় বিনিয়োগ হলে শিক্ষিত ও চৌকস জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। নতুন নতুন গবেষণার ফলে দেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গন আলোকিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থা তার উল্টো। এ দেশের শিক্ষকরা সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। দেশে বহুল আকাঙ্ক্ষিত চাকরির অন্যতম হলো বিসিএস। বিসিএসের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডার প্রথম পছন্দ দিয়েছেন এমন প্রার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেখা গেছে, প্রার্থীরা শেষ পছন্দ হিসেবে শিক্ষা ক্যাডার দিয়ে থাকেন। ফলে যারা এখন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বিভিন্ন সরকারি কলেজে চাকরি করছেন, তাদের সবাই সমান দক্ষতা নিয়ে শিক্ষকতায় এসেছেন। শিক্ষকতা পেশার কেন এ অবস্থা? দেশে অন্যান্য পেশার তুলনায় শিক্ষকতা পেশা মোটেও আকর্ষণীয় নয়।

বিসিএস পরীক্ষায় একই সিলেবাস ও একই প্রশ্নের পরীক্ষায় পাস করেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের সুযোগসুবিধা অন্যান্য ক্যাডারের সুযোগসুবিধার তুলনায় আকাশপাতাল পার্থক্য। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আগের চেয়ে বাড়লেও মর্যাদায় এগোচ্ছে না। প্রাথমিকের শিক্ষকরা এখনও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, যা বিশ্বে বিরল। মাধ্যমিকের শিক্ষকরা দুই-দিন বছর আগে দ্বিতীয় শ্রেণির পর্যাদা পেয়েছেন।

তার মানে তারাও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। সামরিক-বেসামরিক যেকোনো পেশায় যোগ দিলে তার সিনিয়র সচিব বা তদূর্ধ্ব মর্যাদা উন্নীত হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মর্যাদা রাষ্ট্রীয় পদক্রমে যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদায় সিল করে দেওয়া হয়েছে। এর ওপরে ওঠার সুযোগ নেই। শিক্ষকের মর্যাদা যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা কেবল মুখে আর বই পুস্তকে। কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি আজকাল শিক্ষকের সম্মানের বিষয়ে এখন রূপকথামাত্র। আগে বলা হতো শিক্ষক সেবিলে উন্নতি হয়, আর এখন শিক্ষক ছেঁচিলে উন্নতি হয়। হামেশাই শিক্ষকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। বাদশাহ আলমগীরের ছেলে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিয়েছিলো, আর এখন শিক্ষকদের পাঁজর ধরে পুকুরে ফেলে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের দেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। ভারতে শিক্ষকতা শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। সহকারী অধ্যাপকদের বেতন স্কেল ৫৫ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। পাকিস্তানে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ১ লাখ ৪ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এর বাইরে গবেষণা, আবাসন, যাতায়াতের জন্য গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন আরও কয়েক গুণ বেশি। ভারত সরকার মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানতে বেতনকাঠামোতে সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি ও উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতনকাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি গত ১১ বছরেও। ফলে শিক্ষকদের অনেকেই বঞ্চনার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে নিজ পেশায় মনোযোগ না দিয়ে অন্যান্য কাজে ঝুঁকে পড়ছেন। আর এভাবে শিক্ষা ও গবেষণা দুটিই পিছিয়ে পড়ছে।

১৮৫০-এর দশকে বাঙালিদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন, বিদ্যাসাগর তাদের অন্যতম। তা সত্ত্বেও কেবল শিক্ষানীতিতে সরকারের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না বলে, আদর্শের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাধারণ লোকেরা তখন নাকি তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়লে খাবেন কী করে?’ তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তিনি আলু, পটোল বিক্রি করবেন, তা-ও ভালো। কিন্তু আপস নয়।

চাণক্য শ্লোকে রয়েছে, ‘শিক্ষককে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়। সৃষ্টি ও ধ্বংসের দুয়েরই বীজ লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষকের মধ্যে।’ জাতিকে ভাবতে হবে যে, জাতির মেরুদণ্ডের চালিকাশক্তিকে বঞ্চিত করে, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করে, সমাজ-রাষ্ট্রে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা যায় না। যেদিন এমন হবে ব্যাংকার ব্যাংকের চাকরি বাদ দিয়ে, পুলিশ পুলিশের চাকরি বাদ দিয়ে এমনকি লোভনীয় প্রশাসন ক্যাডার ছেড়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাবে; সেদিন বুঝব অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

