E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জ্ঞান ও প্রাণের বইমেলা

পাঠক সৃষ্টির জবরদস্তিতে ওরা কারা!

২০২৩ মার্চ ০৭ ১৭:৪১:০৩
পাঠক সৃষ্টির জবরদস্তিতে ওরা কারা!

রহিম আব্দুর রহিম


জ্ঞান পিপাসুরা বই পড়েন, জ্ঞানীরা লেখেন। অন্ধকারে আলো জ্বালানোই হলো জ্ঞানীর কাজ। এই আলোর তীর্যক নিয়নবাতি একটি মানসম্পন্ন বই। বই মানে চকচক মলাটে ঝকঝক ছাঁপানো কোন কালো অক্ষরের পাতার পর পাতা নয়, বই মানেই ‘বিষয়’, ‘সমাজ’, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’, ‘ধর্ম-কর্ম’ কিংবা ঘটনার আড়ালের ঘটনার স্বচ্ছ উম্মোচিত রহস্য কাহিনী। যেখানে থাকা নানা জাতের বৈচিত্রময় কাহিনী নির্ভর প্রাপ্তী কিংবা জানার আকাঙ্খা বা ক্ষুধা। আমরা পাঠকরা এই বইয়ের খোঁজে যতটা না  সময় ব্যয় করছি, তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছি বইয়ের মলাট কিংবা কালো অক্ষরের চকচকে অক্ষর বিন্যাসের উপর। অত্যধুনিক এই যুগে পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

এক সময় দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের বিপুল পরিমান বইয়ের সমারোহ প্রতিষ্ঠিত ছিলো ‘গ্রন্থাগার’ (লাইব্রেরী)। এই লাইব্রেরীতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো। দল বেঁধে পড়াশোনার অভ্যাস, অভ্যস্থ থাকার অসংখ্যক ঘটনা আমাদের জানা। বই পাঠের মধ্যে যে কি আনন্দ, তা একজন সু-পাঠক ছাড়া অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। দেশের লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের সংখ্যা কম নয়। খাবার না খেলেও ঘুম হয়, বই না পড়লে ঘুম হয় না, এমন পাঠক ক’জন আছে? পরিসংখ্যান মুষ্কিল। গত কয়েকবছর আগে ভারতে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে গিয়েছিলাম শিশু-কিশোর নাট্য উৎসবে অংশগ্রহনকারী আমরা ১৩ জন। ফেরার পথে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রবেশ। বিশাল এলাকা জুড়ে মেলায় মানুষের ঢল। বই কেনার চেয়ে মেলায় আড্ডা জমাচ্ছেন পড়ুয়ারা। বইমেলায় আড্ডা জমানো কোন অপরাধ নয়; এটার মধ্যেও বইপ্রেম, জ্ঞান পিপাসুদের এক ধরনের সৃজনশীল কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ। গত বছর মহান একুশের বই মেলায় দেখা হয়েছিল এক ঝাঁক স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সাথে। তারা প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে বইমেলায় এসেছিল। এই শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে চায়, কিন্তু তা হয়ে উঠছে না পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোন নেতিবাচক পরিবেশের কারণে।

জাতীয় এক দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেলো, মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হক বলেছেন, “মেলায় পাইরেটেড বইয়ের সংখ্যা এত বেশি যে ভবিষ্যতে সৃজনশীল প্রকাশনার ব্যবসা অন্ধকারে ডুবে যাবে। দায়িত্ব নিয়ে যদি এসব প্রকাশনার দৌরাত্ব বন্ধ না করা যায়, তবে সৃজনশীল প্রকাশকরা ধীরে ধীরে নতুন বই প্রকাশ করা বন্ধ করে দেবে।” তাঁর এই বক্তব্য স্পষ্ট এবং সত্য। কিন্তু অনেক নামীদামী প্রকাশকরা দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নামে বই প্রকাশ করে দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে স-শরীরে উপস্থিত হয়ে জবরদস্তি করে বই বিক্রি করছে, এ ধরনের কর্মকান্ড ন্যাক্কারজনক নয় কি? তাদের বিরুদ্ধে কে, কখন, কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তা সময়ের দাবী। অমর একুশে বইমেলা চলাকালীন আমি আমার কর্মস্থলের দু’ একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষদের প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তারা ঘৃণার স্বরে উচ্চারণ করেছেন, ‘দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছবি প্রচ্ছদ দিয়ে প্রকাশিত বইগুলো জবরদস্তি করে বিক্রি করা হচ্ছে।’

কারা করছে, জানার আগ্রহ জানালে তিনি সামনে নিয়ে এলেন ‘স্বপ্নজয়ের ইচ্ছা’, রাষ্ট্রপতির ভাষণ সংকলন (২০১৩-২০১৫) প্রথম এবং দ্বিতীয় খন্ড। যে বই দু’টির গায়ে দাম লেখা ৮৫০/= এবং ৭৫০/= টাকা, মিলে ১,৬০০/= টাকা। অথচ ভাউচারে ৩,২০০/= টাকা উল্লেখ করে দাম নিয়েছেন গৌরব প্রকাশনার নির্ধারিত সেলস ম্যানরা। এই বই ক্রয়ের জন্য বাধ্য-বাধকতায় আবদ্ধ করে স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা পত্র দিয়েছেন। একই অবস্থা তা¤্রলিপি নামের এক প্রকাশনার। এরা ‘বঙ্গবন্ধু’, শেখ রাসেল, মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক অখ্যাত লেখকদের নি¤œমানের লেখা বই প্রকাশ করে স্থানীয় প্রশাসনদের চিঠি দিয়ে প্রায় স্কুল-কলেজে জবরদস্তি করে বিক্রি করছে। ‘রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা’, ড. আনু মাহমুদ লেখা বইটির প্রকাশক ‘তা¤্রলিপি’, বইটির গায়ে মূল্য ১,৩০০/= টাকা। গায়ের মূল্যে বই কিনতে বাধ্য করা হয়েছে উত্তরাঞ্চলের প্রায় প্রতিষ্ঠানকে। এধরনের জবরদস্তিতে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবী। একজন পাঠক তাঁর পছন্দের বই ক্রয় করবেন, কিন্তু কোন গ্রাহককে বই কিনতে বাধ্য করার মাঝে কি আদৌ পাঠক সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে?

আমি একজন পাঠক এবং ক্ষুদ্রমানের লেখক হিসেবে গর্ববোধ করছি এই বলে যে, এবছর অমর একুশের বইমেলায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এ বছর নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৫০ টি। গত বছর নতুন বইয়ের পরিমান ছিলো ৩ হাজার ৪১৬ টি। বিক্রি হয়েছে ৫২ কোটি টাকার বই। ১ ফেব্রুয়ারী থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মেলায় পাঠক-দর্শক, লেখক এসেছিলেন ৬৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬৩ জন। (তথ্যসূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ-১মার্চ)

জ্ঞান পিপাসুদের মাঝে মানসম্মত বই সাপ্লাই এবং পাঠ সৃষ্টিতে লেখক, প্রকাশক, সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব না হলে, শাক-সবজির মতো জ্ঞানের রাজ্যটিও ফরমালিনযুক্ত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

লেখক :শিক্ষক, নাট্যকার, গবেষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test