E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

যৌন নিপীড়ন রোধে চাই সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ

২০২৩ মার্চ ০৩ ১৫:৩৯:০১
যৌন নিপীড়ন রোধে চাই সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


৪ মার্চ শনিবার বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস ২০২৩। যদিও দিবসটি ঘিরে সরকারি–বেসরকারি ভাবে দেশের কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় না। বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরণের সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলে এ ধরণের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হতো।যৌন হয়রানি নারীর ক্ষমতায়নে অন্যতম অন্তরায়। ঘরে–বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।

আজকের বিষয়ে কলাম লিখেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডা. এম এম মাজেদ- শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না এ ব্যাধির হাত থেকে। নারীদের অবাধ বিচরণ হলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমনঃ– বাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদ্যসের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাদের জীবনে নেমে আসে দুবির্ষহ পরিস্থিতি। প্রতিবাদ করলে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়, তাই অনেক নিরুপায় অভিভাবক বখাটেদের ভয়ে সন্তানের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে গৃহবন্ধী করে রাখে। বখাটেদের উৎপাতে শৈশব- কৈশোর গৃহবন্ধী অবস্থায় কাটায় অনেক মেয়ে। একইভাবে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় এবং অনেক অভিভাবক মেয়েদের চাকরি করাতে চায় না। সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানান ভয়ে এ ধরণের হয়রানির বিষয়টি গোপন রাখে নারী।

বিচারহীনতার প্রবণতায় যৌন হয়রানির মতো মারাত্নক অপরাধ বেড়েই চলেছে দিন দিন।
বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে অহরহ। ২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণপরিবহণে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আরো হয়রানির আশঙ্কায় নারীরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। যৌন নিপীড়ন বন্ধে সরকারি নানবিধ উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।ব্র্যাকের এক জরিপের তথ্যানুসারে, হেনস্থাকারীদের অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পুরুষ (৪১ থেকে ৬০ বছর)বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপ-পরিষদের এক জরিপে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার। এ হার ৫৩ শতাংশেরও বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে ৫৪ শতাংশ ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন পেশায় জড়িত ১৯ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার। এছাড়াও বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।দেশে যৌন হয়রানি রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যতটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্কুল, কলেজে অনেক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় না। স্কুল-কলেজের গর্ভনিং বডি ধামাচাপা দেয়। কেউ অভিযোগ করলে উল্টো হেনস্তার শিকার হতে হয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের কোনো স্কুল-কলেজেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি নেই।পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮৮৬ জন্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ৮৮৬ জনের মধ্যে ৫৬ জন হচ্ছে ৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশু। ১০০ জন হচ্ছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু।

সংখ্যাগুলো আরেকটু বেশি হবে, কেননা কয়েক’শ ধর্ষণের শিকার নারীর বয়স সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাহলে আপনিই হিসাব করে দেখুন গড়ে প্রতি মাসে কয়জন নারী শিশু, যাদের বয়স ৬ থেকে ১৩, ওরা বাংলাদেশের পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এই সময়ে ১৪৩ জন—ওদের যুক্ত করে গড় করুন, তাহলে ভয়াবহতার রূপ আরও খানিকটা স্পষ্ট হবে। এই ৮৮৬ জন নানা বয়সী নারীর ধর্ষণের কথা বলছি, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ছিল মোটেই নয়।

এইটা হচ্ছে সেইসব খবর থেকে নেওয়া তথ্য, যেগুলো দেশের বড় চার পাঁচটা কাগজে ছাপা হয়েছে।

বাংলাদেশ ২০১০ সালে উচ্চ আদালত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি নিদের্শনা দেয়। তাতে বলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর নেতৃত্বে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কমিটিতে নারীদের প্রাধান্য থাকতে হবে। একটি বাক্সে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি তিন মাস পর ওই বাক্স খুলে যদি কোন অভিযোগ পান তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে কমিটি। তদন্তর নিরপেক্ষ ফল পেতে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। কেউ চাইলে সারাসরি কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু হাইকোর্টের নিদের্শনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের কমিটি থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই নেই।

যৌন নিপীড়ন কী?

যৌন হয়রানি এবং শরীরের অবাঞ্ছিত স্থানে অনধিকার চর্চা, সেইসঙ্গে অননুমোদিত যৌন কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করাকেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন। সহজ কথায় কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন জিঘাংসা বাস্তবায়নের অভিপ্রায়কেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন।

আক্রান্ত হয় কারা?

নারী বা পুরুষ যেকেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী, কন্যা শিশু এবং ছেলে শিশুরাই অধিকমাত্রায় আক্রান্ত হয়। আবার অনেক সময় বৃদ্ধরাও শিকার হতে পারেন।

কীভাবে আক্রান্ত হয়?