ডেইলি মেইলের খবর অনুযায়ী দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ব্যান্ডন হিল প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইসাবেল রামসের বার্ষিক বেতন ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৯৮ পাউন্ড আর প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বেতন ১ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ পাউন্ড। মুসলিম মনীষী ইবনে খলদুনের তার ‘আল মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘শিক্ষকও একজন মানুষ। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো শিক্ষকেরও ব্যক্তিগত জীবনে বেঁচে থাকার উপকরণের প্রয়োজন আছে।’ মেধাবীদের শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনা গেলে, শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা গেলে, গবেষণা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে, অবকাঠামো আরও উন্নত হলে, জবাবদিহি বৃদ্ধি করা গেলে এবং রাষ্ট্র শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি আরও মনোযোগী হলে শিক্ষা ও ঘাটতি অনেকখানিই পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

কেবল সম্মান পাওয়ার আশায় কাজ করে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকেরা ওই সম্মানটুকুও পান না। কারণ, ন্যূনতম অর্থ-ক্ষমতা ছাড়া এ ধরনের সম্মান পাওয়াটা অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর করে, এবং অন্যের দয়ার ওপর যে সম্মান নির্ভর করে, সেটা ঠুনকো হতে বাধ্য। আমার সঙ্গে যাঁরা দ্বিমত পোষণ করবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অতীতের উদাহরণ টানবেন। আগে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম ছিল বলে শুধু শিক্ষিত মানুষ হওয়ার সুবাদে শিক্ষকেরা যে একধরনের মর্যাদা পেতেন, তা ঠিক। কিন্তু কেবল শিক্ষক হিসেবে কি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিতমশাইয়ের চেয়ে বেশি মর্যাদা পেতেন? গল্পটিতে এক লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে এসে প্রথাগত সামান্য একটু সৌজন্য প্রকাশ করাতে পণ্ডিতমশাই একেবারে বিগলিত হয়ে পাঠকদের বুঝিয়ে দেন, শুধু অর্থাভাবে নয়, সম্মানহীনতার কারণেও কতটা বুভুক্ষু হয়ে আছেন তিনি

সৈয়দ মুজতবা আলী সমাজের বিবেককে প্রায় চপেটাঘাত করলেন গল্পের শেষে যখন তিনি পণ্ডিতমশাইয়ের আর্থিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর পুরো পরিবারকে লাট সাহেবের কুকুরের একটি পায়ের সঙ্গে তুলনা করলেন। পণ্ডিতমশাই তাঁর শিক্ষার্থীদের গাণিতিক জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়ার ভান করে জিজ্ঞাসা করেন— বল তো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সেই কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয়, তবে প্রতি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়? …আজ্ঞে পঁচিশ টাকা।....আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙের সমান? আমি হতবাক। “বল না”। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি যে আসলে বায়বীয় কোনো বিষয় নয়, সৈয়দ মুজতবা আলী সম্ভবত এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। আর্থিকভাবে নড়বড়ে একজন শিক্ষককে যে লোকদেখানো সম্মান দেখানো হয়, তা যে যেকোনো মুহূর্তে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যেতে পারে, পণ্ডিতমশাইয়ের ছোট ছোট ছাত্রকেও তা বোঝাতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে নীতিনির্ধারকদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শিক্ষায় আরও বেশি বিনিয়োগ করবেন কি-না, বা এখানে বিনিয়োগ করলে শিক্ষকেরা তার সদ্ব্যবহার করতে পারবেন কি-না, এ নিয়ে বহুবার চিন্তা করতে হয়। অন্যদিকে মুজতবা আলীর পণ্ডিতমশাইয়ের চেয়ে শিক্ষকদের অবস্থা এখন অনেক ভালো হলেও অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁদের হতাশা বাড়ে বৈ কমে না। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য যে প্রবল তাগিদ অনুভব করা দরকার, সংগত কারণেই সেটা দুর্বল হতে থাকে।

তবে এই দুই ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ বছর বাজেটে শিক্ষায় কিছুটা হলেও বরাদ্দ বেড়েছে। এবং অন্যদিকে গত প্রায় তিন বছর ধরে শিক্ষকেরা যখনই সুযোগ পেয়েছেন বা প্রয়োজন হয়েছে, অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে শিক্ষকেরা দুটো বড় কাজ করেন। একটি হচ্ছে মিড ডে মিল চালু করা এবং অন্যটি শিক্ষার্থীদের দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রায় এক লাখ ডকুমেন্টারি তৈরি এবং প্রায় এক লাখ প্রতিবেদন লেখানো। এর সাফল্য এতটাই দৃশ্যমান ছিল যে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা ওই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এখন নতুন কারিকুলাম তৈরি করছেন। কারিকুলাম তৈরিতে আমাদের শিক্ষকেরা এর আগে কখনোই এত বড় ভূমিকা পালন করেননি।

এ বছর শিক্ষকেরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের একটা কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে যাচ্ছেন এবং আমার বিশ্বাস, তা পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টাও করবেন। চেষ্টার মাত্রা কিছুটা হলেও তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার ওপর নির্ভর করবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test