কন্যা এবং ছেলে শিশুরা খুব সহজেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ছোট হওয়ার কারণে তারা সহজে যৌন উৎপীড়ককে বাঁধা দিতে পারে না। তাই ছোট ছোট শিশুরা তাদের আশেপাশের আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিগৃহীত হয়। আমাদের পরিবারে এমন কিছু সদস্য থাকে, যাদের কখনোই আমাদের সন্তানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করি না। কিন্তু এইসব আত্মীয়স্বজন দ্বারা শিশুরা বেশি নির্যাতিত হয়। অনেক সময় শিশুরা এদের বিরুদ্ধে কিছু বললেও অনভিজ্ঞতার কারণে আমরা তাদের কথা এড়িয়ে যাই।

আর ছেলে শিশুরা এভাবে আক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজে ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিশুদের সঙ্গে নারীদেরও একটি বৃহৎ অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বিশেষ করে যেসব নারীর নিজস্ব প্রকৃত স্বাধীনতা নেই, যারা কোনো না কোনোভাবে অন্যের ইচ্ছার অধীনস্থ তারাই বেশি আক্রান্ত হয়। সেইসঙ্গে নারীদের কর্মস্থলেও দুর্বলতার সুযোগে একটি অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

শুধু তাই নয়, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও উচ্চ শ্রেণীর নারীরাও যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারণেও কিশোরী, নারী ও শিশুরাও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে যেকোনো দুর্বলতা নিয়ে নারীদের ব্ল্যাকমেইলের কারণেও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে ফেলে যৌন নিপীড়ন করা হয় নারীদের।

কাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়?

আমাদের পরিবারকে ঘিরে কিছু সদস্য থাকে, যারা বিকৃত চরিত্রের অধিকারী। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ছোট ছোট শিশুদের টার্গেট করেন। তাদের বিকৃত রুচির অভিলাষ পূরণ করেন। এইসব আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজন শিশুদের প্রলোভন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক যৌন নিপীড়ন করেন।পরিবারে কিছু সদস্য থাকেন, যাদের সঙ্গেহাসি ঠাট্টার সম্পর্ক। এইসব ভগ্নিপতি (দুলাভাই) বা দাদা সম্পর্কীয় সদস্যরাও অনেকক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন করার সুযোগ নেন। যা আমরা হাসি-তামাশার ছলে এড়িয়ে যাই। সেইসঙ্গে আদর-স্নেহ দেবার ছলেও অনেক চাচা, জ্যাঠা, মামা, খালু, ফুফা ইত্যাদি থাকে। যারা আদর করার নামে কৌশলে শিশুদের নিজের যৌন লিপ্সা পূরণে ব্যবহার করেন।

ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ শিক্ষক দ্বারা এবং আশেপাশের মধ্যবয়স্কদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ছেলেরাও যে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। দুর্বল নারীরা ঘরে এবং কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় গণপরিবহনেও নারী ও শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। মেয়েরা স্কুল কলেজে আশেপাশের বখাটের দ্বারা নিগৃহীত হয়। সামাজিক মাধ্যমে কিছু কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি দ্বারাও নারী ও শিশুরা ভার্চুয়াল যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সেইসঙ্গে মিডিয়াতে কাজ করতে আসা উঠতি মডেল বা তারকারাও তাদেরই পেশাজীবীদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

নিপীড়ন থেকে বাঁচার উপায়: যৌন নিপীড়ন থেকে শিশু ও নারীদের বাঁচাতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

সচেতনতা

শিশুদের যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে সচেতনতা। প্রতিটি পরিবারকে শিশুদের যৌন বিষয়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলে তা পরিবারকে জানাতে পারে। এই বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকেই বুঝতেই পারে না তাদের যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। সুতরাং পরিবারের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে শিশুদের যৌন বিষয়ে সচেতন করা।

শিশুর আচরণ লক্ষ করা: আমাদের অভিভাবকদের যৌন বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে শিশু এবং নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাই অভিভাবকদের উচিত এই বিষয়ে ব্যাপকভাবে চিন্তা করা। পরিবারের শিশুদের আচার আচরণের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখা। পরিবারের আশেপাশের সদস্যরা কে-কেমন রুচির অধিকারী তা জানার চেষ্টা করা। শিশুদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ থাকলে তা আগ্রহ নিয়ে শোনা এবং পদক্ষেপ নেওয়া।

শিশুদের একা ছেড়ে না দেওয়া: কোনো শিশুকেই কারো সঙ্গে একাকি যেতে না দেওয়া বা ঘরে কখনোই শিশুদের একা না রাখা। শিশুরা কারো সঙ্গে একাকি সময় দিচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখা। স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রতি শিশুদের অনীহা সৃষ্টি হলে তার কারণ অনুসন্ধান করা। সেইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা কোনো প্রকার নির্যাতনের শিকার বা তাদের কোনো প্রকার বুলিং করা হচ্ছে কিনা তা জানার চেষ্টা করা।

স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী হওয়া: নারীদের স্বাবলম্বী এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সহায়সম্বলহীন নারীদেরই বেশিরভাগ সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে দুর্বল নারীদের আশেপাশের যৌন পিপাসু মানুষেরা অতিমাত্রায় নির্যাতন করার সুযোগ নেয়। সেইসঙ্গে সংসারে দুর্বল হওয়ার কারণে অনেক স্ত্রীকেও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

নারীরা যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে তারা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে। যারা যৌন নির্যাতন করে, তাদের চোখে চোখ রেখে এর প্রতিবাদ করতে জানতে হবে। এই আত্মবিশ্বাসটা শিশুরা পরিবার থেকেই অর্জন করে। তাই পরিবারের উচিত শিশুদের আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী হতে সাহায্য করা। যাতে তাদের সঙ্গে কেউ অন্যায় কিছু করতে চাইলে তারা যেন এর প্রতিবাদ করতে এবং সবাইকে জানাতে পারে।

বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের সঙ্গে অভিভাবকদের সুন্দর, সাবলীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করা উচিত। যাতে তারা স্কুল কলেজে তার সঙ্গে কে কী করছে তা সহজে জানা যায়। পারিবারিক সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে অসংখ্য কিশোর, কিশোরী এবং মেয়েরা তাদের সঙ্গে হওয়া নিপীড়নের কথা পরিবারকে জানাতে পারে না। ফলে এইসব কোমলমতি শিশু, কিশোর, কিশোরীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে এক ধরনের মানসিক অবসাদগ্রস্ততে ভোগে। যা পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগে এবং আত্মহত্যায় পরিণত
হয়।

ভার্চুয়াল জগৎ থেকে দূরে রাখা

কিশোর-কিশোরীদের কখনোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স না হওয়ার আগ পর্যন্ত ভার্চুয়াল জগৎ থেকে কিশোর কিশোরীদের দূরে রাখতে পারলে যৌন নিপীড়ন থেকে অনেকাংশে দূরে রাখা যাবে। যেসব ছেলেরা যৌন নিপীড়ন করে, তারা অবাধ ইন্টারনেট থেকে যৌন আসক্তি অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে তারাই যৌন নিপীড়ন শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই ভার্চুয়াল জগতে ব্ল্যাকমেইল করেও যৌন নিপীড়ন করে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা সৃষ্টি করা

যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের বাঁচাতে হলে স্কুল কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সেইসঙ্গে সামাজিক বেড়াজাল ছিন্ন করে সবাইকে খোলামেলাভাবে এইসব নিয়ে জানাতে হবে। যাতে শিশুরা নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরাই বলতে পারে এবং কখনো নিপীড়িত হলে তার প্রতিবাদ
করতে পারে।

হেয় প্রতিপন্ন না করা

অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, তাদের পরবর্তী সময়ে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। যা কখনোই উচিত নয়। যৌন নিপীড়নের শিকার কিছু কিছু সাহসী ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের পরিবার থেকে থামিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তাদের সামাজিকভাবে কটুদৃষ্টিতে দেখা হয়। যা অন্যজনকে সাহসী হতে বাঁধা দেয়। তাই কারো সঙ্গে কোনো প্রকার যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে তা যেন আমরা নেতিবাচকভাবে না নেই। আমরা যেন যৌন নিপীড়িত ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দেই। যাতে সমাজে আর কেউ এইজাতীয় কুকর্ম করার সাহস না করে।

যৌন হয়রানি রোধে করণীয়

* রাস্তাঘাটে বা যানবাহনে হেনস্থা বা যৌন হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে যাতে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।

* যদি কোন নির্জন স্থানে ঘটে তাহলে নারীকে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং কৌশলে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করতে হবে।

* যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে কন্যা সন্তানকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে গড়ে তোলার বিষয়ে পরিবারকে সচেতন হতে হবে।যতদ্রুত সম্ভব পুলিশের শরণাপন্ন হতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, যৌন নিপীড়ন বলতে কি বোঝায় তা স্পষ্ট নয়, সবার ধারণা শুধু ধর্ষণকে যৌন নিপীড়ন বলে। ২০০৩ সালের আইনে অসৎ উদ্দেশ্যে নারীর যেকোনো অঙ্গ স্পর্শ করাই যৌন নিপীড়ন। এমনকি অশালীন মন্তব্য, নারীর পোশাক ধরে ঢান দেওয়া, ধাক্কা দেয়াও যৌন নিপীড়ন এর মধ্যে পড়ে। এই অপরাধে নিপীড়ককে চিহ্নিত করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট এবং আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হব। ধর্ষণের শিকার নারীকে দায়ী না করে তার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে হবে।বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের দিকে। একটি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী হল নারী সমাজ। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতা নিশ্চিত না হলে একটি দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা যায় না। সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে নারীসমাজ। ভুক্তভোগীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সরকারি এবং ব্যক্তিগত ভাবে যৌন হয়রানি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। যৌন হয়রানি নির্মূলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test